দেশে ৮০০ কোটির দেনা আরব আমিরাতে ব্যবসা শুরুর পরিকল্পনায় মোঃ আলী।

সুমনসেন চট্টগ্রাম জেলা প্রতিনিধি-

চট্টগ্রামের শীর্ষ ঋণখেলাপিদের অন্যতম হলেন ইমাম গ্রুপের মোহাম্মদ আলী। ১৫টি ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের পাওনা খেলাপি ঋণের পরিমাণ দাড়িয়েছে ৭৯৩ কোটি টাকা। খেলাপি ঋণ আদায়ের জন্য ইমাম গ্রুপের বিরুদ্ধে অর্থঋণ আদালতে বেশিরভাগ মামলা হয়েছিল ২০১২- ১৩ সালে।

অর্থঋণ ও এন আই অ্যাক্ট মিলিয়ে মোঃ আলীর প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে কমপক্ষে ৬০ টি মামলা রয়েছে বলে জানা যায়। এসব মামলায় গ্রুপটির কাছে ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের ৭৯৩ কোটি টাকা। মোহাম্মদ আলীর বিরুদ্ধে গত বছরের মাঝামাঝি সময় থেকে মোট ৫৫ টি মামলায় গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি হয়। বিভিন্ন ব্যাংকের দায়ের করা এসব মামলায় গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারির পর গোপনে আরব আমিরাতে পালিয়ে গেছেন চট্টগ্রামের মোহাম্মদ আলী। তার কাছে ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান গুলোর পাওনা খেলাপি ঋণের পরিমাণ প্রায় ৮০০ কোটি টাকা। সম্প্রতি নগরীর আগ্রাবাদ হোটেলে ছোট ছেলের জাকজমকপূর্ণ বিয়ের অনুষ্ঠান হলেও তিনি দেশে আসেননি। দুবাইয়ে কেনা নিজস্ব ফ্ল্যাটে থাকেন তিনি। আরব আমিরাতে ব্যবসা শুরুর পরিকল্পনাও করছেন বলে জানা যায়।

এদিকে ইমাম বাটন ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেডের চেয়ারম্যান জেবুন্নেসা আক্তার, ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোহাম্মদ আলী, পরিচালক লোকমান চৌধুরী ও হামিদা বেগমের দেশত্যাগে নিষেধাজ্ঞা চেয়েছে পুঁজিবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি)। এ বিষয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগের (সিআইডি) অতিরিক্ত মহাপরিদর্শককে (এআইজি) চিঠি দিয়েছে কমিশন।

বিএসইসির পরিচালক রিপন কুমার দেবনাথ স্বাক্ষরিত অতীব জরুরি চিঠিটি ৬ ডিসেম্বর সিআইডির কাছে পাঠানো হয়েছে। পাশাপাশি বাংলাদেশ স্থলবন্দর কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান, শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর, শাহ আমানত আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর ও ওসমানী আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের পরিচালক (ইমিগ্রেশন) এবং সব স্থলবন্দরে চিঠির অনুলিপি পাঠানো হয়েছে।

সুত্রে জানা যায়, গত বছরের মাঝামাঝি সময় থেকে বিভিন্ন ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের দায়ের করা মামলায় গ্রুপের মালিক মোহাম্মদ আলীর বিরুদ্ধে একের পর এক গ্রেপ্তারি পরোয়ারা জারি হতে থাকে। এছাড়া গত বছর একটি ব্যাংক ও লিজিং কোম্পানির দায়ের করা মামলায় এক বছরের সাজা হয় মোহাম্মদ আলীর বিরুদ্ধে। রায়ের পর কয়েক মাস নগরীর লাভ লেইনে এক ব্যবসায়িক পার্টনারের বাসায় গা ঢাকা দিয়েছিলেন মোহাম্মদ আলী। এরপর জানুয়ারিতে আরব আমিরাতে পালিয়ে যান তিনি। এরমধ্যে ব্যাংক এশিয়ার দুটি চেকের মামলায় এক বছরের সাজা ও সম পরিমাণ (১৫ কোটি টাকা) অর্থদণ্ড করে আদালত।

ইমাম গ্রুপের ব্যবসা এখন দেখভাল করছেন তার বড় ছেলে আলী ইমাম মুন্না। দুবাই থাকা বাবার পরামর্শ নিয়েই তিনি ব্যবসা পরিচালনা করছেন বলে সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন। সপ্তাহ খানেক আগেও বাবার সাথে দেখা করে দেশে ফিরেছেন তিনি। আলী ইমাম মুন্নার মুঠোফোনে একাধিক বার ফোন করলেও তিনি ফোন ধরেননি।

এক সময় ন্যাশনাল ক্রেডিট এন্ড কমার্স ব্যাংকের (এনসিসি) পরিচালনা পর্ষদের সদস্য ছিলেন মোহাম্মদ আলী। এই পরিচয়ে বিভিন্ন ব্যাংক থেকে সহজেই ঋণ সুবিধা নিতেন তিনি। পরে ব্যাংকে তার শেয়ারের পরিমাণ ২ শতাংশের নিচে নেমে যাওয়া এবং বিভিন্ন ব্যাংকে ঋণখেলাপি হয়ে পড়ায় এনসিসির পর্ষদ থেকে তাকে বাদ দেয়া হয়।
নব্বইর দশকে অবৈধ পথে পণ্য আমদানি করে ব্যবসার জন্য চট্টগ্রামে তিনি ব্ল্যাকার মোহাম্মদ আলী নামে পরিচিতি পান। এর আগে চট্টগ্রামের খাতুনগঞ্জ-টেরিবাজার এলাকায় বিভিন্ন দোকানের কর্মচারী হিসেবে কাজ করতেন তিনি।
নব্বইয়ের দশকে খাতুনগঞ্জের ভোগ্যপণ্যের বাজারের অনেকটাই নিয়ন্ত্রণ করতো ইমাম ট্রেডার্স। পরে গ্রুপের ব্যবসা সম্প্রসারণ হয় গার্মেন্টস, যন্ত্রপাতি আমদানিসহ নানা খাতে। এসব খাতে বিনিয়োগের জন্য বিভিন্ন ব্যাংক থেকে নেয়া ঋণের বেশিরভাগ বিনিয়োগ হয়েছে জমি কেনায়।

২০১০ সালের পর থেকে ভোগ্যপণ্য ও ভূমি ব্যবসায় লোকসান শুরু হলে প্রতিষ্ঠানটিতে বিনিয়োগ করা বিভিন্ন ব্যাংকের বিপুল পরিমাণ ঋণ আটকে যায়। ভোগবিলাসেও প্রচুর টাকা ব্যয় করতেন মোহাম্মদ আলীসহ তার পরিবারের সদস্যরা।
অর্থঋণ আদালতে মামলা দায়েরের পর উচ্চ আদালত থেকে স্থিতাদেশ নিয়ে অর্থ পরিশোধ না করেই বছরের পর বছর কাটিয়ে দিয়েছেন মোহাম্মদ আলী।

ইমাম গ্রুপের কাছে সবচেয়ে বড় অংকের টাকা আটকে গেছে ন্যাশনাল ব্যাংকের (এনবিএল)। গ্রুপের প্রতিষ্ঠান মাস্টার ট্রেডিংয়ের কাছে ব্যাংকটির আগ্রাবাদ শাখার পাওনা প্রায় ১৮৬ কোটি টাকা। ঋণ আদায়ে প্রতিষ্ঠানটির বিরুদ্ধে এনবিএল ২০১২ সালে অর্থঋণ আদালতে মামলা দায়ের করে। আদালত ব্যাংকের পক্ষে রায় দেয়ার পর এখন চলছে টাকা উদ্ধারে জারি মামলা (এক্সিকিউশন কেইস) চলছে। এই মামলার বিরুদ্ধে উচ্চ আদালতে রিট করে স্থিতাবস্থা নিয়ে রেখেছে প্রতিষ্ঠানটি।