শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের ‘বিলাসী’ গল্পে বিলাসী নিজেকে বিসর্জন দিয়েছিলো। মৃত্যুঞ্জয়ের মৃত্যুর সাত দিনের মাথায় বিলাসী সাপের বিষ খেয়ে আত্মহত্যা করে। তখনকার সমাজ ব্যবস্থাও আত্মহত্যাকে কখনো প্রশ্রয় দেয়নি। বিলাসী কেন আত্মহত্যা করেছিল সমাজ তার কারণ কখনো খুঁজে বের করবার প্রয়োজনবোধ মনে করেনি। অদ্ভুত সমাজ ব্যবস্থা!
আমার এক সহপাঠী ছিলো। নাম পবিত্র। পবিত্র রায়।তখন সবেমাত্র দশম শ্রেণির ক্লাস করছি আমরা। প্রচন্ড মেধাবী ছিলো সে। প্রতি ক্লাসে এক থেকে পাঁচের মধ্যে রোল থাকতো ওর। একডেমিকের বাইরেও ওর আরও কিছু ভালোগুন ছিলো- কেউ গান করলে মুখ দিয়েই পবিত্র বাজনা যোগ করতে পারতো। এস ডি রুবেল এবং কি প্রয়াত চিত্রনায়ক মান্নার কন্ঠস্বর হুবহু নকল করতে পারতো সে। পবিত্র বড়ো হয়ে বিসিএস এর মাধ্যমে পুলিশ ক্যাডারে যোগদান করতে চেয়েছিলো।আর হয়ে ওঠেনি! একদিন রাতে খবর পেলাম পবিত্র আত্মহত্যা করেছে। খবরটা শুনেই মনটা বিষাদে ভরে গেল। অথচ ওর আত্মহত্যার একদিন আগেই ওর সাথে আমার কথা হলো। হাসি মুখেই কথা বললো পবিত্র। কে জানতো সেই হাসি মুখটার আড়ালেই পবিত্র লুকিয়ে রেখেছিল পাহাড় সম বেদনা! পৃথিবীটা তার কাছে হয়তো বিষিয়ে উঠেছিলো। মুক্তি পেতে চেয়েছিলো পবিত্র। সে আদৌ মুক্তি পেয়েছে কিনা তা আমার জানা নেই!
প্রথম আলোর এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, করোনা কালে গেল এক বছরে সারা দেশে আত্মহত্যা করেছে ১৪ হাজার ৪৩৬ জন নারী পুরুষ। (১৩ মার্চ২০২১) তথ্যটি অবাক করবার মতো। দিনদিন আত্মহত্যার প্রবনতা বেড়েই চলেছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তথ্যমতে প্রতি বছর প্রায় দশ লক্ষ মানুষ আত্মহত্যা করে। আবার মনোবিজ্ঞানীরা বলেছেন, অভিমান এবং হতাশা থেকেই আত্মহত্যার পথ বেছে নেয় অনেকে। এদের মাঝে কিশোর – কিশোরীর সংখ্যা বেশি। গত কয়েক দিনে পত্র – পত্রিকায় প্রকাশিত বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের আত্মহত্যার খবরগুলো চোখে পড়বার মতো। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী ইমরুল কায়েস, পাবনা বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী তাহমিদুর রহমান জামিল, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী মাসুদ আল মাহাদী(অপু), জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী অমিতোষ হালদার, এবং সর্বশেষ বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী তানভীর আলম তুষার পৃথিবীকে বিদায় জানিয়ে চলে গেছে।
অথচ কবি গুরু বলেছেন, মরিতে চাহি না আমি সুন্দর ভুবনে / মানুষের মাঝে আমি বাঁচিবার চাই। প্রকৃতির অপরূপ সৌন্দর্য্যের প্রেমে পড়ে পার্থিব জীবনটাকে অনেকে সুন্দরভাবে উপভোগ করতে চায়। আবার কারোর কারোর কাছে পার্থিব জীবনটা বিষাক্ত হয়ে ওঠে। যে বিষাক্তের বিষ প্রতিটি মুহূর্ত কুড়ে কুড়ে খায় সুন্দর স্বপ্নগুলোকে। তখন নিজেকে হতাশার চাদরে মুড়িয়ে নেয় অনেকে। অন্ধকার আর আলোর মাঝের পার্থক্যটা বুঝতে তাদের অনেক বেগ পেতে হয়। ঠিক তখনই কেউ কেউ মুক্তির পথ বেছে নেয়। পথটি আত্মহত্যা।
আত্মহত্যার কারণ- অভিমান,হতাশা,অতিরিক্ত আবেগপ্রবণ হওয়া,প্রেমে ব্যর্থ হওয়া,জুয়া খেলায় হেরে যাওয়া, মাদকাসক্তি, ইত্যাদি।
আত্মহত্যা প্রতিরোধে করনীয়- সামাজিক সচেতনতা বৃদ্ধি, ধর্মীয় বিধি – বিধান অনুসরণ করা, হতাশাগ্রস্ত মানুষকে চোখে চোখে রাখা কিংবা ভালো কোন মানসিক বিশেষজ্ঞের শরণাপন্ন হওয়া, কেউ মানসিক ভাবে ভেঙে পড়লে তাকে পরিবার থেকে সাপোর্ট দেয়া।
আত্মহত্যা প্রতিরোধে প্রতিবছর ১০ সেপ্টেম্বর বিশ্ব আত্মহত্যা দিবস পালন করা হয়ে থাকে। সুন্দর এই পৃথিবীতে নিজেকে টিকে রাখাই স্বার্থকতা নয়। মানুষ স্বপ্ন দেখুক সু্ন্দরের! হতাশাকে পেছনে ফেলে প্রত্যেকটি মানুষ তার স্বপ্নকে ছুঁয়ে দেখুক। আত্মহননের মধ্যে দিয়ে আর কারোরই স্বপ্ন যেন মরে না যায় সেদিকে নজর দিতে হবে আমার,আপনার, দেশ, সমাজ সকলের!
লেখক – শিক্ষার্থী, ইংরেজি ভাষা ও সাহিত্য বিভাগ, বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়,রংপুর
দৈনিক কলম কথা সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।