রিকশা


সাদেকের শরীর থেকে দড়দড় করে ঘাম বের হচ্ছে। পোলেস্টারের শার্টটি শরীরে লেপ্টে
গেছে। রিকশার পেছনে বসে হস্তী সুলভ যাত্রী ক্রমাগত তাগিদ দিচ্ছে।
মামা তাড়া-তাড়ি চালাও। উফফ আজ সকালে মামী খেতে দেয়নি নাকি? কী কুক্ষণে
যে আজ এই রিকশায় উঠেছিলাম।

যারা রিকশা চালক তাদের নিত্যদিন এমনি কিছু মিষ্টভাষী যাত্রীদের গ্রীতিপ্রদ
শুনতে হয়। তাই সাদেক নিজেকে এখন অনেকটা সহনীয় পর্যায়ে নিয়ে এসেছে।
সে বারবার রিকশার টায়ারের দিকে নজর রাখছে।
আল্লাহ কহন জানি টায়ারটা ফাঁইটা যাই। সিরাজ ভাই ইবার আর থুবি নানে।
সেদিন একবার চাকা লিক হলো বুলে কত কথা শুনাই দিলো। রিকশা ভাড়া দুইশো
টাহা ওইদিন নিলো আড়াইশো টাহা।

এই থাম থাম। কানে কম শুনিস নাকি? ধর তোর ভাড়া।
মামু ভাড়া তো বিশ টাহা!
চুপ থাক বদমায়েশ যা দি”িছ তাই নে। যেভাবে চালায়ছিস ক”ছপের পিঠে
আসলেও এর থেকে দ্রæত আসতাম। আমার বাবুটা কখন থেকে একা বসে আছে।
দিনকাল যা পড়েছে মেয়েলোকের বিশ্বাস নেই। এই বলে রাস্তা কাঁপাতে কাঁপাতে
হস্তীটি সঙ্গিনীর সন্ধানে দৌড় দিলো।
সাদেক মুচকি হেসে অস্ফুট স্বরে বললো,
শুধু মেয়েলোক না দুনিয়ায় এহন কাউরে বিশ্বাস করবার জো নেই। টাকাটা
পকেটে রেখে চাকার দিকে নজর দিয়ে আবার পেডেল ঘোরাতে শুরু করলো।
আজ রোদ খুব কড়া রীতিমতো দম বন্ধ হয়ে আসছে। রিকশায় এখন ইঞ্জিন চালু
হয়েছে। কিš‘ ওই সব রিকশার ভাড়া অনেক বেশি। এত ভাড়া দিয়ে রিকশা নেওয়া তার
পোষাবে না। সাদেক ভাগ্য পরিবর্তনের জন্য গ্রাম থেকে বিভাগীয় শহরে
এসেছিল। কিš‘ ভাগ্য বিধাতা আজও তার উপরে সুনজর দেয়নি। মাঝে মধ্যে সে
মাজারে যায়। সেখানে গিয়ে নিজের ভাগ্য পরিবর্তনের জন্য দীর্ঘ সময় নিয়ে
প্রার্থনা করে। এরপর আক্কাস পীরকে হাদিয়া হিসাবে বেশ কিছু টাকা দেয়।
তাতে লাভের কিছু হয়নি শুধু শুধু টাকাগুলো নষ্ট হয়েছে।
বেলা অনেক হয়েছে এখনো দুপুরের খাবার হয়নি। মহিলা কলেজের সামনে ফুটপাতে
ভাতের নতুন হোটেল হয়েছে এখন। সেখানে অল্প দামে পেট ভরে খাওয়া যায়।

মাস শেষ হয়ে নতুন মাসের অর্ধেক হয়ে গেলো এখনো বাড়িতে টাকা পাঠানো হয়নি।
সাদেক রিকশা চালাতে চালাতে আনমনে এইসব নিয়ে চিন্তা করে,
রেবেকা কিভাবে যে সংসার চালাবে আল্লাহ মাবুদ জানে। পোলাটার নয় বছর বয়স
তারে গ্রীল মিস্ত্রির কাজে দেয়া হয়েছে। মাসে মাসে বেগার খাটিয়ে নেয়।
দশটা টাকা দেয়না হাতে।
জসিম ভায়ের ভাতের হোটেলের সামনে রিকশাটি রেখে সাদেক হাতমুখ ধুয়ে
নিলো।

জসিম ভাই আছেন কেমন?
মোগো আর ভালো থায়া! গরিব মানষের ভালো নাই আছে শুধুই মন্দ।
ক্যান কি হয়ছে?
এই দোহান আর রাখন যাইবো না। তুইলা দিতে হইবো। জাহাঙ্গীর ভাই নতুন পদ
পাইছে। তারে রোজ পাঁচশ টাহা চান্দা দেয়া লাগবো। নাইলে দোহান ভাঙয়া
দিবো। তাছাড়া জিনিস পত্তর যা দাম তাতে আর এই ব্যবসা করোন যাইবোনা।
তেলের দাম দুইশ টাহা কেজি বলেন দেহি কারবার। পুলা ডারে নিয়া এহন যামু
কৈই? খামু কী?
সাদেকের এইসব প্যাচাল ভালো লাগেনা। সে টাকা খরচ করে খেতে এসেছে। কথা
বলা শুরু করলে থামার নাম নাই চলতেই থাকবো। সে বিরক্তি নিয়ে ধমকের সুরে বললো,
গরীব মানষের এই একটাই সমস্যা অধিক কথা বলা। আরে বেটা তুই ওদের বাপ দাদার
জমি বেদখল কইরা ব্যবসা করবি আর টাহা দিবিনা এমনডা হয় নাকি। এহন প্যাচাল
বন্ধ কইরা খাইতে দে। চেয়ারের উপর এক পা উঠিয়ে বেশ আয়েশ করে ভাত খা”েছ
সাদেক।
ওই পি”িছ মরিচ পিঁয়েজ দিয়ে যা।
পিঁয়েজ মরিচ দেওন যাইবো না ওমনেই খান। রাঁধতে পারিনা মরিচের অভাবে উনি
আইছে পিঁয়েজ মরিচ খাইতে।
রাগে সাদেকের পুরো শরীর শিরশির করে ওঠে। নিজেকে সামলে নিয়ে সে খাওয়াতে
মন দিলো। এই জায়গায় খেতে আসার আর একটা কারণ হ”েছ এখানে সবসময়
মেয়েলোকের আনাগোনায় মুখরিত থাকে। খেতে খেতে তার দৃষ্টি মহিলা কলেজ
গেটে মেয়েদের যাতায়াতের দিকে নিবদ্ধ থাকে। সে তৃপ্ত মনে বলে,
মেয়ে মানুষ দেহনের মধ্যে যে মজা আছে তা দুনিয়ার অন্য কিছু দেহনের মধ্যে
নাই। মিয়া ভাই গোশত রান্ধন ভালো হয় নাই। আজ খাইয়া যুত পাইলাম না।
জসিম বিরস মুখে বললো,

রান্ধনের সময় মন ভালো না থাকলে রান্ধন কি ভালো হয়? আজ সারাদিনে কোন
বেচাবিক্র নাই। একটু পরে বদিয়ার আইবো টাহা লইবার। আজই হয়তো দোহান
তুইলা দেয়া লাগবো।
সাদেক কিছু না বলে হোটেল থেকে বেরিয়ে রাস্তার পাশে গাছের ছায়ায় রিকশার
উপর শুয়ে পুরো দুপুর ঘুমিয়ে কাটালো।
মুখে জর্দা মিশ্রিত পান হাতে জলন্ত সিগারেট। চোখে কালো চশমা। পরনে সাদা
গেঞ্জির সাথে মিল রেখে একই রঙের লুঙ্গি পরে জসিমের দোকানের দিকে বদিয়ার
হাঁটা শুরু করলো। সে এই এলাকার দায়িত্বে আছে। প্রতিদিনের কালেকশন রাতে
জাহাঙ্গীর ভাইয়ের কাছে জমা দিতে হয়। এখান থেকে গোপনে সেও কিছুটা ভাগ
বসায়। তার পাশাপাশি হাঁটছে বিপ্লব জাহাঙ্গীরের যত কুকর্মের স্বাক্ষী এই
দুজন।
বিপ্লব বদিয়ারের দিকে ঘাড় ঘুরিয়ে বললো, আমরা যে এভাবে টাকা সরাই
জাহাঙ্গীর ভাই জানতে পারলে আমাদের আস্ত রাখবে?
বদিয়ার হেঁয়ালি”ছলে বললো, একটু না সরালে এখন আর চলেনা। তুই‘ই বল কি
করিনি মানুষটার জন্য? চাঁদাবাজি থেকে শুরু করে মানুষ খুন কিছুই বাদ
রাখিনি। প্রতি সপ্তাহে মহিলা হোস্টেল থেকে কত নাদুসনুদুস মেয়েদের জোর করে
তুলে নিয়ে গিয়ে জাহাঙ্গীর ভাইয়ের আড্ডা খানায় পাঠিয়েছি। এর থেকে একটু
এঁটোকাঁটাও আমাদের জোটেনি। জাহাঙ্গীর ভাই আমাদের জন্য কি করেছে?
ঘোড়ার আন্ডা! তাই যা করি এটা আমাদের প্রাপ্য এখানে দোষের কিছু নেই।
বদিয়ার হোটেলের সামনে এসে পানের পিচ ফেলে সিগারেটে লম্বা একটা টান
দিয়ে জসিমকে উদ্দেশ্য করে বললো, ওই মিয়া টাকা বের করো। ব্যবসাপাতি দেখছি
ভালোই জমিয়ে বসেছ। টাকা দেয়ার সময় আসলে মুখ ওমন বাংলার পাঁচ কইরা
রাখো ক্যান?
জসিম গুমড়ে কেঁদে ওঠে ভাইজান গো। আইজকা মাফ দেন। এহন কাস্টমার কম
আসে। হাতে একটা টাকাও নাই যা আপনারে দিমু।
রাগে কিড়মিড় করে ওঠে বদিয়ার। সে কিছু করার আগেই বিপ্লব জসিমের বুকে
সজোরে লাথি মারে। ছিটকে পড়ে গিয়ে জসিম বুক ধরে শুয়ে পড়ে। ছোট
ছেলেটি দৌড়ে বাপের মাথার কাছে বসে কাঁদতে থাকে।
আশেপাশে লোকজনের হট্টগোল শুরু হয়। সবাই এদিক সেদিক ছোটাছুটি করতে
থাকে। কিš‘ কেউ বদিয়ার কিংবা বিপ্লবের দিকে এগোতে সাহস পায়না।
বদিয়ার হুঙ্কার দিয়ে বলে, শুয়োরের বা”চা তোরে আজ জবাই করবো। এতবড় সাহস
চান্দা দিবিনা। ওই বিপ্লব চেয়ে কি দেখছিস পোলাডারে ওখান খেকে দূরে নিয়ে
যা। বিপ্লব ছেলেটিকে জাপটে ধরে। ছেলেটি হাতপা ছড়িয়ে কাঁদতে থাকে।

বদিয়ার মাজা থেকে চাপাটি বের করে জসিমের গলা বরাবর চালিয়ে দেয়। ফিনকি
দিয়ে রক্ত বের হতে থাকে। রক্তে একাকার হয়ে যায় বদিয়ারের পুরো শরীর। কোরবানির
গরুর মতো জসিম গোংরাতে থাকে। গলা দিয়ে অদ্ভুত ঘড়ঘড়ে শব্দ বের হতে
থাকে। ছেলেটি হাত পা ছোড়া বন্ধ করে দিয়ে রাজ্যের বিস্ময় নিয়ে বাপের
দ্বিখÐিত শরীরের দিকে অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে।
খুব শান্ত ভাবেই দুজন হোটেল থেকে বের হয়। এমন ভাব করে যেন কিছুই হয়নি।
হট্টগোলে অনেক আগেই সাদেকের ঘুম ভেঙে গিয়েছিলো। সমস্ত অঘটন তার
চোখের সামনে ঘটেছে। ঘুম থেকে উটতে না উঠতেই এমন আকস্মিক ঘটনায়
সে বিহŸল হয়ে পড়ে। বিস্ময়ের ঘোর কাটতে না কাটতেই বিপ্লব তার সামনে
এসে হাজির হয়। সে র্ককশ গলায় বললো,
ওই কুত্তার বা”চা ওমন করে তাকিয়ে কি দেখছিস? হাতে দেখেছিস এটাকি
একদম ভুঁড়িতে ভরে দেবো।
সাদেকের কাছে মনে হলো কথা গুলো অনেক দূর থেকে ভেসে আসছে। তারা দুজনে
রিকশায় উঠে বসলো। সাদেক এবার চাকার দিকে নজর না দিয়ে পেডেল ঘুরাতে
লাগলো।

বদিযারের সাদা কাপড় রক্তে মাখামাখি হয়ে আছে। সে আরও একটা সিগারেট
ধরিয়ে নির্বাক ভঙ্গিতে টানতে লাগলো। বিপ্লব আচমকা বলে উঠলো, কাজটা
বেশি বাড়াবাড়ি হয়ে গেলো না? এবার পুলিশ ধরবে কেস কাচারিতে ফাঁসবো।
বদিয়ার বিকট শব্দে হেঁসে বললো, জাহাঙ্গীর ভাই থাকতে আমাদের কিসের এত ভয়?
সাদেকের চোখ মুখ শক্ত হয়ে গেছে। তাদের দিকে উল্কার বেগে ছুটে আসছে
একটি বাস। সাদেকের মুখের কোনায় হাসির রেখাটি দীর্ঘায়িত হ”েছ। সে
এবার চাকার দিকে নজর দিয়ে গায়ের পুরো শক্তি লাগিয়ে পেডেল ঘোরতে থাকলো।

লেখক- মো. তুহিন হোসাইন
বাংলা বিভাগ,ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়, কুষ্টিয়া।