২৭ বছর ধরে চলছে পূর্বাচল নতুন শহর গড়ার কাজ। প্লটপ্রাপ্তদের অনেকে এরই মধ্যে মারাও গেছেন। কিন্তু প্লট মালিক হেলাল উদ্দিন আর অপেক্ষা করলেন না। ১৩ নম্বর সেক্টরের ১০৯ নম্বর রোডের মাথায় তিনি সাততলা বাড়ি বানিয়েছেন।
নাম মা মহল। ১২ ইউনিটের ভবনটির চারটি তিনি ভাড়াও দিয়েছেন। অবশ্য বাকি আটটি ফাঁকা পড়ে আছে।
হেলাল উদ্দিন বলেন, ‘রাস্তার সমস্যার কারণে ভাড়াটিয়া আসতে চায় না। বোতলের গ্যাস (এলপিজি) ব্যবহার করতে হয়। নলকূপ বসিয়ে পানির ব্যবস্থা করেছি। সরকার শুধু বিদ্যুৎ দিয়েছে। স্কুল-কলেজ, হাট-বাজার নেই। তাই প্রত্যাশিত ভাড়া, ভাড়াটিয়া কোনোটাই পাওয়া যাচ্ছে না। ’
জানায়, এই প্রকল্পের ২৫ হাজার ১৬টি আবাসিক প্লটের মধ্যে মাত্র ১৫৩টির মালিক ভবনের নকশা অনুমোদন করিয়ে নিয়েছেন রাজউক থেকে। এসব প্লটের বেশির ভাগেরই ভবন নির্মাণকাজ হয়েছে বা হচ্ছে। বাকি প্লট মালিকরা এখনো নকশার অনুমোদন নেননি। তবে এর মধ্যে আদি নিবাসী কোটায় প্লট পাওয়া প্রায় ৫০০ মালিক পাকা-আধাপাকা একতলা বাড়ি করেছেন। একতলা বাড়ির জন্য রাজউকে নকশা অনুমোদন করাতে হয় না। সাত হাজার নিবাসী এখানে প্লট পেয়েছেন। মূলত তাঁদের জায়গায়ই হচ্ছে পূর্বাচল নতুন শহর।
প্রকল্প এলাকার ভেতরে চারটি মাধ্যমিক বিদ্যালয় করার কথা রাজউকের। দুটির ভবন হয়েছে। স্কুল চালু হয়নি। প্রকল্প এলাকায় আগের ১১টি প্রাথমিক বিদ্যালয় আছে। সেগুলোর জন্য প্রকল্পে জায়গা বরাদ্দ রাখা হয়েছে। কিন্তু স্কুলগুলো সেক্টর ধরে স্থানান্তর হয়নি। প্রকল্পে একটি সরকারি হাসপাতাল থাকার কথা। সেটির নির্মাণকাজ শুরু হয়নি। ৩০টি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানকে হাসপাতাল করার জন্য জায়গা দেওয়া হয়েছে। তারা কেউ সেখানে হাসপাতালের কাজ শুরু করেনি। প্রতি সেক্টরে একটা করে বাজার থাকার কথা। এখনো কোনো বাজার তৈরি করা হয়নি।
জানতে চাইলে রাজউকের প্রধান প্রকৌশলী (বাস্তবায়ন) ও পূর্বাচল প্রকল্পের পরিচালক উজ্জ্বল মল্লিক বললেন, ‘ছোটখাটো কিছু বিষয় ছাড়া বেশির ভাগ সুবিধা নিশ্চিত করা হয়েছে। প্রকল্পে ১৬ লাখ মানুষের চাহিদা পূরণ করা যাবে সে পরিমাণ পানি সরবরাহের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে চীনা প্রতিষ্ঠান ইউনাইটেড ডেলকট ওয়াটারকে। কিন্তু প্লট মালিকরা যদি দ্রুত বাড়ি নির্মাণ না করেন তাহলে আমরা পানির লাইন কোথায় দেব। ’
মা মহলের আশপাশে আর কোনো ভবন নেই। রয়েছে কয়েকটি আধাপাকা আর টিনশেড ঘর। এসব ঘরের কয়েকটির সামনেও ঝুলছে ভাড়ার বিজ্ঞপ্তি। আধাপাকা একটি বাড়ির ভাড়ার বিজ্ঞপ্তিতে দেওয়া মোবাইল নম্বরে যোগাযোগ করলে রফিকুল ইসলাম নামে এক ব্যক্তি বললেন, ‘ঘর তুলেছি। তবে পূর্বাচলে এখনো থাকার মতো পরিবেশ হয়নি। গ্যাস নেই। ধুলাবালি আর ভাঙা রাস্তা দেখে কেউ ভাড়া নেয় না। ’
১৩ নম্বর সেক্টরের ১০৮ নম্বর সড়কের পাশে বাসেত আলীর ছোট্ট চা দোকান। আদি বাসিন্দা হিসেবে তিনি একটি প্লট পেয়েছেন। সেখানে টিনশেড ঘর তুলে পরিবার নিয়ে থাকেন। বাসেত আলী বলেন, ‘এইহানে কারেন্ট ছাড়া এহনো অন্য কিছুর ঠিক নাই। সবাই চাইর পাশে দেয়াল তুইলা, নিজের নাম লাগাইয়া গেছে গা, আর খবর নাই। এমন কইরা বছরের পর বছর চইলা যাচ্ছে। ’
সরেজমিন ঘুরে দেখা গেছে, প্রকল্পে এখনো স্যুয়ারেজ লাইন হয়নি। হয়নি ফুটপাত। আগে করা রাস্তাগুলো খানাখন্দ হয়ে গেছে। রাজউক বলছে, এসব কাজ প্রকল্প মেয়াদেই শেষ হবে। চার মাস পর আগামী জুনে এই প্রকল্পের বর্ধিত মেয়াদ শেষ হবে। প্রকল্প পরিচালক উজ্জ্বল মল্লিক আরো বলেন, ‘আমরা তো প্রায় সব করে দিলাম। এখন যদি কেউ বাড়ি না বানায় তবে আমরা কঠোর ব্যবস্থা নেব। ’
১৯৯৫ সালের জুলাই মাসে নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জ ও গাজীপুরের কালীগঞ্জের ছয় হাজার ১৫০ একর জমিতে বাস্তবায়ন শুরু হয় পূর্বাচল নতুন শহর প্রকল্প। তিন দফা সময় বাড়িয়ে ২০১০ সালে প্রকল্পের কাজ শেষ করার কথা ছিল। পরে আরো অন্তত পাঁচ দফা সময় বাড়িয়ে আগামী জুন পর্যন্ত করা হয়েছে। প্রকল্প পরিচালক বলছেন, এই সময়ের মধ্যে অবশ্যই কাজ শেষ করবেন তাঁরা।
গত বৃহস্পতিবার ১৩ নম্বর সেক্টরের ১১৩ নম্বর সড়কে গিয়ে একটি সাইনবোর্ডে চোখ পড়ল। ‘মেজবানি ভোজ’ রেস্টুরেন্ট। ভেতরে কাউকে পাওয়া গেল না। পাশের ৬৫ নম্বর প্লটে বাঁশের ঘরে থাকেন জুলহাস ও তাঁর পরিবার। জানতে চাইলে জুলহাস বললেন, কায়েস নামে স্থানীয় এক ব্যক্তি তাঁকে সেখানে থাকতে দিয়েছেন। রেস্টুরেন্ট সম্পর্কে জানতে চাইলে বললেন, ‘এটি করোনার আগে চালু হইছিল। করোনার পর মানুষজন না আসায় বন্ধ হয়ে গেছে। ’
৪০২ নম্বর সড়কের ৭ নম্বর প্লটে টিনের ঘরে বাস করা হেলেনা আক্তার জানান, প্রায় ১৫ বছর ধরে ওখানে আছেন। প্লটের মালিক কে জানেন না। স্বামীহারা হেলেনা মেয়ের বিয়ে দিয়েছেন। ছেলেকে নিয়ে এখানে থাকেন। বললেন, ‘এইডা আমার জায়গা না। আমাগোরে ২ নম্বর সেক্টরে জায়গা দিছে। হেইহানে এহনো বালু আর বালু। এই জন্যে এইহানে থাকি। ’
স্থানীয় কয়েকজন জানায়, প্রকল্পের প্রথম প্লটগুলো বাসযোগ্য হয়েছে। সেখানে রাস্তাঘাটও ভালো। তবে মাটি পড়ে পড়ে ড্রেনগুলো বন্ধ হয়ে গেছে। স্যুয়ারেজ লাইন নেই। নিরাপত্তার ব্যবস্থাও নেই।
প্রকল্পে চারটি থানার জন্য যে জমি দেওয়া হয়েছে, সেখানে বলার মতো কোনো কাজ হয়নি। এই তথ্য নিশ্চিত করেছে রাজউক ও স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। তবে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে বলা হয়েছে, তারা কোন থানার অধীনে কোন এলাকায় থাকবে তা নিয়ে কাজ করছে এখন।
জানতে চাইলে রাজউকের চেয়ারম্যান এ বি এম আমিন উল্লাহ নূরী বলেন, ‘পূর্বাচল প্রকল্পের বাকি যেসব কাজ আছে সেগুলো ভবন গড়ে তোলার সঙ্গে যুক্ত। যদি স্থাপনা না থাকে তাহলে আমরা কোথায় পানির লাইন, স্যুয়ারেজের লাইন নেব। ’ রাস্তাঘাট সম্পর্কে তিনি আরো বলেন, ‘রাস্তাঘাট, ড্রেন, ব্রিজ, বিদ্যুৎ দেওয়া হয়েছে। এখন সবার কাছে আহ্বান থাকবে, প্লট মালিকরা যাতে বাড়িঘর নির্মাণ করেন। চারটি থানা করতে জায়গা দেওয়া হয়েছে। ফায়ার সার্ভিস, বিশ্ববিদ্যালয়, স্টেডিয়ামের জন্য জায়গা দেওয়া হয়েছে। সবাইকে অনুরোধ করব আপনারা স্থাপনা নির্মাণ করুন। তাহলেই পূর্বাচল শহর গড়ে উঠবে। ’
স্টেডিয়াম নির্মাণের বিষয়ে জানতে চাইলে বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ডের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা নিজাম উদ্দিন চৌধুরী বলেন, ‘পূর্বাচলে শেখ হাসিনা স্টেডিয়াম নির্মাণ একটি মেগাপ্রকল্প। বললেই হয়ে যাবে না। তবে কাজ অনেকটা এগিয়েছিল। কিন্তু করোনার কারণে পিছিয়ে গেছে। এখন আবার পুরোদমে কাজ শুরু করা হবে। তিন-চার বছরের মধ্যে সেখানে স্টেডিয়াম নির্মাণ হয়ে যাবে। ’
পূর্বাচল প্রকল্পের বিষয়ে নগর পরিকল্পনাবিদ আদিল মোহাম্মদ খান বলেন, ‘একটি ভালো উদ্যোগ যখন দীর্ঘ সময়েও বাস্তবায়ন হয় না, তখন বুঝতে হবে কোথাও ত্রুটি আছে। যাঁদের প্লট দেওয়া হলো তাঁরা কেন সেখানে স্থাপনা তুলছেন না, এ বিষয়ও খতিয়ে দেখতে হবে। প্রয়োজনে ব্যবস্থা নিতে হবে। তবে এর আগে রাজউকের দায়িত্ব, সব সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত করা। ’
দৈনিক কলম কথা সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।