সারাবিশ্বের মতো বাংলাদেশেও জনসচেতনতার লক্ষ্যে ‘বিশ্ব ডায়াবেটিস দিবস’ পালিত হচ্ছে আজ ১৪ নভেম্বর (সোমবার)। দিবসটির এবারের প্রতিপাদ্য বিষয় ‘আগামীতে নিজেকে সুরক্ষায় ডায়াবেটিসকে জানুন।’
আন্তর্জাতিক ডায়াবেটিস ফেডারেশন দিবসটির উদ্যোক্তা। জাতিসংঘ দিবসটির সঙ্গে একাত্মতা ঘোষণা করেছে। তাই পৃথিবীর সব দেশ প্রতিবছর ১৪ নভেম্বর বিশ্ব ডায়াবেটিস দিবস পালন করে আসছে।
রোগীর দ্রুত বৃদ্ধি পাওয়ায় বর্তমানে সাধারণ রোগ হিসেবে বিবেচিত ডায়াবেটিস। সংশ্লিষ্টদের গবেষণালব্ধ ডাটা বলছে- এই সাধারণ রোগটিই এখন মহামারি আকার ধারণ করেছে। পৃথিবীতে বর্তমানে উচ্চ হারে ডায়াবেটিস রোগীর সংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে বাংলাদেশ, ভারত ও চীনে।
বিশ্ব ডায়াবেটিস ফেডারেশনের তথ্যমতে, বর্তমানে বিশ্বে প্রতি ১০ জনে ১ জন ডায়াবেটিসে আক্রান্ত। বিশ্বব্যাপী ৫৩ কোটি মানুষ ডায়াবেটিসে আক্রান্ত। এরমধ্যে ৯ কোটি মানুষ দক্ষিণ এশিয়ার। বাংলাদেশে প্রাপ্তবয়স্ক জনসংখ্যা ১০ কোটি ৫২ লাখ ৫৭ হাজার ৮০০ জন। এরমধ্যে ডায়াবেটিসের প্রাদুর্ভাব আছে ১২ দশমিক ৫ শতাংশের। অর্থাৎ ১ কোটি ৩১ লাখ ৩৬ হাজার ৩০০ জন প্রাপ্তবয়স্ক নাগরিক ডায়াবেটিসে আক্রান্ত।
সংস্থাটি বলছে, এখনই প্রতিরোধ করা না গেলে ২০৩০ সালের মধ্যে এই রোগে আক্রান্তের সংখ্যা ৫৮ কোটিতে পৌঁছাবে। এমনকি ২০৪৫ সাল নাগাদ ৭০ কোটিতে পৌঁছানোর আশঙ্কা রয়েছে।
বাংলাদেশ ডায়াবেটিক সমিতির মতে, ডায়াবেটিসে আক্রান্ত প্রতি ২ জনের মধ্যে ১ জন জানেন না তিনি আক্রান্ত হয়েছেন। তাদের অধিকাংশই টাইপ-২ ডায়াবেটিসে আক্রান্ত। দেশে এ মুহূর্তে ৮৪ লাখ মানুষ ডায়াবেটিসে আক্রান্ত। ৩০ বছরের বেশি বয়সের সবাইকে পরীক্ষা করলে এ সংখ্যা আরো বাড়বে।
এ ব্যাপারে বাংলাদেশ ডায়াবেটিক সমিতির সভাপতি ও জাতীয় অধ্যাপক ডা. এ কে আজাদ খান বলেন, ডায়াবেটিস দীর্ঘস্থায়ী রোগ। রোগীকে বেঁচে থাকতে হলে নিয়মিত ইনসুলিন ব্যবহার করতে হয়। কিন্তু আমাদের অনেক রোগীই তাদের রক্তের সুগারের কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যমাত্রা পূরণ করতে পারেন না। ফলে ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে আসে না।
তিনি আরো বলেন, সারাবিশ্বেই ডায়াবেটিস মহামারি আকার ধারণ করেছে। ডায়াবেটিস একটি মারাত্মক এবং প্রাণঘাতী রোগ, যা ব্যক্তি এবং তাদের পরিবার, সেই সঙ্গে স্বাস্থ্যসেবা ব্যবস্থা এবং জাতীয় অর্থনীতিতে ব্যাপক প্রভাব ফেলতে পারে। সেজন্য নিয়মিত পরীক্ষা করা উচিত।
বাংলাদেশ ডায়াবেটিক সমিতি জানায়, গর্ভকালীন ডায়াবেটিসে আক্রান্ত নারীদের ও গর্ভস্থ শিশুদের টাইপ-২ ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা বেশি। তা ছাড়া, গর্ভকালীন ডায়াবেটিস যদি নিয়ন্ত্রণ না করা হয় তবে তাদের পরবর্তী সময়ে টাইপ-২ ডায়াবেটিস হওয়ার ঝুঁকি আরো বেশি। এ অবস্থায় পরিকল্পিত গর্ভধারণ ও গর্ভকালীন ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে রাখলে টাইপ-২ ডায়াবেটিস অনেকাংশেই প্রতিরোধ করা সম্ভব। এ অবস্থায়, যাদের ডায়াবেটিস আছে, তাদের ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে রাখার বিষয়ে সচেতন করা এবং যাদের এখনও ডায়াবেটিস হয়নি তাদের ডায়াবেটিস প্রতিরোধে সচেতন করে তোলাই এ দিবসের প্রধান উদ্দেশ্য।
উল্লেখ্য, নগরায়ণের কারণে জীবন যাপন পদ্ধতি ও খাদ্যাভ্যাসের ব্যাপক পরিবর্তনের কারণে ডায়াবেটিস মহামারি আকার ধারণ করছে। দেশের রাজধানীসহ সবগুলো শহরে হাটাচলার যথেষ্ট সুযোগ নেই। কমে গেছে শারীরিক পরিশ্রম। অন্যদিকে নিয়মিত খাদ্যাভাসে যোগ হয়েছে ফাস্ট ফুড নামক মাত্রাতিরিক্ত ক্যালরিযুক্ত খাবার। শিশুসহ উঠতি প্রজন্মের খেলাধুলার জায়গার অভাব। একই জায়গায়, একইভাবে শুয়ে, বসে ঘন্টার পর ঘণ্টা মোবাইল, ইন্টারনেট ব্যবহার ডায়াবেটিসে আক্রান্তের অন্যতম কারণ বলে জানিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা।
এসব কারণে মানুষের দৈহিক ওজন বৃদ্ধি পাচ্ছে আনুপাতিক ও কাঙ্ক্ষিত হারের চেয়ে বেশি, মানুষের দৈহিক শ্রম দিনে দিনে কমে যাচ্ছে, বিভিন্ন সামাজিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক কারণে মানসিক চাপ বৃদ্ধিও ডায়াবেটিস রোগীর হার বাড়ার কারণ।
ডায়াবেটিস এমন একটি রোগ যেটিকে প্রতিরোধ করার যথেষ্ট সুযোগ আছে। কিন্তু একবার ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হলে বাকি জীবন ডায়াবেটিস নিয়েই কাটাতে হবে এবং প্রহর গুনতে হবে যে কখন ডায়াবেটিস-সংক্রান্ত জটিলতাগুলো দেখা দেয়। তাই সব স্তরের মানুষকে জেনে-বুঝে সচেতনভাবে ডায়াবেটিস প্রতিরোধের কর্মযজ্ঞে নিজের সামর্থ্য অনুসারে অংশগ্রহণ করতে হবে।
ডায়াবেটিস যে হারে বাড়ছে তাতে আমাদের এখনই এ রোগ প্রতিরোধে উপযুক্ত পদক্ষেপ নিতে হবে। আর যারা ডায়াবেটিসে আক্রান্ত তাদের সচেতন করে তুলতে হবে, যাতে তারা ডায়াবেটিসকে সুনিয়ন্ত্রণে রেখে সুস্থ, স্বাভাবিক ও কর্মঠ জীবন নিশ্চিত করতে পারেন। ঘন ঘন ডায়াবেটিস পরীক্ষা করাতে হবে। এক পর্যায়ে পৌঁছলে অনেক জটিল রোগের কারণ হয়ে উঠতে পারে ডায়াবেটিস।
যেহেতু বিশেষজ্ঞরা ডায়াবেটিস মহামারি আকার ধারণ করার আগাম বার্তা দিচ্ছেন তাই এখনই বিষয়টি বিশেষ গুরুত্ব দিয়ে রাষ্ট্রকে ডায়াবেটিস বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে নিয়ে এ কাজে নেতৃত্ব দিতে হবে সব স্তরের মানুষকে যুক্ত করে। পাঠ্যসূচি থেকে শুরু করে নগর-পরিকল্পনা, বিদ্যালয় স্থাপনসহ সব ক্ষেত্রে ডায়াবেটিস প্রতিরোধসহ মেটাবলিক রোগগুলো নিয়ন্ত্রণের কাঠামোগত উন্নতি করতে হবে।
সংবাদ মাধ্যম বিশেষ করে টেলিভিশনসহ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলোতে ডায়াবেটিসের ঝুকি, ভয়াবহতা তুলে ধরে জনসচেতনতা মূলক প্রচার চালাতে হবে। প্রতিটি হাসপাতাল, ক্লিনিক এবং সকল চিকিৎসক যাতে এই রোগ সম্পর্কে সাধারণ রোগীদের অন্যতত একটি কমন বার্তা দেন সে বিষয়ে সরকারের সংশ্লিষ্ট বিভাগকে দায়িত্ব ও উদ্যোগ নিতে হবে। অন্যথায় সাধারণ এউ রোগ বিশেষজ্ঞদের ভবিষ্যৎ বাণীকে সত্য প্রমাণ করে অচিরেই মহামারী আকার ধারণ করবে। সব দিক বিবেচনায় এ কথা বলা যায়-সময় থাকতেই ডায়াবেটিস নামক এই রোগের লাগাম টেনে ধরা ছাড়া কোনো বিকল্প নেই। অন্যথায় বিপদ বাড়লে আফসোস করা ছাড়া আর কিছুই করার থাকবে।
আসাদুল হক খোকন, সাংবাদিক, কবি
দৈনিক কলম কথা সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।