মেহেদী হাসান, রবি প্রতিনিধি: চৈত্রের আলো নিভে ভোরের নতুন সূর্যের অপেক্ষায় কোটি বাঙালির প্রাণ; ১৪৩১ বঙ্গাব্দের প্রথম প্রভাতে জীর্ন-মলিন অতীত আর কূপমণ্ডুকতা ঝেড়ে ফেলে মানবের জয়গানে বাজছে বর্ষবরণের সুর।
অতীতের সকল ব্যর্থতা, গ্লানি মুছে ফেলার প্রত্যয়ে সমবেত কণ্ঠে ধ্বনিত হচ্ছে- ‘এসো হে বৈশাখ, এসো এসো…।’
বিশ্বব্যাপী মূল্যবোধের ক্ষয় আর মানুষে মানুষে দূরত্ব ঘুচিয়ে সম্প্রীতির সাধনায় বাঙালি মনুষ্যত্বের জয়গান বাজছে শাহজাদপুরে বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের নামে প্রতিষ্ঠিত রবীন্দ্র বিশ্ববিদ্যালয়ে। নতুন বছরের প্রথম সকালে, নতুন দিনের প্রত্যয় আর অশুভ শক্তির বিরুদ্ধে লড়াই জারি রাখার বলিষ্ঠ উচ্চারণে ১৪৩১ বঙ্গাব্দকে বরণ করে নিয়েছে রবীন্দ্র বিশ্ববিদ্যালয়।
সকাল সাড়ে দশটায় রবীন্দ্র বিশ্ববিদ্যালয়ের একাডেমিক ভবন-৩ থেকে শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা রবীন্দ্র বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য প্রফেসর ড. মো: শাহ্ আজমের নেতৃত্বে বর্ণাঢ্য মঙ্গল শোভাযাত্রা আরম্ভ হয়। শোভাযাত্রাটি শাহজাদপুরের প্রধান সড়কসমূহ প্রদক্ষিণ করে। বর্ষবরণের দ্বিতীয় অংশে ছিল অতিথিবর্গের সাথে রবীন্দ্র উপাচার্য শাহ্ আজমের সাংস্কৃতিক বিনিময় ও বাঙালির ঐতিহ্যবাহী খাবার পরিবেশন।
নববর্ষের দিনব্যাপী উৎসবের উদ্বোধন করে রবীন্দ্র উপাচার্য শাহ্ আজম বলেন,” দীর্ঘকাল ধরে নববর্ষ পালনের বাঙালি সংস্কৃতিটি একটি অসাম্প্রদায়িক উৎসব হিসাবে পালিত হয়ে এসেছে। তারপর অশুভ রাজনীতির লক্ষ্য পূরণ করতে আইয়ুব খান এদেশের মানুষের মধ্যে সাম্প্রদায়িক বিভেদ তৈরির জন্য বাঙালির সাংস্কৃতিক আয়োজনকে হিন্দু সংস্কৃতি বলে প্রচার করে বিভেদের দেয়াল তুলতে চেয়েছিলো। ভারতবর্ষে উপনিবেশিক শাসনামলেও এই কাজটি অন্যভাবে করার চেষ্টা করেছিলো ভারতের ব্রিটিশ শাসকেরা। ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনকে দুর্বল করার জন্য বিভাজন নীতি প্রয়োগ করে উপনিবেশিক ইংরেজ শাসকবর্গ। এসব কাজে সমাজে ভাঙন তৈরির জন্য সুবিধালোভী মোল্লা ও পুরোহিতদের মাধ্যমে ঐক্যবদ্ধ বাঙালিকে বিভাজিত করার চেষ্টা করা হয়েছে। সরল বাঙালির প্রকৃত ধর্মচর্চার সীমাবদ্ধতাকে পুঁজি করে একদিকে মনস্তাত্ত্বিক ভাঙন তৈরি করা হয়েছে, অন্যদিকে তাদের আচরণে নিজ নিজ ধর্মের সৌন্দর্য কালিমালিপ্ত হয়েছে। পাকিস্তানি স্বৈরশাসক আইয়ুব খান ছিলেন ইংরেজদের এই উপনিবেশিক মানসিকতার উত্তরাধিকার।
ভাষা আন্দোলনের সাফল্যের ফলে পাকিস্তানি শাসকদের উর্দু চাপিয়ে দেওয়ার ষড়যন্ত্র বাস্তবায়িত হয়নি। তবুও হাল ছাড়েননি আইয়ুব খান। আবার ধর্মকে অপব্যবহার করে বিভ্রান্ত করতে চেয়েছেন বাঙালি মুসলমানকে। প্রচার করার চেষ্টা করেছেন বাংলা ‘হিন্দুর’ ভাষা আর উর্দু ‘কুরআনের’ ভাষা বলে। উনিশ শতকে হিন্দু সমাজপতিরা ব্রাহ্ম আদর্শের অনুসারীদের হিন্দু বলে মানতে চায়নি।
সেই ব্রাহ্ম পরিবারে জন্ম নেওয়া কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে পূর্ব পাকিস্তানে নিষিদ্ধ করার চেষ্টা করা হয়েছিল। এভাবে বাঙালি সংস্কৃতির ওপর আঘাত হানার আরেক অশুভ চেষ্টা দেখেছিলেন এদেশের সংস্কৃতিকর্মীরা। প্রতিবাদে ঢাকায় প্রতিষ্ঠিত হয় ছায়ানট। প্রতিবাদ হিসাবে রবীন্দ্র সংগীত ‘এসো হে বৈশাখ’ গানের সুরমূর্ছনা দিয়ে শুরু হয় বাঙালির নববর্ষ পহেলা বৈশাখ পালনের প্রথম প্রহর।
মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে অর্জিত স্বাধীন বাংলাদেশে পরাজিত শক্তিগুলো হাতগুটিয়ে বসে নেই। যুগ যুগ ধরে বাঙালি হিন্দু-মুসলমান অসাম্প্রদায়িক চেতনায় ঐক্যবদ্ধভাবে বাঙালি সংস্কৃতি লালন করে এসেছে। এর ভেতর অন্ধকার ছুড়ে দেওয়ার জন্য আইয়ুব খানের প্রেতাত্মারা হঠাৎ অতি ধর্মপ্রেমী সাজতে, ধর্মের নামে বাংলাদেশের সরল ও প্রকৃত ধার্মিক মানুষদের অপপ্রচারের মাধ্যমে বিভ্রান্ত করেছে।
পহেলা বৈশাখ ঘিরে যেসব আনুষ্ঠানিকতা রয়েছে তা সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি গড়ে তুলতে সাহায্য করেছে যুগ যুগ ধরে। বাংলা নববর্ষ উদযাপনকে সংকীর্ণ সাম্প্রদায়িক দৃষ্টিতে দেখা সমীচীন হবে না। এখানে বিশেষ কোনো ধর্মসম্প্রদায়ের সংস্কৃতির প্রতিফলন নেই, বরঞ্চ এর পুরোটাই সম্প্রদায় নির্বিশেষে একটি অভিন্ন বাঙালি সংস্কৃতি।
রবীন্দ্র উপাচার্য প্রফেসর শাহ্ আজম উল্লেখ করেন, পহেলা বৈশাখ উৎসবের অনিবার্য অনুষঙ্গ মঙ্গল শোভাযাত্রা। মঙ্গল শোভাযাত্রার সাংস্কৃতিক সৌন্দর্যের আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি মিলেছে। এটি ইউনেস্কো কর্তৃক বিশ্ব ঐতিহ্যের অংশ হিসাবে যুক্ত হয়েছে। বাঙালি হিসেবে এটি আমাদের জন্য গর্বের এবং পরমানন্দের।
উৎসবে শিক্ষক-শিক্ষার্থীসহ স্থানীয় সুধীজন অংশ নেন। উপস্থিত ছিলেন রবীন্দ্র বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতির সভাপতি ড. ফখরুল ইসলাম সহ বিভাগ সমূহের চেয়ারম্যানবৃন্দ। আলোচনা অনুষ্ঠান শেষে রবীন্দ্র বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের অংশগ্রহণে পরিবেশিত হয় মনোমুগ্ধকর সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান।
দৈনিক কলম কথা সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।