বাংলা নববর্ষের তৃতীয় মাসের সপ্তাহান্তে আমার জন্ম। যখন নতুন একটি বাংলা বছর শুরু হয়, আমি সঙ্গোপনে আমার আরও একটি আসন্নপ্রায় জন্মদিনের দিকে তৃষিতের মতো তাকাই। জীবনের শুরুতে এমন ছিল না। বাংলা নববর্ষের সঙ্গে নিজের জন্মদিনের যে অদূরবর্তী একটা সম্পর্ক আছে, তার প্রতি আমার খেয়ালই ছিল না। আমি গ্রামের মানুষ। ছোটবেলায় আমাদের বাড়িতে কারও জন্মদিন পালিত হয়নি কখনো। যদিও আমার বাবা তাঁর সন্তানদের জন্মদিন তিথিনক্ষত্রসমেত নতুন কোনো পঞ্জিকার পাতায় প্রতি নববর্ষেই নতুন করে লিখে রাখতেন। তা ঐ লিখে রাখার মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল। আমার নিজের জন্মদিন সম্পর্কিত সচেতনার শুরুটা আমার সঠিক মনে পড়ে না। শুধু মনে পড়ে যে, বয়োবৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গেই এই সংক্রান্ত সচেতনা আমার মধ্যে বেড়েছে। দুটো কারণে এই সচেতনা এসেছে আমার মধ্যে। আমি কিঞ্চিত কবিখ্যাতি লাভ করেছি ও গত প্রায় ৩৮ বছর ধরে আমি ঢাকায় বসবাস করছি। শহরের মানুষ তার ও তার পরিবারের সকল সদস্যের জন্মদিনকেই গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনায় নিয়ে থাকে। আমার মধ্যে সেই প্রভাবই কার্যকর হয়েছে। গ্রামের মানুষ প্রতিদিন থেকে তার জন্মদিনকে কখনও খুব একটা পৃথক করে দেখে না।
এ সম্পর্কিত সচেতনতা তাদের মধ্যে প্রায় অনুপস্থিতই বলা যায়। তবে সাম্প্রতিককালে এই মুঠোফোনের যুগে শহর ও গ্রামের মানুষের মধ্যকার দূরত্ব অনেকটাই হ্রাস পেয়েছে এবং শিক্ষার বিস্তার ঘটছে বলে, এখন গ্রামের মানুষের মধ্যেও জন্মদিন পালনের প্রতি আগ্রহ বাড়ছে। এটা মন্দ নয়। খুব ভালো। খুব ঘটা করে না হলেও জন্মদিনটিকে অন্যসব দিন থেকে পৃথককরণের এই প্রয়াস আমি খুব সমর্থন করি। মানুষ তার মনুষ্যজন্ম লাভের অপার আনন্দকে যদি ধ্যানীচিত্তে, সানন্দে উপলব্ধি করে, তবে প্রতিটি জন্মদিনেই তার মধ্যে মনুষ্যত্ববর্ধক সদগুণাবলির বিকাশ ও প্রকাশ ঘটবে। নতুন বছরের জন্মদিন আর মানুষের জন্মদিন এই দুয়ের মধ্যে তাই আমি খুব বড় রকমের একটা মিল দেখতে পাই।
প্রতিটি নববর্ষে আমরা যেমন পুরনো বছরের জীর্ণতা ভুলে গিয়ে নতুন আশায়, নতুন প্রত্যয়ে জীবন শুরু করি আমাদের প্রতিটি জন্মদিনে আমাদের জীবনেও কিন্তু সেরকমই কিছু সদর্থক চেতনার স্ফুরণ ঘটে। একটি দিন কেমন করে যেন অন্য সব দিনের থেকে আলাদা হয়ে যায়। তাই পয়লা বৈশাখের সকালের উদিত সূর্যকে আর চিরপুরাতন সূর্যের আকাশে ওঠা বলে আমাদের মনে হয় না। আকাশে নতুন এক সূর্য-ওঠা বলেই মনে হয়। এই মনে হওয়াটার গুরুত্ব অপরিসীম। এই মনে হওয়াটাই বড় কথা। মানুষের জন্মদিনকে আমার মনে হয় পয়লা বৈশাখের মতোই। আমাদের অনেকেরই জন্মদিন আলাদা।
বারো মাসের তিনশ পয়ষট্টিটি দিনের মধ্যে তারা ছড়ানো-জড়ানো। কিন্তু বাংলা নববর্ষের শুরুর দিনটি পয়লা বৈশাখ সকল বাঙালির জন্মদিন। সময় তো সব মিলিয়ে একজন, তাই তার জন্মদিনও এক। ভগবান বা আল্লাহকে আমরা ছোট-বড়, পিতা-পুত্র, মাতা-কন্যা সবাই মিলে একই নামে ডাকি। আমার ভগবান যেমন আমার সন্তানের দাদু-দিদিমা হয়ে যান না, পয়লা বৈশাখও তেমনি। পয়লা বৈশাখ বাঙালির কাছে সেরকমই ঈশ্বরতুল্য। মানুষের যেমন প্রাণ আছে, সচেতনা আছে, আপাতদৃষ্টিতে সেরকম কিছু নেই বলে মনে হলেও আমি মনে করি সময়েরও প্রাণ আছেÑ সেও এক সচেতন সত্তা। তা না হলে তার জন্মদিন নিয়ে মানুষের মধ্যে এত আবেগ, এত উৎসব-উৎসব ভাব আসছে কেন? আসে কী করে? আমাদের উৎসব তৃষ্ণাকে সময়ের কাঁধে চাপিয়ে দিয়ে আমরাই তাঁকে অবিশেষ থেকে বিশেষ করে তুলছি, ব্যাপারটা শুধুই এমন নয়। আমি তা বিশ্বাস করি না বলেই আমি আমার একটি কাব্যগ্রন্থের নাম রেখেছিলাম ‘আমি সময়কে জন্মাতে দেখেছি।’ তার মানে সময়, আমার কাছে এক সপ্রাণ সত্তাবিশেষ। তার জন্ম আছে। আর জন্ম আছে বলে, তার জন্মদিনও আছে।
বাঙালির বিবেচনায় বাংলা সময়ের সেই জন্মদিনটির নামই হচ্ছে- পয়লা বৈশাখ। প্রশ্ন উঠতে পারে, তার জন্মদিন তো পেলাম, তার মৃতুদিন কোনটি? তার কি মৃত্যুদিবস নেই। যার জন্মদিন আছে, আমি সঠিক করে জানি না বলেই তার মৃত্যুদিন নেই- তা আমি বলি কী করে? সে কি চৈত্র-সংক্রান্তি বা ৩১ ডিসেম্বর? পয়লা বৈশাখে বা পয়লা জানুয়ারিতে কি তবে মৃত সময়েরই পুনর্জন্ম ঘটে? পাঠক আমাকে ক্ষমা করবেন, এ আমি সঠিক করে বলতে পারব না। আমি কিছু জানি, কিছু অনুমান করে বলিÑ জন্ম সম্পর্কে কিছু ধারণা থাকলেও সময়ের মৃত্যুদিবস সম্পর্কে আমার কোনো স্পষ্ট ধারণা নেই। অনুমানের সকল শক্তিকে আমার উপলব্ধির মধ্যে জড় করেও আমি তার কাছে পৌঁছাতে পারি না। হয়তো তিনি মৃত্যুহীন, অমর। বা হতে পারে, সমরূপে তিনিই ঈশ্বর।
দৈনিক কলম কথা সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।