ভোজ্যতেলের মুসক সরকারের তরফ থেকে কমানো হলেও বাজারে মুল্যের প্রভাব কতটুকু কমেছে? এখন তো তেলে বাজার সয়লাব কিন্তু ভোক্তারা কি লাভবান হয়েছেন ?
চলতি মাসে বাজারে ভোজ্যতেল নিয়ে দেশব্যাপী অস্থিরতার কারনে ভোক্তারা চরম সংকটে পড়েছিলেন, বাজারে বেড়েই চলছিল ভোজ্য তেলের দাম। বাড়তে বাড়তে বিগত এক সপ্তাহের ব্যবধানে আবারো লিটারে ৫/১০ টাকা বাড়তি ছিল। ৫ লিটার বোতলজাত তেল বিক্রি হচ্ছে ৬২০ টাকারও বেশি।

ছুটির দিনে রাজধানীর কাঁচাবাজারে ক্রেতা সমাগমের পাশাপাশি পণ্যের সরবরাহও থাকে বেশি। তবে সবার নজর আলাদাভাবে ভোজ্য তেলের প্রতি। কয়েক মাস তেলের বাজারে নিয়ন্ত্রণহীন। গত মাসে প্রতি লিটারে মূল্য বেড়ে বোতলজাত তেল ১৩০ থেকে ১৪০ টাকায় বিক্রি হলেও পরে তা ১৭৫ থেকে ১৯০ টাকা পর্যন্ত উঠেছিলো।

ট্রেডিং কর্পোরেশন অব বাংলাদেশ-টিসিবির হিসাবে, গত ৫ মাসে দাম বেড়েছে লিটারে প্রায় ৬০ টাকা। তেল কিনতে গিয়ে বিপাকে ভোক্তারা। কনজুমারস এসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ-ক্যাবের সভাপতি গোলাম রহমান বলেন, তেলের দাম নিয়ন্ত্রণে এখনই সঠিক তদারকি করা প্রয়োজন।

সয়াবিন ও পাম অয়েলে এবার আমদানি পর্যায়ে ১০ শতাংশ মূল্য সংযোজন কর (মূসক বা ভ্যাট) কমানো হয়েছে। গত বুধবার (১৭মার্চ) অর্থ মন্ত্রণালয়ের অভ্যন্তরীণ সম্পদ বিভাগ (মূল্য সংযোজন কর ও সম্পূরক শুল্ক) হতে এ বিষয়ে একটি প্রজ্ঞাপন জারি করা হয়। এতে পরিশোধিত ও অপরিশোধিত সয়াবিন তেল এবং পরিশোধিত ও অপরিশোধিত পাম অয়েল আমদানি পর্যায়ে চলমান মূল্য সংযোজন কর ১৫ শতাংশ হতে কমিয়ে ৫ শতাংশ নির্ধারণ করা হয়েছে।

এনবিআরের কর্মকর্তারা জানান, পরিশোধিত ও অপরিশোধিত সয়াবিন ও পাম অয়েলের আমদানি পর্যায়ে ১৫ শতাংশ ভ্যাট ছিল এত দিন। এখন ১০ শতাংশ কমিয়ে ভ্যাট অর্থাৎ ৫ শতাংশ নির্ধারণ করে প্রজ্ঞাপন জারি করা হয়েছে। ভ্যাট কমানোর প্রজ্ঞাপনটি বুধবার থেকেই কার্যকর হবে। ভোক্তারা ভ্যাট কমানোর সুফল পাবেন বলেই আশা করছেন বাজার সংশ্লিষ্টরা। এর আগে এনবিআর এক প্রজ্ঞাপনের মাধ্যমে পরিশোধিত সয়াবিন তেল ও পরিশোধিত পাম অয়েলের  প্রয়োজনীয় উৎপাদন ও ব্যবসায় পর্যায়ে সব ভ্যাট প্রত্যাহার করে।

মার্চ মাসে চট্টগ্রাম বন্দর দিয়ে দেশে লক্ষাধিক মেট্রিক টন ভোজ্যতেল আমদানি হয়েছে। পাইপ লাইনে আছে আরো অন্তত ১২ হাজার মেট্রিক টন তেল। ভোজ্যতেল আমদানিতে ভ্যাট প্রত্যাহারের পরও বাজারে দামে খুব বেশি প্রভাব নেই। ব্যবসায়ীরা বলছে বিশ্ববাজারে উর্ধমুখী দামের প্রভাব দেশেও পড়েছে। যদিও এতে কারসাজি দেখছে ভোক্তা সংগঠনগুলো।

ব্যবসায়ীরা বলছিলো বিশ্ববাজারে তেলের দামের অস্থিরতার পর দেশের বাজারে সয়াবিন তেলের সংকট দেখা দিয়েছে। অথচ বিভিন্ন তথ্যে দেখা যাচ্ছে মজুদ ও সরবরাহ পর্যাপ্ত।

চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ সচিব মো. ওমর ফারুক জানান, দেশে বর্তমানে মজুদ আছে প্রায় ২ লাখ মেট্রিক টন ভোজ্যতেল। আর মার্চ মাসের ১ তারিখ থেকে চট্টগ্রাম বন্দরে এসেছে অপরিশোধিত ভোজ্যতেলবাহী ৯টি জাহাজ। ৬টি জাহাজ এরইমধ্যে ৬৩ হাজার ২৯৯ মেট্রিক টন তেল খালাস করে বন্দর ছেড়েছে। বাকি ৩টি জাহাজে চলছে প্রায় ৪১ হাজার মেট্রিকটন ভোজ্যতেল খালাস কার্যক্রম। ১২ হাজার মেট্রিকটন নিয়ে আরেকটি জাহাজ আসার কথা রয়েছে। পর্যাপ্ত মজুদ ও সরবরাহ থাকার পরও তেল সংকটের পেছনে বিশ্ব তেলের বাজারের অস্থিরতাকে দুষছেন ব্যবসায়ীরা।

তবে, ভোক্তা অধিকার সংগঠনগুলো বলছে, নানা সময়ে বিভিন্ন কারসাজির সাথে যুক্তদের কোনো শাস্তি হয়নি, তাই সুযোগ পেলেই দাম বাড়িয়ে দেন ব্যবসায়ীরা।

ভোজ্যতেলের দাম নিয়ন্ত্রণে এরই মধ্যে আমদানি, উৎপাদন ও ভোক্তা পর্যায়ে ভ্যাট কমিয়েছে সরকার। ভোজ্যতেল আমদানিতে ভ্যাট ১৫ শতাংশ থেকে কমিয়ে ৫ শতাংশ করেছে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড-এনবিআর। বুধবার এ বিষয়ে প্রজ্ঞাপন জারি করা হয়েছে।

এতে বলা হয়, পরিশোধিত-অপরিশোধিত সয়াবিন তেল ও অপরিশোধিত পাম তেল আমদানিতে ১৫ থেকে কমিয়ে ৫ শতাংশ করা হয়েছে। চলতি বছরের ৩০ জুন পর্যন্ত এই সিদ্ধান্ত কার্যকর থাকবে। এর আগে, গত ১৪ মার্চ এনবিআর উৎপাদন ও ভোক্তা পর্যায়ে ভোজ্যতেলের ওপর মোট ২০ শতাংশ ভ্যাট প্রত্যাহারের বিষয়ে এক আদেশ জারি করে।

এদিকে ভারতের ভোজ্যতেল আমদানিতে ঊর্ধ্বমুখিতা দেখা দিয়েছে। ফেব্রুয়ারিতে আমদানি গত বছরের একই সময়ের তুলনায় ২৩ শতাংশ বেড়েছে। আমদানি বৃদ্ধিতে সবচেয়ে বড় ভূমিকা রেখেছে পরিশোধিত পাম অয়েল। সম্প্রতি এ তথ্য জানিয়েছে সলভেন্ট এক্সট্রাক্টরস অ্যাসোসিয়েশন অব ইন্ডিয়া (এসইএ)।

সংস্থাটি এক বিবৃতিতে জানায়, ফেব্রুয়ারিতে ভারত ৯ লাখ ৮৩ হাজার ৬০৮ টন ভোজ্যতেল আমদানি করে। গত বছরের একই মাসে আমদানি হয়েছিল ৭ লাখ ৯৬ হাজার ৫৬৮ টন। ফেব্রুয়ারিতে ভোজ্যতেলের মধ্যে সবচেয়ে বেশি আমদানি হয় পরিশোধিত পাম অয়েল। পণ্যটির আমদানি বেড়ে ৩ লাখ ২ হাজার ৯২৮ টনে পৌঁছেছে।

অন্যদিকে মোট উদ্ভিজ্জ তেল (ভোজ্য ও ভোজ্য নয় এমন) আমদানি বেড়ে ১০ লাখ ১৯ হাজার ৯৯৭ টনে উন্নীত হয়েছে। গত বছরের একই সময় আমদানির পরিমাণ ছিল ৮ লাখ ৩৮ হাজার ৬০৭ টন। গত মাসে ভোজ্য নয় এমন উদ্ভিজ্জ তেল আমদানি ৪২ হাজার ৩৯ টন থেকে কমে ৩৬ হাজার ৩৮৯ টনে নেমেছে। অপরিশোধিত পাম অয়েল আমদানিও কমেছে। গত বছরের ফেব্রুয়ারিতে ভারত ২৪ লাখ ৮৯ হাজার ১০৫ টন অপরিশোধিত পাম অয়েল আমদানি করলেও চলতি বছরের একই মাসে তা কমে ১৫ লাখ ৬২ হাজার ৬৩৯ টনে নেমেছে।

গত কয়েক সপ্তাহ ধরে মালয়েশিয়ার বাজারে পাম অয়েলের ভবিষ্যৎ সরবরাহ মূল্য ঊর্ধ্বমুখী ছিল। তবে বতর্মান সেটি কমেছে। ভোজ্যতেলটির ভবিষ্যৎ সরবরাহ মূল্য একদিনে প্রায় ১০ শতাংশ কমেছে। খবর বিজনেস রেকর্ডার।

বুরসা মালয়েশিয়া ডেরিভেটিভস এক্সচেঞ্জে পাম অয়েলের মে মাসের সরবরাহ মূল্য গতকাল প্রথমার্ধের পর সাড়ে ৭ শতাংশের বেশি কমে যায়। এ সময় টনপ্রতি মূল্য ৫০৭ রিঙ্গিত কমে ৬ হাজার ২০০ রিঙ্গিতে দাঁড়ায়। এর আগে গত তিন সপ্তাহ ভবিষ্যৎ সরবরাহ মূল্য প্রায় ২০ শতাংশ বেড়েছিল।

বিশ্বে পাম অয়েলের শীর্ষ উৎপাদক ও রফতানিকারক দেশ ইন্দোনেশিয়া। আর দ্বিতীয় শীর্ষ দেশ মালয়েশিয়া। সম্প্রতিক সময়ে ভোজ্যতেলের আন্তর্জাতিক বাজার বেশ অস্থির  হওয়ায় পাম অয়েলের রফতানি সীমিত করেছে ইন্দোনেশিয়া। এজন্য নতুন করে বিধিনিষেধ আরোপ করেছে দেশটির সরকার।

শীর্ষ সরবরাহকারী দেশের এ বিধিনিষেধ ক্রেতাদের মালয়েশিয়ামুখী করতে ভূমিকা রাখবে বলে মনে করছেন বাজার বিশ্লেষকরা। এরই মধ্যে মালয়েশিয়া থেকে ভোজ্যতেলটির আমদানি বাড়াতে উদ্যোগ নিয়েছে শীর্ষ ভোক্তাদেশ ভারত।

 

পাঠিয়েছেনঃ  সাজ্জাদ আলম খান সজল, বিশিষ্ট সাংবাদিক ও কলামিস্ট