হাওর মানেই অথৈ পানির সমারোহ। দূর থেকে প্রতিটি গ্রামকে মনে হয় একেকটা ছোট দ্বীপকুঞ্জ। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে হাওরের দৃশ‌্যপট অনেকটাই পাল্টে গেছে। যোগাযোগ ব‌্যবস্থার উন্নতির ফলে এখন আর মানুষকে খুব একটা কষ্ট পোহাতে হয় না। শুকনো মৌসুমে এখন পুরো হাওর জুড়েই চলে দুই-তিন ও চার চাকার ইঞ্জিতচালিত গাড়ি। বদলে গেছে হাওরপাড়ের মানুষের জীবন-জীবিকাও, পাল্টাচ্ছে অর্থনৈতিক চিত্র। হাওরে জন্ম নেওয়া বর্তমান মহামান‌্য রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদ। হাওর ও হাওর পাড়ের মানুষদের নিয়ে তার স্বপ্ন অনেক।

ধীরে ধীরে তার বাস্তবায়নও হতে শুরু করেছে। হাওর এলাকার মানুষজন সবচেয়ে কঠিন যে সময় পাড় করেছে। এখন সেসব কষ্ট অনেকটাই লাঘব হয়েছে। শুকনো মৌসুমে হাওরে পায়ে হেঁটে পথ পাড়ি দিতে হতো। আর বর্ষায় এক গ্রাম থেকে অন‌্য গ্রামে চলাচলের একমাত্র মাধ‌্যম ছিল নৌকা। তাইতো হাওরের মানুষের প্রবাদ ছিল, ‘শুকনোয় পাও, বর্ষায় নাও’।তাইতো সময়ের সঙ্গে বদলাচ্ছে হাওরের দৃশ‌্যপট। কিশোরগঞ্জ জেলার ১ হাজার ৪৭০ বর্গকিলোমিটার হাওরাঞ্চল। যা মোট আয়তনের অর্ধেকেরও বেশি। মোট ১৩ উপজেলা নিয়ে কিশোরগঞ্জ জেলা।

এর ৯টিই হাওর অধ্যুষিত। ইটনা-মিঠামইন-অষ্টগ্রাম এ তিন উপজেলা শতভাগ হাওরাঞ্চল। যা জেলা শহর থেকে সম্পূর্ণ যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন। আর এ তিন উপজেলার অভ্যন্তরীণ যোগাযোগ ব্যবস্থাকে এক সুতোয় গেঁথেছে ৩০ কিলোমিটারের একটিমাত্র অল-ওয়েদার সড়ক। ২০১৬ সালের ২১ এপ্রিল রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ আনুষ্ঠানিকভাবে ইটনা-মিঠামইন-অষ্টগ্রাম সড়ক প্রকল্পের নির্মাণকাজের উদ্বোধন করেন। ৮৭৪ কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মিত এ সড়কটি নির্মাণ শেষে ২০২০ সালের ৮ অক্টোবর সড়কটি ভার্চুয়ালি উদ্বোধন করেন আওয়ামী লীগ সভানেত্রী ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।

এখন এই সড়ককে ঘিরে হাওরে বর্ষা মৌসুমে ভ্রমণপ্রেমীদের আগমণে দেশ-বিদেশে পর্যটন সম্ভাবনার নতুন দিক উন্মোচন হয়েছে। কিন্তু সারাবছর চলাচলের উপযোগী সড়কটিকে ঘিরে জেলা সদরের সঙ্গে কোনো নিবিড় সর্ম্পক গড়ে উঠেনি। এবার সেই লক্ষ‌্যে হাওরে নির্মাণ করা হচ্ছে উড়ালসড়ক। চার হাজার কোটি টাকারও বেশি ব্যয়ে নতুন এ প্রকল্প নিয়েছে সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয়ের সেতু বিভাগ। পুরো টাকা সরকারের রাজস্ব খাত থেকে ব্যয় করা হবে। প্রাথমিক কাজ অনেকটা এগিয়েও গিয়েছে। এর মধ্যে প্রকল্প এলাকার মাটি পরীক্ষার কাজও শেষ হয়েছে। এবার ভূমি অধিগ্রহণের পালা।

সেতু বিভাগ সূত্র জানা যায়, মিঠামইন সদর থেকে ১৪ কিলোমিটার লম্বা উড়াল সড়কটির কাজ শুরু হবে। মিঠামইনে নির্মাণাধীন সেনানিবাস হয়ে নিকলীর ভাটিবরাটিয়ার ওপর দিয়ে এসে এটি শেষ হবে করিমগঞ্জের মরিচখালী এলাকার খয়রত গ্রামে। আর সেটি প্রশস্ত সড়কের মাধ্যমে সংযুক্ত হবে জেলা সদরের সঙ্গে। এই উড়াল সড়ক নির্মাণে নকশা প্রণয়ন এবং আনুষঙ্গিক অন্যান্য পরিকল্পনা প্রণয়নে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়কে পরামর্শক নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। প্রকল্পের ভূমি অধিগ্রহণ ও পুনর্বাসন পরিকল্পনা বিষয়ে সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয়ের সেতু বিভাগ মঙ্গলবার (৩১ আগস্ট) দুপুরে অংশীজনদের সাথে অনুষ্ঠিত এক অবহিতকরণ সভায় প্রকল্পের বিস্তারিত তুলে ধরা হয়।

করিমগঞ্জের মরিচখালী বাজারে অনুষ্ঠিত এ অবহিতকরণ সভায় কিশোরগঞ্জের জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ শামীম আলমের সভাপতিত্বে এতে প্রধান অতিথি কিশোরগঞ্জ-৩ (করিমগঞ্জ-তাড়াইল) আসনের সংসদ সদস্য এডভোকেট মুজিবুল হক চুন্নু, বিশেষ অতিথি হিসেবে কিশোরগঞ্জ-৪ (ইটনা-মিঠামইন-অষ্টগ্রাম) আসনের সংসদ সদস্য রেজওয়ান আহাম্মদ তৌফিক, সেতু বিভাগের সচিব আবু বকর ছিদ্দীক, প্রধান প্রকৌশলী কাজী মো. ফেরদৌস এবং কিশোরগঞ্জ জেলার পুলিশ সুপার মো. মাশরুকুর রহমান খালেদ বিপিএম (বার) উপস্থিত ছিলেন।

রেজওয়ান আহাম্মদ তৌফিক এমপি বলেন, ‘রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদের ইচ্ছায় ইটনা-মিঠামইন-অষ্টগ্রামের মধ্যে প্রায় ৩০ কিলোমিটার সড়ক নির্মিত হয়। ২০১৬ সালে এটির নির্মাণকাজের উদ্বোধনও করেন রাষ্ট্রপতি। এই সড়কের সঙ্গে কিশোরগঞ্জ ও সারা দেশের সরাসরি সংযোগ স্থাপনের আগ্রহের কথা রাষ্ট্রপতিই জানিয়েছিলেন। এরপরই সেতু বিভাগ উড়াল সড়ক নির্মাণে তৎপর হয়।’ সেতু বিভাগের সচিব আবু বকর ছিদ্দীক বলেন, ‘উড়াল সেতুটি দ্রুত বাস্তবায়নে সরকারের উচ্চপর্যায়ের তাগিদ রয়েছে। মিঠামইন থেকে করিমগঞ্জের মরিচখালীর খয়রত গ্রাম পর্যন্ত মূল উড়াল সেতুটি হবে ১৪ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যের।

প্রকল্পের অধীন মরিচখালি থেকে কিশোরগঞ্জ সদরের নাকভাঙ্গা পর্যন্ত সড়কটি প্রশস্ত করা হবে।’ বুয়েটের প্রকৌশল বিভাগের অধ্যাপক খান এম আমানত বলেন, ‘হাওরে এর আগে যেভাবে সড়ক নির্মাণ করা হয়েছে, তাতে পানির প্রবাহ বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। তাই হাওরে উড়াল সড়ক নির্মাণ করা হচ্ছে। এতে পানির প্রবাহ ঠিক থাকার পাশাপাশি জীববৈচিত্র্যে প্রভাব ফেলবে না। উড়াল সড়কটি নির্মাণে হাওরের জনজীবনের মান উন্নত হবে।