সরকার ঘোষিত কঠোর বিধিনিষেধ শিথিল করা হয়েছে। এ কারণে আজ সরকারি-বেসরকারি অফিস, ব্যাংক, শপিংমল-মার্কেট খুলবে। চলবে বাস, লঞ্চ এবং ট্রেন। খোলা থাকবে খাবার হোটেল ও রেস্টুরেন্ট। তবে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, পর্যটন, বিনোদন কেন্দ্র, রিসোর্ট বন্ধ থাকবে। জনসমাগমে আগের মতোই নিষেধাজ্ঞা থাকছে। এদিকে বিধিনিষেধ শিথিল হওয়ার আগের দিন মঙ্গলবার দেশে করোনায় ২৬৪ জনের মৃত্যু হয়েছে। এমন অবস্থায় স্বাস্থ্যবিধি নিশ্চিতের পাশাপাশি সুশৃঙ্খলভাবে গণটিকা কার্যক্রম পরিচালনা করা না গেলে করোনা পরিস্থিতি ভয়াবহ হতে পারে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা।
বিধিনিষেধ শিথিল হওয়ায় বাস, লঞ্চ ও ট্রেনের সব আসনেই যাত্রী বহন করা যাবে। এ ক্ষেত্রে অর্ধেক সংখ্যক বাস চলাচলের নির্দেশনা দিয়েছে সরকার। শপিংমল, মার্কেট ও দোকানপাট সকাল ১০টা থেকে রাত ৮টা পর্যন্ত খোলা থাকবে। খাবার দোকান, হোটেল ও রেস্তোরাঁ অর্ধেক আসন খালি রেখে সকাল ৮টা থেকে রাত ১০টা পর্যন্ত খোলা থাকবে। রোববার এই অফিস আদেশ জারি করে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ। এতে সব ক্ষেত্রে মাস্ক পরা ও স্বাস্থ্যবিধি অনুসরণেরও নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। অন্যথায় সংশ্লিষ্টদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
কঠোর বিধিনিষেধ শিথিল করায় মঙ্গলবার ঢাকামুখী মানুষের ভিড় দেখা যায়। বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে কর্মরত যারা গ্রামের বাড়িতে গিয়েছিলেন, তারা ফিরেছেন এদিন। ব্যক্তিগত গাড়ি, ভাড়ায় চালিত মাইক্রোবাস, প্রাইভেট কার, মোটরবাইক, ট্রাক, পিকআপসহ বিভিন্ন যানবাহনে তারা ফিরেন। ঢাকার প্রবেশমুখ গাবতলী, বছিলা, বাবুবাজার, শ্যামপুর, উত্তরা-আব্দুল্লাপুর, সায়েদাবাদ-যাত্রাবাড়ী, সুলতানা কামাল সেতু, পূর্বাচল ৩০০ ফুট সড়ক দিয়ে যানবাহনে চড়ে লোকজনকে ঢাকায় প্রবেশ করতে দেখা গেছে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর পক্ষ থেকে তাদের বাধা দেওয়া হয়নি।
২৩ জুলাই সকাল ৬টা থেকে ১৪ দিনের কঠোর বিধিনিষেধ জারি করে সরকার। তখন ২৩টি শর্ত দেওয়া হয়। সেই বিধিনিষেধের মেয়াদ ৫ আগস্ট রাত ১২টায় শেষ হয়। পরে সব শিল্প-কারখানা খুলে দিয়ে ও অভ্যন্তরীণ বিমান চালু রেখে ওই বিধিনিষেধের মেয়াদ পাঁচ দিন বাড়ানো হয়। মঙ্গলবার রাত ১২টায় সেই বিধিনিষেধ শেষ হয়।
সরকারের সংশ্লিষ্ট বিভাগ থেকে বলা হয়েছে, ৩ আগস্ট করোনাভাইরাস সংক্রমণ পরিস্থিতি পর্যালোচনা সংক্রান্ত আন্তঃমন্ত্রণালয় সভা হয়। দেশের আর্থ সামাজিক অবস্থা, অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড সচল রাখা এবং সামগ্রিক পরিস্থিতি বিবেচনায় নিয়ে বিধিনিষেধ শিথিলের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। পাশাপাশি বাংলাদেশ সড়ক পরিবহণ কর্তৃপক্ষ (বিআরটিএ) বাস চলাচলের ব্যাপারে নির্দেশনা জারি করে।
সংস্থাটি বলেছে, স্থানীয় প্রশাসন সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের সঙ্গে আলোচনা করে প্রতিদিন মোট পরিবহণের অর্ধেক চালানোর ব্যবস্থা করবে। আসন পূর্ণ করে পরিবহণ চালাতে পারবে। তবে কোনোভাবেই দাঁড়িয়ে বা আসনের অতিরিক্ত যাত্রী পরিবহণ করতে পারবে না। করোনা সংক্রমণ পরিস্থিতির কারণে দীর্ঘদিন অর্ধেক আসন ফাঁকা রেখে পরিবহণ চলেছে।
এর জন্য নির্ধারিত ভাড়ার চেয়ে ৬০ শতাংশ বাড়তি ভাড়া যোগ করে আদায়ের সিদ্ধান্ত দিয়েছিল সরকার। আজ থেকে ৬০ শতাংশ বাড়তি ভাড়ার আর প্রয়োজন হবে না। বিআরটিএ বলেছে, গণপরিবহণের যাত্রী, চালক, সুপারভাইজার ও কন্ডাক্টর, চালকের সহকারী এবং টিকিট বিক্রির কাজে জড়িত প্রত্যেককে মাস্ক পরতে হবে। রাখতে হবে প্রয়োজনীয় হ্যান্ড স্যানিটাইজার। যাত্রার শুরু এবং শেষে যানবাহন পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন করার পাশাপাশি জীবাণুনাশক দিয়ে যানবাহন জীবাণুমুক্ত করতে হবে।
রাজবাড়ী প্রতিনিধি জানান, কঠোর বিধিনিষেধ শিথিল হওয়ায় আজ থেকে দৌলদিয়া-পাটুরিয়া নৌরুটে ফেরি ও লঞ্চ চলাচল করবে আগের নিয়মে। যাত্রী পরিবহণে ১৮টি লঞ্চ চলাচল করবে। মঙ্গলবার সরেজমিন ঘুরে লঞ্চ ধোয়া ও মোছার কাজ করতে দেখা গেছে। বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহণ করপোরেশন (বিআইডব্লিউটিসি) দৌলদিয়ায় যানবাহন পারাপারে ছোট-বড় ১৪টি ফেরি চালু রেখেছে। তবে ফেরি বাড়ানোর বিষয়ে আলোচনা চলছে। এ ব্যাপারে সিদ্ধান্ত হলে ফেরি সংখ্যা বাড়তে পারে।
রাজশাহী ব্যুরো জানায়, আজ থেকে দেশের পশ্চিমাঞ্চলে ২৪ জোড়া ট্রেন চলাচল করবে। এর মধ্যে ২০ জোড়া ট্রেন আন্তঃনগর। অন্য চার জোড়া মেইল এক্সপ্রেস ও কমিউটার। ট্রেন চলাচল শুরু করতে কয়েক দিন থেকে প্রস্তুতি নেওয়া হয়েছে। কাউন্টার ও অনলাইন থেকে টিকিট বিক্রি করা হচ্ছে। পশ্চিমাঞ্চলের রেলওয়ের মহাব্যবস্থাপক মিহির কান্তি গুহ বলেন, ৫০ শতাংশ অনলাইন এবং ৫০ শতাংশ কাউন্টার থেকে বিক্রি করা হয়েছে।
এ প্রসঙ্গে রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (আইইডিসিআর) উপদেষ্টা ড. মুশতাক হোসেন যুগান্তরকে বলেন, দেশের সামাজিক সুরক্ষা ব্যবস্থাপনা দুর্বল হওয়ায় জীবন ও জীবিকার তাগিদে সরকারকে অনেক কিছু করতে হচ্ছে। দেশে করোনা পরিস্থিতি বিপদসীমার ওপরে অবস্থান করছে। পানি মাথার এক হাত ওপর দিয়ে যাওয়া এবং ১০ হাত ওপর দিয়ে যাওয়া একই কথা। পরিস্থিতি বিপদসীমার নিচে না আসা পর্যন্ত সতর্কতার ক্ষেত্রে কোনো ত্রুটি করলে অবস্থা যে আরও খারাপ হবে, এটা বলার অপেক্ষা রাখে না।
তিনি বলেন, করোনা নিয়ন্ত্রণে আনতে রোগী শনাক্ত করে আইসোলেশন নিশ্চিত এবং টেলিমেডিসিন সেবা কার্যকর করতে হবে। তাহলে সংক্রমণ অনেকাংশে কমিয়ে আনা সম্ভব। পাশাপাশি স্বাস্থ্যবিধি ও টিকা নিশ্চিত করতে হবে।
জানতে চাইলে জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ডা. মোজাহেরুল ইসলাম বলেন, করোনা নিয়ন্ত্রণে সরকারের কঠোর বিধিনিষেধ থেকে কার্যকর সুফল মেলেনি। এখন গণটিকা কার্যক্রম চলছে। এটা ইতিবাচক হলেও শৃঙ্খলা রক্ষা করা সম্ভব হচ্ছে না। গণটিকা দান কর্মসূচি সফল না হলে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাখা কঠিন হবে।
তিনি বলেন, জীবন ও জীবিকার প্রয়োজনে বিধিনিষেধ শিথিল করার যৌক্তিকতা রয়েছে। তবে করোনা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করতে স্বাস্থ্যবিধি নিশ্চিতে বিশেষ গুরুত্বারোপ করতে হবে। বাস, লঞ্চ, ট্রেন, বাজার, শপিংমল, হোটেল-রেস্টুরেন্ট এবং বাজারগুলো যাতে স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলে সে ব্যাপারে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে।
কঠোর লকডাউনের শেষ দিনে ঢাকায় তীব্র যানজট : কঠোর বিধিনিষেধের শেষ দিন বাস ব্যতীত লেগুনা, ইজিবাইকসহ সব যানবাহন স্বাভাবিক সময়ের মতো রাজধানীর সড়ক ও মহাসড়কে চলাচল করেছে। ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের যাত্রাবাড়ী থেকে সাইনবোর্ড, মাতুয়াইল, কোনাপাড়া, যাত্রাবাড়ী-ডেমরা সড়ক, শনিরআখড়া, জিয়া সরণিতে এমন দৃশ্য দেখা গেছে। এদিন যাত্রাবাড়ী গোলচত্বরে যানবাহনের জট ছিল। কেউ জরুরি কাজে, কেউ আবার সাধারণ কাজেই ঘর থেকে বের হন। অধিকাংশের মুখে মাস্ক দেখা যায়নি। বড় শপিংমলগুলো ছাড়া পাড়া-মহল্লার দোকানপাট খোলা ছিল।
মিরপুর ১, ২, ১০, ১১, ১২ আগারগাঁও, গাবতলী ঘুরে দেখা যায়, প্রধান সড়কসহ মহল্লার অলিগলিতে বড় বড় বাস পার্কিং করে রাখা আছে। আর এসব বাস ধোয়া-মোছার কাজ করছেন শ্রমিকরা।
দৈনিক কলম কথা সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।