মামুনুর রশিদ মামুন , কুড়িগ্রামঃ চলন্ত ট্রেনে পাথর নিক্ষেপকারীদের কঠোর শাস্তি ও পাথর নিক্ষেপ বন্ধে কার্যকরী পদক্ষেপ গ্রহণের দাবীতে রেল-নৌ, যোগাযোগ ও পরিবেশ উন্নয়ন গণকমিটি, কুড়িগ্রাম হেলমেট পরে ট্রেনে যাত্রা করে এক ব্যতিক্রমী কর্মসূচী পালন করেছে।

মঙ্গলবার (৩০ আগস্ট) সন্ধ্যায় হেলমেট পরে রংপুর এক্সপ্রেসের সংযোগকারী শাটল ট্রেনে চড়ে কুড়িগ্রাম স্টেশন হতে কাউনিয়া স্টেশনের অভিমুখে যাত্রার মাধ্যমে ব্যতিক্রমী এ কর্মসূচীর শুভ সুচনা করা হয়।

রেল-নৌ, যোগাযোগ ও পরিবেশ উন্নয়ন গণকমিটি, কুড়িগ্রাম জেলা শাখার সদস্য সচিব শামসুজ্জামান সরকার সুজা জানান-জনপ্রতিনিধি, ছাত্র, শিক্ষক, শিল্পী, সাংবাদিক, চিকিৎসক, শ্রমিক, রাজনৈতিক কর্মী ও স্বেচ্ছসেবকসহ বিভিন্ন শ্রেণি পেশার মানুষের সমন্বয়ে গঠিত গণকমিটির ২০ সদস্যের একটি দল চলন্ত ট্রেনে পাথর নিক্ষেপকারীদের কঠোর শাস্তি ও পাথর নিক্ষেপ বন্ধে কার্যকরী পদক্ষেপ গ্রহণের দাবীতে হেলমেট পরে ট্রেনে যাত্রার ব্যতিক্রম এ কর্মসূচীতে অংশ নেন।

অংশগ্রহণকারী দলের সদস্যরা হলেন, দৈনিক মানবকন্ঠ পত্রিকার জেলা প্রতিনিধি মনোয়ার হোসেন লিটন, প্রতিদিনের সংবাদ পত্রিকার জেলা প্রতিনিধি রাজু আহমেদ, সহকারী অধ্যাপক আব্দুল কাদের ও শফিকুল ইসলাম, এপার-ওপার বাংলার জনপ্রিয় ভাওয়াইয়া শিল্পী ও কুড়িগ্রাম সদর উপজেলা আ’লীগের সাংস্কৃতিক সম্পাদক শফিকুল ইসলাম শফি, স্থানীয় ইউপি সদস্য আলমগীর কবীর, আওয়ামী লীগ নেতা সোলজার হোসেন ও আব্দুল গফুর, শ্রমিক মুকুল হোসেন ও জিয়াউর রহমান জিয়া, পল্লী চিকিৎসক আবুল কালাম আজাদ, স্বেচ্ছাসেবক আব্দুল আউয়াল, লিটন ও রওশন, শিক্ষার্থী আল আমিন ও মাহফুজ, রাজারহাট গণকমিটির সাধারণ সম্পাদক খন্দকার আরিফ প্রমুখ।

আন্দোলনকারী দলটি হেলমেট পরে কুড়িগ্রাম স্টেশন হতে শাটল ট্রেনে চড়ে কাউনিয়া স্টেশনে পৌঁছার পর প্লাটফরমে গণকমিটির সাবেক সহ-সভাপতি আব্দুল কাদেরের সভাপতিত্বে পথসভা করেন। পথসভায় বক্তব্য রাখেন, আবুল কালাম আজাদ, শিল্পী শফি, খন্দকার আরিফ প্রমুখ।

বক্তারা বলেন, গভীর রাতে শিশু-কিশোররা ট্রেনে ঢিল ছুড়তে পারে না। এটা ট্রেন যাত্রায় যাত্রীদের নিরুৎসাহীত করতে ট্রেনের বিপরীতে যারা ব্যবসা করে তাদের কারো না কারো পরিকল্পিত ষড়যন্ত্র। তাই পাথর নিক্ষেপে জড়িতদের খুঁজে বের করে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি ও পাথর নিক্ষেপ বন্ধে কার্যকরী ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য রেলকর্তৃপক্ষের প্রতি জোর দাবী জানান তারা।

দেশে নিরাপদ যাত্রার প্রধানতম মাধ্যম বাংলাদেশ রেলওয়ে। ট্রেনযাত্রা মানে তুলনামূলক আরামদায়ক ও নিরাপদ ভ্রমণ। তাছাড়া ট্রেনের ভাড়াও সাশ্রয়ী। কিন্তু এ নিরাপদ ভ্রমণ যেন অনিরাপদ হয়ে উঠেছে। বিশেষ করে পাথর নিক্ষেপ এখন মূর্তিমান আতঙ্ক। চলন্ত ট্রেনে পাথর নিক্ষেপের ঘটনা দেশে নতুন নয়। সম্প্রতি এই প্রবণতা আরও বেড়েছে।

নিক্ষিপ্ত পাথরের আঘাত থেকে সাধারণ যাত্রীর পাশাপাশি রেল কর্মকর্তা, নিরাপত্তাকর্মী ও পুলিশ কেউই রেহাই পাচ্ছেন না। আহত হচ্ছেন অনেকে। কেউ পঙ্গুত্ববরণ করছেন। আবার প্রাণহানির মতো ঘটনাও ঘটছে। ট্রেনেরও ক্ষতি হচ্ছে।

বিশেষকরে প্রতিনিয়ত ভাঙছে জানালার কাচ। অথচ আমাদের পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতে প্রতিদিন অসংখ্য ট্রেন নিরাপদে বিভিন্ন প্রদেশে আসা–যাওয়া করে। এক প্রদেশ থেকে সকালে ট্রেনে উঠে অফিস শেষ করে ট্রেনেই নিরাপদে বাড়ি ফেরেন অনেক মানুষ।

উল্লেখ্য, গত বছরের ১৫ আগস্ট নীলফামারীর সৈয়দপুরে পাথরের আঘাতে পাঁচ বছর বয়সী শিশু আজমির ইসলামের একটি চোখ নষ্ট হয়ে যায়।

২০১৯ সালে জাতীয় সংসদের স্পিকার শিরীন শারমিন চৌধুরীর বগিতেও ছোড়া হয় পাথর। তবে দুর্ঘটনা থেকে রক্ষা পান তিনি।
২০১৮ সালে খুলনার বেনাপোল রোডে চলন্ত কমিউটার ট্রেনে দুর্বৃত্তদের ছোড়া পাথরের আঘাতে ট্রেনের পরিদর্শক বায়েজিদ গুরুতর আহত হয়ে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান। ২০১৩ সালে চট্টগ্রামের ভাটিয়ারীতে চলন্ত ট্রেনে দুর্বৃত্তের ছোড়া পাথরের আঘাতে নিহত হন প্রকৌশলী প্রীতি দাশ (২৪)।

চলন্ত ট্রেনে পাথর ছোড়ার ঘটনা প্রায়ই ঘটছে কিন্তু নেই কোন প্রতিকার। অবশ্য মাঝে মধ্যে পাথর নিক্ষেপপ্রবণ এলাকাগুলোতে ‘ট্রেনে পাথর ছোড়া হতে বিরত থাকুন, ভ্রমণরত স্বজনদের নিরাপদ রাখুন’ এ প্রতিপাদ্য নিয়ে রেল কর্তৃপক্ষকে মাইকিং ও লিফলেট বিতরণসহ বিভিন্ন প্রচার-প্রচারণা চালাতে দেখা যায়। অথচ ট্রেনে পাথর নিক্ষেপের মতো জঘন্য অপরাধের ব্যাপারে আইন রয়েছে।

রেলওয়ে আইনের ১২৭ ধারা অনুযায়ী ট্রেনে পাথর নিক্ষেপ করা হলে সর্বোচ্চ যাবজ্জীবন কারাদণ্ডসহ ১০ হাজার টাকা জরিমানার বিধান রয়েছে। এছাড়াও পাথর নিক্ষেপে আঘাতপ্রাপ্ত হয়ে কারও মৃত্যু হলে ৩০২ ধারা মোতাবেক দায়ী ব্যক্তির মৃত্যুদণ্ডেরও বিধান রয়েছে। তবে আইনে শাস্তির বিধান থাকলেও বাস্তবে তেমন কারও শাস্তি হয়েছে- এমন নজির খুব একটা নেই বললেই চলে।

তবে সমাজ ও রাষ্ট্রের কল্যাণে চলন্ত ট্রেনে পাথর নিক্ষেপ রোধে পরিবার, প্রশাসন, জনপ্রতিনিধি ও রাজনীতিবিদসহ সবাইকে এগিয়ে আসতে হবে। পাশাপাশি আইনের সঠিক প্রয়োগ নিশ্চিত করতে হবে।