বিভিন্ন টেন্ডার ও শিক্ষক -কর্মকর্তা নিয়োগে পছন্দসই লোককে সুবিধা পাইয়ে দিতে উপাচার্যের সাথে ঔদ্ধত্যপূর্ণ আচরণের পর এবার কোষাধ্যক্ষকে হেনস্তার অভিযোগ উঠেছে কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ের শাখা ছাত্রলীগের সভাপতি ইলিয়াস হোসেন সবুজের বিরুদ্ধে।
রোববার (২১ আগস্ট) বিশ্ববিদ্যালয়ের কোষাধ্যক্ষ অধ্যাপক ড. আসাদুজ্জামান এর কার্যালয়ে অনুমতি ছাড়া ঢুকে ইলিয়াস বেপরোয়াভাবে আচরণ করেন এবং নিজের পছন্দের লোককে টেন্ডার দিতে কোষাধ্যক্ষকে চাপ প্রয়োগ করেন।
কোষাধ্যক্ষের দপ্তর ও বিভিন্ন প্রশাসনিক কর্মকর্তা সূত্রে জানা যায়, বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থ কমিটির মিটিং শেষে দুপুর সোয়া দুইটায় কোষাধ্যক্ষ নিজ কক্ষে খাবার খেতে বসেন। এসময় কুবি শাখা ছাত্রলীগ সভাপতি ইলিয়াস অনুমতি ছাড়াই কোষাধ্যক্ষের কক্ষে প্রবেশ করে কোষাধ্যক্ষকে বিভিন্ন কাজের জবাবদিহিতা করতে বলেন। সাথে ক্যাম্পাস নেটওয়ার্কিংয়ের (ওয়াইফাই) প্রায় ২ কোটি ২০ লক্ষ টাকার প্রকল্পের টেন্ডার নিজের পছন্দের লোককে দেয়ার কথা বলেন।
- অভিযোগ উঠেছে, টেন্ডার চেয়ে কোষাধ্যক্ষের কাছ থেকে প্রত্যাশিত উত্তর না পেয়ে ইলিয়াস উত্তেজিত হয়ে উঠেন। কোষাধ্যক্ষকে বলতে থাকেন, বিশ্ববিদ্যালয় যেভাবে খুশি চালাচ্ছেন। শেখ হাসিনা হলের আসবাবপত্রের জন্য আগের ঠিকাদারকে বাদ দিয়ে নতুন ঠিকাদার দিয়ে কাজ করিয়েছেন, এখানে দুর্নীতি করেছেন।
এদিকে বাগবিতণ্ডা শুরুর প্রায় বিশ মিনিট পর দুইটা চল্লিশের দিকে পূর্বনির্ধারিত মিটিংয়ের জন্য কোষাধ্যক্ষের কক্ষে উপস্থিত হন অর্থ ও হিসাব দপ্তরের পরিচালক কামাল উদ্দিন ভূইয়া, একই দপ্তরের উপ-পরিচালক মো. নাছির উদ্দিন, অধিকতর উন্নয়ন প্রকল্প পরিচালক মো. দেলোয়ার হোসেন, তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী এস. এম. শহিদুল ইসলাম, আইসিটি সেলের সিনিয়র প্রোগ্রামার মোহাম্মদ নাছির উদ্দিন ও পরিকল্পনা ও উন্নয়ন দপ্তরের সহকারী পরিচালক রিয়াজুল জান্নাত। তারা এসেও কোষাধ্যক্ষ ও ইলিয়াসের মাঝে কথাকাটাকাটি দেখতে পান। এসময় ইলিয়াসকে তারা শান্ত হতে বলেন। তাদের সবার সাথে যোগাযোগ করা হলে তারা বিষয়টি নিশ্চিত করেন ও বলেন, আমরা ইলিয়াসকে শান্ত হতে বলি বারবার, কিন্তু ইলিয়াস বেশ উত্তেজিত অবস্থায় ছিল।
অধিকতর উন্নয়ন প্রকল্প পরিচালক (চলতি দায়িত্ব) মো. দেলোয়ার হোসেন বলেন, ‘বিভিন্ন টেন্ডার, আসবাবপত্র নিয়ে বাগবিতণ্ডা হচ্ছিলো। ইলিয়াস বলতেছিল শেখ হাসিনা হলের আসবাবপত্র নিয়ে দুর্নীতি হয়েছে। কিন্তু বন শিল্প উন্নয়ন কর্পোরেশন সরকারি প্রতিষ্ঠান। কোনো ব্যক্তি মালিকানার নয়। এখানে টাকা এদিক-সেদিক করার সুযোগ নেই।’
তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী এস. এম. শহিদুল ইসলাম বলেন, ‘আমি একটু দেরিতে রুমে ঢুকেছিলাম, তখন দেখলাম কথাকাটাকাটি চলছে, সম্ভবত কোনো টেন্ডার নিয়ে কথাকাটাকাটি হচ্ছিলো।’
অর্থ ও হিসাব দপ্তরের উপ-পরিচালক মো. নাছির উদ্দিন বলেন, ‘স্যারের সাথে আমাদের একটা মিটিং ছিল বিভিন্ন কাজের। আমরা গিয়ে দেখলাম বিভিন্ন বিষয় নিয়ে কোষাধ্যক্ষের সাথে ইলিয়াসের কথা কাটাকাটি হচ্ছিলো। পরিস্থিতি স্বাভাবিক না থাকায় আমাদের মিটিংটি আর হয়নি।’
এসব ব্যাপারে বিশ্ববিদ্যালয়ের কোষাধ্যক্ষ অধ্যাপক ড. মো. আসাদুজ্জামান বলেন, ‘ইলিয়াস আমার রুমে খুবই আক্রমণাত্মকভাবে এসে আমাকে বিশ্ববিদ্যালয়ের হলের ওয়াইফাইয়ের জন্য নেটওয়ার্কিংয়ের টেন্ডার তার সুপারিশকৃত কোম্পানিকে দেয়ার কথা বলতে বলে। কিন্তু বিষয়গুলো একটা কমিটির মাধ্যমে নির্ধারণ করা হয়েছে, তার কথামতো তো আর সব হবে না। সে আমার সাথে এমনভাবে কথা বলেছে যা একজন শিক্ষার্থী হিসেবে কাম্য নয়।’
তিনি আরও বলেন, ‘ইলিয়াস আমাকে হুমকি ও ব্ল্যাকমেইল করে এই বলে যে, আমরা প্রশাসন নাকি টাকা খেয়ে আমাদের পছন্দের কোম্পানিকে টেন্ডার দেই। কিন্তু আমি আমার জায়গায় পরিষ্কার। সে আগেও এমন ব্ল্যাকমেইল করেছে, এখনও করতে চাচ্ছে।’
তবে কোষাধ্যক্ষকে হুমকি দেয়ার অভিযোগ অস্বীকার করে শাখা ছাত্রলীগের সভাপতি ইলিয়াস হোসেন সবুজ বলেন, ‘আমি ট্রেজারারের রুমে অনুমতি নিয়ে গেছি। আমি বলেছি শেখ হাসিনা হল এবং বঙ্গবন্ধু হলের নতুন ভবনের আসবাবপত্র ও ওয়াইফাই সমস্যা দ্রুত সমাধানের জন্য যাকে কাজ দিক দ্রুত দিক। আমি ছাত্র প্রতিনিধি হিসেবে ছাত্র-ছাত্রীর সমস্যা সংক্রান্ত কথা বলেছি।’
নিজের পছন্দের লোকের জন্য টেন্ডার পেতে চাপ দেয়া প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘আমার পছন্দের কাউকে আমি দিতে বলিনি, আমার কোনো কোম্পানির সাথে পরিচয় নেই। উনি উনাদের পছন্দের কাউকে দিতে চেয়েছে সেটা নিয়ে আমি কথা বলেছি। কারণ দুই-তিনটা কোম্পানির মধ্যে যে কোম্পানি সর্বোচ্চ বিট করেছে তাদের কাজ দেওয়া তো অবৈধ, নিয়মের মধ্যে দিলে সবচেয়ে কম যারা তারা কাজ পাবে।’
বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. এ এফ এম আবদুল মঈন বলেন, ‘ওরা চেষ্টা করছে যেন ওদের পছন্দের লোককে দিই। কিন্তু আমরা তো কারো পছন্দের লোককে দিবো না। যথাযথ প্রক্রিয়ায় আমরা দেখবো যৌক্তিক মূল্যে কার সর্বোচ্চ মানের প্রোডাক্ট ও সার্ভিস দেওয়ার সামর্থ্য আছে। বিশ্ববিদ্যালয় চলে সরকারের পয়সায়, বিশ্ববিদ্যালয় চলে ছাত্র-ছাত্রীদের উন্নয়নের জন্য। সেখানে কোনোভাবেই কারো কথায় বা কারো ব্যক্তিগত স্বার্থ রক্ষায় কোয়ালিটি সেক্রিফাইজ করার বিষয় আমরা কনসিডার করবো না। যারাই হুমকি-ধমকি দিক, আমরা গ্রহণ করবো না। এসব ভয়-ভীতি, হুমকি-ধমকি কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ে চলবে না।’
এর আগে, চলতি বছরের ৩১ মার্চ বিভিন্ন ‘অনৈতিক দাবি-দাওয়া’ না মানায় ছাত্রলীগের নেতাকর্মীদের সাথে নিয়ে কুবি উপাচার্য অধ্যাপক ড. এ এফ এম আবদুল মঈনের গাড়ি অবরুদ্ধ করেছিলেন শাখা ছাত্রলীগ সভাপতি ইলিয়াস। পরবর্তীতে ২১ জুলাই বিভিন্ন দাবি-দাওয়া নিয়ে উপাচার্যের দপ্তরে গেলে শাখা ছাত্রলীগ সভাপতির সাথে উপাচার্যের টেন্ডার ও নিয়োগ নিয়ে বাকবিতন্ডা হয়। এক পর্যায়ে উপাচার্য ছাত্রলীগ সভাপতিকে উদ্দেশ্য করে বলেন, ‘তোমরা ছাত্রলীগের চাকরি নেওয়ার জন্য আসছো, তোমরা কন্ট্রাক্টগুলো অফিসিয়ালি দিতে মানা করেছো, আমরা ইজিপিতে কন্ট্রাক্ট দিলে তোমার নাকি ছাত্রলীগের টাকা-পয়সা আসে না, ঈদের সময় টাকার জন্য আসছিলা। পরে আমি তোমাদের একটা কন্ট্রাক্ট দিয়েছিলাম। এই সকল দাবি নিয়ে আসছিলা। এছাড়া অন্য কোন দাবি নিয়ে আসো নাই।’
দৈনিক কলম কথা সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।