ডেভিড অস্টেন জিফোর্ড
অনেক দিন আগে নব্বইয়ের দশকের মাঝামাঝি সময়ে একটা গল্প লিখেছিলাম। ‘কবর ও বিশ্বাসসংক্রান্ত’ নামের ওই গল্পটা বোধ হয় আমার লেখা তৃতীয় গল্প। গল্পটি আছে আমার প্রথম বই ‘দ্রৌপদী ও তার প্রেমিকারা’য়। নিজের লেখা ওই গল্পের কথাটা মনে এলো সন্দেহ শব্দটি নিয়ে ভাবতে গিয়ে। খোদ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যখন সাবেক রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের কবরে কার লাশ আছে, এ নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করলেন, তখন নিজের লেখা ওই গল্পটির কথা মনে পড়ল। গল্পটি ছাপা হয়েছিল আমাদের কয়েকজন মিলে বের করা লিটল ম্যাগাজিন ‘আড্ডারু’র প্রথম সংখ্যায়। সামীম আরা, জাফর আহমদ রাশেদ এবং আমি সম্পাদনা করেছিলাম ওই ম্যাগাজিনটির প্রথম সংখ্যাটি, আমাদের সঙ্গে যুক্ত ছিল লেখক-অলেখক বন্ধু সবাই। তখন আমরা চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ি। থাকতাম চট্টগ্রাম শহরের জাকির হোসেন রোডে। সপ্তাহান্তে নিয়ম করে আড্ডায় বসতাম আমরা। আড্ডা হতো মূলত শাহীনুর রহমান, জাফর এবং আমার বাসায়। অনেক সপ্তাহে আড্ডা চলে যেত পাশের বাসায়। ওই বাসাটি ছিল আমাদেরই বিশ্ববিদ্যালয়ের সেই সময়কার তরুণ শিক্ষক-কবি হোসাইন কবিরের। কবিরা তো প্রতি সপ্তাহেই কোনো না কোনো কবিতা পড়তে পারতেন। ওই আড্ডায় আমি একা গল্প লেখার কসরত করে যাচ্ছিলাম। গল্প খুঁজে বেড়াচ্ছিলাম। গল্প খোঁজার ওই দিনগুলো এবং নিজের লেখা গল্প নিয়ে কথা বলবার আগে আমি সন্দেহ বিষয়ে কিছু কথা বলে ফেলতে চাই। পরে নিজের গল্প নিয়েও কিছু কথা বলব। সন্দেহ শব্দটি আমাদের কাছে এমন অর্থ পেয়েছে, প্রথমে আমি ভেবেছিলাম, সন্দেহ শব্দটি বোধ হয়, আদিবাসীদের ভাষায় পাওয়া যাবে না। আমার আদিবাসী বন্ধুদের সঙ্গে কথা বলতে গিয়ে দেখি, বাংলাদেশের প্রায় আদিবাসীর ভাষাতেই শব্দটি প্রবলভাবে উপস্থিত আছে। তবে তাদের সঙ্গে কথা বলতে গিয়ে বুঝতে পারি, শব্দের কাঠামোতে লুকানো অর্থটি বাঙালির সন্দেহ থেকে স্বতন্ত্র। সন্দেহ বাংলায় নানান মাত্রা পেয়েছে এবং সর্বসাম্প্রতিক রূপটা রাজনৈতিক। এখানেই নোম চমস্কি থেকে ঋণ করে বলি- ‘ভাষা কেবল শব্দের সমাহার নয়, এটি সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যের ধারক, সম্প্রদায় সৃষ্টি ও একীভূতকরণের ইতিহাস।’ চমস্কির ভাষা জ্ঞান নিয়ে সংশয় করার মতো পণ্ডিতের অভাব এই বাংলাতেও রয়েছেন দু-একজন। তাই সবিনয়ে জানিয়ে রাখতে চাই, আমি ভাষাতত্ত্বের অতশত বুঝি না, আমার কাছে চমস্কির খণ্ডিত বাক্যটিই অর্থময় বলে গণ্য হয়েছে। পরীমণিকে বারবার রিমান্ড দেওয়ার ফলে রিমান্ড শব্দটির অর্থবোধকতা নিয়ে মনে যে ধারণা তৈরি হচ্ছিল, তা-ই আমার ‘অল্পবিদ্যা’য় চমস্কি ও সস্যুর ইত্যাদি থেকে ঋণ নিয়ে ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করেছিলাম কয়েকদিন আগে। যখন সত্য বলায় আড়াল তুলতে হয়, মানুষ তখন এমনটাই করে। সুইস ভাষাবিজ্ঞানী ফার্দিনান্দ দ্য সস্যুর প্রথম ভাষাতত্ত্বে নিয়ে আসেন সাইন, সিগনিফায়ার ও সিগনিফাইডের ধারণা। এগুলোর অর্থ হলো কোনো ‘সাইন’ বা ‘চিহ্ন’ আমাদের কী ধারণা দেয়; অর্থাৎ কোনো বস্তুকে দেখে আমাদের মনে কোন অর্থবোধক ভাবনা তৈরি হয়। এটি একটি ‘ত্রিভুজ মডেল’। যেমন- আমরা ‘রিমান্ড’ বলে একটি শব্দ উচ্চারণ করলে, তা দিয়ে যদি একজন পরীমণিকে জিজ্ঞাসাবাদের দৃশ্য দেখি সেটি ‘সাইন’, তা হলে এ দৃশ্যটি মনোজগতে যে ভাবনার জন্ম দেয় তা ‘সিগনিফায়ার’ আর বাস্তবের রিমান্ডটি হবে ‘সিগনিফাইড’। রিমান্ডের শাব্দিক অর্থ জিজ্ঞাসাবাদ। বাস্তবে রিমান্ডে কী হয় তা আমাদের অননুমেয় নয়। পরীমণির রিমান্ড চাওয়া এবং রিমান্ড মঞ্জুর করা আমার কাছে যা সিগনিফাইড করে, তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। সন্দেহ শব্দটির কাঠামোতে যা আছে, কলিম খান দিয়ে ব্যাখ্যা করলে তা থাকে না। আমরা দেখতে পাই, শব্দটির রক্ত-মাংস-মজ্জায় আরও বেশি কিছু লেগে আছে। অথচ এখন যখন শব্দটি নিয়ে ভাবছি, তা আমাকে চন্দ্রিমা উদ্যানের একটা কবরে কার লাশ আছে সেই সংশয় ঘোরে ঠেলে দিচ্ছে। কবর নিয়ে রাজনৈতিক কূটতর্কের আগে এই অভাজনের কবর নিয়ে লেখা গল্পটার গল্প শেষ করে নিই। একদিন প্রায়সন্ধ্যায় বাসায় ফেরার পথে দেখি জাকির হোসেন রোডের পাশের কবরস্থানে বিশাল জটলা লেগেছে। বিষয়টা কী? কৌতূহলী হয়ে এগিয়ে যাই। দেখি এক লোক একটা কবর খুঁড়বার চেষ্টা করছেন। কবরটিতে সদ্য মাটি দেওয়া হয়েছে কাউকে, এটা বুঝতে অসুবিধে হয়নি। খননোদ্যত মানুষটিকে যারা থামাবার চেষ্টা করছেন তারা তার স্বজন। লোকটা কোদাল নিয়ে তেড়েফুঁড়ে আসছেন স্বজনদের দিকে। অবশ্য বেশিক্ষণ পারেননি। ধস্তাধস্তির একপর্যায়ে জ্ঞান হারালেন তিনি। আমার প্রশ্নের উত্তর দেবার মতো অবস্থায় ছিলেন না তার আত্মীয়-স্বজনদের কেউ। তবে তাদের নিজেদের আলাপেই বুঝতে পারলাম, মানুষটি এসেছিলেন কোনো এক সন্দেহের বশে, কবরে শায়িত স্ত্রীর লাশ তুলে দেখবেন বলে। তারপর বোধ হয় তারা থানায় গিয়েছিলেন। কয়েক দিন পর কবরস্থানের পাশের চায়ের দোকানে জিজ্ঞেস করে জেনেছিলাম পুলিশ এসে লাশ তুলে নিয়ে গেছে ওই কবর থেকে। হঠাৎ কবর খোঁড়ার ওই দৃশ্যের অভিঘাতে রচিত হলো আমার গল্প ‘কবর ও বিশ্বাসসংক্রান্ত’। গল্পের আখ্যানটা ভুলতে বসেছিলাম। এখন আবার পড়ে দেখলাম, আমার গল্পে সন্দেহের ভূমিকা গৌণ। বিশ্বাসই ওই গল্পের মূল প্রতিপাদ্য। কলিম নামে এক বর্গাচাষির মারধরে মারা যায় তার স্ত্রী সালেহা। যে এর আগে কখনও তার স্ত্রীর গায়ে ফুলের টোকাটি পর্যন্ত দেয়নি, সেই কলিম একদিন পথে রইসউদ্দিনের সঙ্গে ঝগড়াঝাটি করে। ঝগড়ার কারণ খুব বড় নয়। রইসউদ্দিনের জমি বর্গা নিয়ে চাষাবাদ করে নিজের সংসার চালায় কলিম। চাষের জন্য জমিতে সেচ দিতে হয় এবং নিয়মানুযায়ী সেচের টাকাটা জমির মালিকের দেওয়ার কথা। সেবার রইসউদ্দিন ঘোষণা করেছেন, চাষিকেই দিতে হবে সেচের টাকা। ঝগড়া করতে গিয়ে নিজের ভাগের বর্গা জমি হারায় কলিম। কলিমের কাছে বর্গা দেওয়া জমি রইসউদ্দিন অন্য চাষিদের বিলিবণ্টন করে দেয়। এই যখন অবস্থা তখন বাড়িতে ফিরে দেখে তাদের দুধেল গাইটা মরে পড়ে আছে উঠোনে। মন খারাপ করে ঘরে ঢুকে দেখে স্ত্রী ঘুমাচ্ছে- ‘শুধু এ জন্যই ঘুমন্ত সালেহাকে দেখে, তরকারি পোড়ার কারণ বুঝতে পেরে ক্ষিপ্ত হয়ে উঠতে পারত সে। তদুপরি ঘরে ঢোকার আগে দেখল গরুটা মরে পড়ে আছে উঠোনে। চুলের গোছা মুঠোয় পুরে সালেহাকে বিছানা থেকে টেনে তুলে কলিম। কিছু বুঝতে পারার আগেই আক্রান্ত হলো সালেহা। একটুও কান্না করেনি সে, দাঁতে ঠোঁট কামড়ে সহ্য করছিল নিপীড়ন, কেবল জ্ঞান হারাবার আগে একবার আর্তনাদ করেছিল, যখন প্রবলভাবে কলিম লাথি ছোড়ে তার তলপেটে।’ না, লেখালেখি শুরুর দিনগুলোতেও আমার গল্পের শুরু এমন সাদামাটা ছিল না। শুরু করেছিলাম তিন তিন বার কলিমের একই স্বপ্ন দেখা দিয়ে। কলিম স্বপ্নে দেখে সালেহা তাকে ডাকছে, ‘আপনে অহনঅ আয়লেন না। পোলাডারে লইয়াত আর পারতাছি না।’ জাকির হোসেন রোডের কবরস্থানে একটুখানি সময়ের জন্য দেখা দৃশ্যটি কল্পনা বিস্তারে সহযোগিতা করে আমাকে। কবর নিয়ে মুসলিম সমাজে প্রচলিত বহু বিশ্বাসের কথা লিখেছিলাম আমি ওই গল্পে এবং কবর খোঁড়ায় ব্যর্থ কলিম রাতে বুটের শব্দ শুনে পুলিশ এসেছে বলে সন্দেহ করে- তখন রাত অনেক ঘুমন্ত গ্রামটাকে একটু আগেও মনে হতে পারত মৃত এক জনপদ প্রত্নতাত্ত্বিক গবেষণায় আবিস্কৃত। এখন ঘরে ঘরে বাতি জ্বলে উঠেছে। কয়েক জোড়া বুটের শব্দ গ্রামটাকে জাগিয়ে কলিমের উঠোনে এসে দাঁড়াল। সময় তার অননুমেয়; কিন্তু উঠোনে বুটের শব্দে সে দ্বান্দ্বিক মুহূর্তে প্রবেশিত। টকৃটৃক… র… কুঁউকুঁউ…ঝক…ঝক… ঝ… ক…র… রেলের গাড়ি। অচেনা একটা গুমটি ঘরের কাছে চলতি ট্রেন থেকে লাফিয়ে নামে সে। পালাচ্ছে, পালাচ্ছে, পেছনে ফেলে যায় ছোট একটা গ্রাম, গ্রামের হাট-বাজার। অতঃপর একটা নদী, সাঁতরে পার হয় নদী, ভীষণ কষ্টে পাহাড় ডিঙ্গিয়ে পায় সবুজ অরণ্য। পাঁচ ব্যাটারির টর্চ জ্বলে-নিভে। রাত-দিন; আবার রাত, আবার দিন। নদীর প্রতিটি জলবিন্দুতে, অরণ্যের প্রতিটি বৃক্ষে রূপান্তরিত হয় সে। বহুদিন পর কলিমের মনে পড়ে একবার সালেহা ডেকেছিল তাকে। সালেহা রঙিন সুতায় রঙিন কাঁথা বানাত তাদের অনাগত সন্তানের জন্য। কষ্টটা তীব্রতর হলে সে একটা সুড়ঙ্গ বানাতে বানাতে পৌঁছে যায়, চিনতে ভুল হয় না; কিন্তু শূন্য কবর থেকে অন্য একটা সুড়ঙ্গ চলে গেছে অজানা পথে; যুগপৎ সে আর খলিফা হারুন হাঁটে এ পথে-পদতলে নুড়িপাথর, দু’পাশে পাথুরে দেয়াল। পথটা সরু হতে হতে এক সময় চুলের মতো চিকন এবং বিপজ্জনক হয়ে ওঠে-পুলসিরাত যেন। পরিত্যক্ত কবরকে মাজার বানাবার একটা গল্প আছে সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ্‌র ‘লালসালু’ উপন্যাসে। মজিদ নামে এক ধর্মব্যবসায়ীর গল্প এটি। যে শস্যহীন এক অঞ্চল ছেড়ে আসে গারো পাহাড়ের পাদদেশের একটি গ্রাম মহব্বতনগরে। যে গ্রামের অদূরে বাঁশঝাড়সংলগ্ন জায়গায় ছিল পরিত্যক্ত এক কবর। কবরটি যে কার- গ্রামবাসী তা জানে না, জানার তাগিদও অনুভব করেনি কখনও। লোক জমায়েত করে মজিদ প্রচার করে কবরটি ‘মোদাচ্ছের’ নামে জনৈক পীরের কবর এবং স্বপ্নাদেশে সেই মাজার তদারকির জন্যই তার আগমন এ গ্রামে। জাহেল, বে-এলেম ইত্যাদি তিরস্কার এবং স্বপ্নাদেশের বিবরণ শুনে ভয়ে এবং একইসঙ্গে শ্রদ্ধায় আপ্লুত হয় গ্রামবাসী। জঙ্গলাকীর্ণ কবরটি দ্রুত পরিস্কার করে ঝালরওয়ালা লালসালুতে ঢেকে দেওয়া হয়। কবরটি অচিরেই পরিণত হয় মাজারে, মজিদ হয় তার খাদেম। কেউ সন্দেহ করেনি মজিদকে। একটি কবরকে কেন্দ্র করে মজিদের ফুলেফেঁপে উঠবার গল্প তো বাংলা সাহিত্যের দু-চারটে গল্প উপন্যাস পড়েছেন যারা তাদের সবার জানা আছে। মহব্বতনগরের কেউ টালখাওয়া ভাঙা এক প্রাচীন কবরকে মোদাচ্ছের পীরের মাজার হিসেবে মেনে নিতে সংশয় করেনি। বরং দ্রুতই জঙ্গল পরিস্কার হয়। প্রাচীন সেই কবর নতুন রূপ ধারণ করে। মাজার ব্যবসায় মজিদের হয় বিত্তবৈভব। উপন্যাসের বর্ণনায় ‘নিরাকপড়া শ্রাবণের সেই হাওয়া-শূন্য স্তব্ধ দিনে তার জীবনের যে নতুন অধ্যায় শুরু হয়েছিল, মাছের পিঠের মতো সালু কাপড়ে আবৃত নশ্বর জীবনের প্রতীকটির পাশে সে জীবন পদে পদে এগিয়ে চলল।’ সন্দেহ শব্দটিও অন্য সব শব্দের মতো একটি প্রতীক। তবে শব্দ সবসময় এই প্রতীক মূর্ত করে না। সন্দেহ নিয়ে কথা বলতে গিয়ে আমার কাছে জীবন নয়; জীবনের সঙ্গে প্রেম-ভালোবাসা, ঈর্ষা-সন্দেহ যা একাকার হয়ে জড়িয়ে আছে, তা-ও নয়, মনে এলো একটা কবরের কথা। বোধ হয়, রাজনীতি যখন কবর নিয়ে ব্যস্ত তখন আমার একার নয়, সবারই মনে আসবে চন্দ্রিমা উদ্যানে কবরটিতে কার লাশ এ নিয়ে সন্দেহের কথা। এই সেদিন আগস্টের ২৬ তারিখে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা চন্দ্রিমা উদ্যানে বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা জিয়াউর রহমানের কবর নেই, তারপরও দলটির নেতাকর্মীরা সেখানে গিয়ে বিশৃঙ্খলা করে বলে মন্তব্য করেছেন। আগস্ট তো বাঙালির জীবনে শোকের মাস। ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানসহ তাঁর পরিবারের উপস্থিত সব সদস্যকে হত্যা করা হয়েছিল।
জীবনানন্দ দাশ তাঁর ‘তবু’ কবিতায় লিখছেন- ‘সে অনেক রাজনীতি রুগ্ন নীতি মারী/ মন্বন্তর যুদ্ধ ঋণ সময়ের থেকে/ উঠে এসে এই পৃথিবীর পথে আড়াই হাজার/ বছরে বয়সী আমি।’ আততায়ী তাঁর দিকে ধেয়ে আসছে, এ সন্দেহ করতে পারতেন বঙ্গবন্ধু। অভিধানে সন্দেহ শব্দের অর্থ অপরাধ করেছে এমন অনুমানের কথাও বলা হয়। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের কাছে তাঁর প্রতি অপরাধ ঘটতে চলেছে এমন তথ্য ছিল। তাঁর বিরুদ্ধে চলতে থাকা ষড়যন্ত্রের কথা জানত ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থা রিসার্চ অ্যান্ড অ্যানালাইসিস উইং বা ‘র’ [RAW]। আগস্টের হত্যাকাণ্ডের আগে অন্তত দু’বার র-এর পক্ষ থেকে ষড়যন্ত্রের কথা বঙ্গবন্ধুকে সরাসরি জানানো হয়েছিল। তবু তিনি এমন নিঃসংশয় হলেন কী করে? ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থা র-এর প্রতিষ্ঠাতা প্রধান রমেশ্বর নাথ কাও বা আর এন কাও নিজেই ১৯৮৯ সালে ভারতের কলকাতার ইংরেজি সাপ্তাহিক সানডের ২৯ এপ্রিল সংখ্যায় এ কথা জানিয়েছিলেন। আর এন কাও সানডেতে প্রকাশিত একটি খবরের প্রতিক্রিয়া জানাতে গিয়ে লিখেছিলেন, ‘বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর একটি অসন্তুষ্ট অংশ যে শেখ মুজিবুর রহমানের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র পাকাচ্ছে, সে তথ্য RAW আগেই পেয়েছিল। আমি এ নিয়ে সে সময় প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর সঙ্গে ব্যক্তিগতভাবে কথা বলি। তাঁকে জানাই যে এ তথ্য আমরা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ সূত্র থেকে পেয়েছি এবং এই সূত্রের নাম যে কোনো মূল্যে গোপন রাখতে হবে।’ আর এন কাও এ বিষয়ে আরও বলেন, ‘প্রধানমন্ত্রীর অনুমোদন নিয়ে আমি ১৯৭৪ সালের ডিসেম্বরে ঢাকা যাই। এই সফরকালে শেখ মুজিবুর রহমানের সঙ্গে শেষবার দেখা হওয়ার সময় আমি তাঁকে পায়চারী করতে করতে বঙ্গভবনের বাগানে যেতে অনুরোধ করি। সবার অগোচরে নিয়ে গিয়ে আমি আমার তথ্য তাঁকে জানাই যে তাঁর জীবন হুমকির মধ্যে রয়েছে। তিনি সে সময় আনন্দপূর্ণ একটি পরিস্থিতির মধ্যে ছিলেন।’ এরপর বঙ্গবন্ধু নাকি কাঁধ ঝাঁকিয়ে কাওকে বলেছিলেন, ‘ওরা সবাই আমার নিজের ছেলে। আমাকে আঘাত করবে না।’
আর এন কাও এরপর লেখেন, ‘এই আলোচনার অংশ হিসেবেই ১৯৭৫ সালের মার্চে আমি একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাকে ঢাকায় পাঠাই। তিনি ঢাকায় শেখ মুজিবুর রহমানের সঙ্গে দেখা করে ষড়যন্ত্রের বিষয়ে যেসব তথ্য আমাদের কাছে আছে, সে অনুযায়ী তাঁকে জানান যে সেনাবাহিনীর দুটি ইউনিট, বিশেষ করে গোলন্দাজ (আর্টিলারি) ও অশ্বারোহী বাহিনী (ক্যাভালরি) তাঁকে হত্যার ষড়যন্ত্র করছে। কিন্তু দুঃখজনক যে শেখ মুজিব আমাদের সব সতর্কতাই উপেক্ষা করেছিলেন।’ বঙ্গবন্ধুর বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র হচ্ছে, এই বার্তা তিনি নানাভাবেই পেয়েছিলেন। কিন্তু তিনি কখনোই বিশ্বাস করতে পারেননি কোনো বাঙালি তাঁকে হত্যা করতে পারে। সন্দেহাতীত বিশ্বাসের পরিণতি ১৫ আগস্ট। আগস্টের মর্মন্তুদ দিনের আদ্যোপান্ত ইতিহাস বলবার জায়গা এ লেখা নয়। তবুও তো জিয়াউর রহমানের কথা একটু বলতেই হয়। শুরুতে যে তাঁর কবরে কার লাশ নিয়ে সংশয়ের কথা বলেছিলাম। বঙ্গবন্ধুর মৃত্যুর খবর পেয়ে জিয়া কী করেছিলেন, কী বলেছিলেন? জনপ্রিয় শ্রুতি হচ্ছে, জেনারেল জিয়া বললেন, ‘সো হোয়াট? লেট ভাইস প্রেসিডেন্ট টেক ওভার। উই হ্যাভ নাথিং টু ডু উইথ পলিটিক্স।’ পরবর্তীকালে রাজনীতি নিয়ে জিয়া যে খেলা খেলেছিলেন, তা এখন ইতিহাস এবং ইতিহাসের দায় বহন করছে বাংলাদেশ। সপরিবারে শেখ মুজিবুর রহমানকে হত্যার সেই সময়টায় ঢাকা সেনানিবাসে লেফটেন্যান্ট কর্নেল হিসেবে কর্মরত ছিলেন আমীন আহমেদ চৌধুরী, যিনি পরে মেজর জেনারেল হয়েছিলেন। ২০১৩ সালে মারা যান আমীন। ওই দিনটির বর্ণনা দিয়ে তিনি জানিয়েছিলেন, ১৫ আগস্ট ভোর ৫টার দিকে হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত একজন সেনা কর্মকর্তা মেজর রশিদের নেতৃত্বে তাঁর বাড়ি ঘিরে ফেলে। তখনো তিনি মর্মন্তুদ হত্যাযজ্ঞের কথা জানতেন না। মেজর রশিদের নেতৃত্বে সৈন্যদের একটি দল এরপর তৎকালীন কর্নেল শাফায়াত জামিলকে তুলে নেয়। তারপর তাদের নিয়ে যায় মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমানের বাড়িতে। জেনারেল জিয়া তখন সেনাবাহিনীর উপপ্রধান। আমীন আহমেদ চৌধুরীর বর্ণনা অনুযায়ী, ‘জেনারেল জিয়া একদিকে শেভ করছেন একদিকে শেভ করেন নাই। স্লিপিং স্যুটে দৌড়ে এলেন।’ এ সময় তাঁকে জানানো হলো রাষ্ট্রপতি সপরিবারে নিহত হয়েছেন। একথা শুনে যা তিনি বলেছিলেন তাতো এরই মধ্যে বলেছি এবং ওই বাক্যটি তিনি বলেছিলেন কিনা এ নিয়ে খুব সংশয়ের অবকাশ নেই। আগস্ট হত্যাকাণ্ডের পর নানান ঘটনাচক্র দেখে অনুমান করা যায় জিয়ার কপালগুণটা বেশ। খুনি মোশতাকের ষড়যন্ত্রের ঘনিষ্ঠ দোসর ছিলেন জিয়াউর রহমান এমনটাই ধারণা করা হয়, কেননা, ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট সকালে এই দু’জনই বাংলাদেশ বেতারের নাম বদলে পাকিস্তানি কায়দায় ‘রেডিও বাংলাদেশ’ রাখা কেন্দ্রে হাজির হয়েছিলেন। বঙ্গভবনের রাষ্ট্রপতির শপথ অনুষ্ঠানেও জিয়াউর রহমান ছিলেন সক্রিয়। খোন্দকার মোশতাক রাষ্ট্রক্ষমতায় আসীন হওয়ার ৯ দিনের মাথায় জিয়াউর রহমানকে সেনাবাহিনীর প্রধান পদে নিয়োগ দেন। তারপর তো তাঁর উত্থানের কাল। কপাল অবশ্য বেশিদিন তাঁর প্রতি প্রসন্ন থাকেনি। বাংলাদেশের অষ্টম রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান ১৯৮১ সালের ৩০ মে চট্টগ্রামে অবস্থানকালে সেনাবাহিনীর একদল অফিসারের আকস্মিক আক্রমণে নিহত হন। জিয়া তাঁর রাজনৈতিক দল বিএনপির স্থানীয় নেতাদের মধ্যে সংঘটিত একটি বিরোধের মীমাংসা করতে চট্টগ্রামে গিয়েছিলেন। অবশ্য আরও আগে ১৯৭৫ সালের ৩ নভেম্বরের অভ্যুত্থানে প্রাণ হারাতে পারতেন জিয়া। তাঁর কবর কোথায়? এতকাল জানা ছিল হত্যাকারীরা জিয়াকে রাঙ্গুনিয়ার পাহাড়ি এলাকায় দাফন করেছিল। পরে জিয়ার লাশ সেখান থেকে এনে ঢাকায় চন্দ্রিমা উদ্যানে কবর দেওয়া হয়। জিয়ার কবর এখানে নেই, এটা ১৯৯৬ সাল থেকেই আওয়ামী লীগের পক্ষে বলা হচ্ছে। তবে এবার জোরের সঙ্গে বলা হলো, বললেন খোদ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এরপর প্রধানমন্ত্রীর কথায় ধুয়ো তুলেছেন মন্ত্রীরা, তাঁরা দাবি করছেন চন্দ্রিমা থেকে জিয়ার কবর সরাতে হবে। বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর অবশ্য এরপর থেকে নিয়মিত বলে যাচ্ছেন, এ ধরনের উদ্যোগ নেওয়া হলে তা হবে সরকারের জন্য আত্মঘাতী এবং দেশের মানুষ সেটি মানবে না। দেশের মানুষ কী মানবে এবং কী মানিয়ে নিচ্ছে, এটা মির্জা ফখরুলদের বোধের বাইরে চলে গেছে। সংসদ ভবন এলাকায় জিয়াউর রহমান ছাড়াও সাতজন রাজনীতিকের কবর আছে। সাবেক রাষ্ট্রপতি আবদুস সাত্তার, সাবেক প্রধানমন্ত্রী শাহ আজিজুর রহমান ও আতাউর রহমান খান, সাবেক মন্ত্রী মশিউর রহমান যাদু মিয়া, মুসলিম লীগ নেতা খান এ সবুর, সাহিত্যিক, সাংবাদিক ও রাজনীতিবিদ আবুল মনসুর আহমদ এবং পাকিস্তান জাতীয় পরিষদের স্পিকার তমিজউদ্দীন খানের কবর রয়েছে সংসদ ভবন এলাকায়। নকশাবহির্ভূত বলে জিয়ার কবর সরানো হলে অন্য সাতজনের কবর সরানোর বিষয়টিও আসবে সন্দেহাতীতভাবে। একসঙ্গে এতজনের কবর সরানোর প্রতিক্রিয়া যে যথেষ্ট নেতিবাচক হবে, তা বুঝবার জন্য খুব জ্ঞানের দরকার নেই, সাধারণ কাণ্ডজ্ঞান থাকলেই চলবে। সন্দেহ তো জীবনের অংশ। তাই কবর নিয়ে কথকতার অবসান ঘটাই, কেননা ‘মরণের পরে শুধু ফিরে আসে কবরের ঘাস’। অবশ্য আমার একান্ত প্রিয় কবি আল মাহমুদ যিনি লিখেছিলেন, ‘প্রেম কবে নিয়েছিল ধর্ম কিংবা সংঘের শরণ/ মরণের পরে শুধু ফিরে আসে কবরের ঘাস/ যতক্ষণ ধরো এই তাম্রবর্ণ অঙ্গের গড়ন/ তারপর কিছু নেই, তারপর হাসে ইতিহাস’, পরবর্তীকালে তিনিই মৃত্যুর পরের জীবন নিয়ে বিচলিত হয়ে পড়েছিলেন। কবর রাজনীতির প্রপঞ্চ হয়ে থাকুক, আমরা জীবনের কথাই বলি বরং। সন্দেহ করাটা মানুষের অস্তিত্বের সঙ্গে মিশে আছে। প্রেমান্ধ ওথেলো সন্দেহের বশে খুন করেছিলেন ডেসডিমোনাকে। শেক্সপীয়রের এই নাটকের আরও অনেক আগের কথা, ‘আগামেমনন’ স্ত্রীর সন্দেহ ও প্রতিশোধস্পৃহার বলি হয়েছিলেন। তবে সন্দেহ সবসময় প্রতিশোধপরায়ণ করে না। আদিম যুগে গুহামানব যখন গুহার কাছে হিংস্র কোনো প্রাণী থাকতে পারে সন্দেহ করতে শিখেছিল, তখনই শিখেছে আত্মরক্ষার কৌশল। আপেল গাছ থেকে মাটিতে পড়ে এটাকেই যদি স্বাভাবিক বলে ধরে নিতেন নিউটন, গাছ থেকে বিচ্ছিন্ন আপেলটি আকাশের দিকে গেল না কেন এ নিয়ে তাঁর মনে সন্দেহ না জাগলে, মাধ্যাকর্ষণ শক্তি অনাবিস্কৃত থেকে যেত। নিউটন শুধু মাধ্যাকর্ষণ শক্তি নয়, আবিস্কার করেছিলেন বিশ্বের যে কোনো বস্তু একে অপরকে আকর্ষণ করে। পৃথিবী আপেলকে টানছে শুধু এটা নয়, আপেলও পৃথিবীকে তার দিকে টানছে। অবাক হওয়ার কিছু নেই যে সেই টানে পৃথিবী একটুখানি হলেও এগিয়ে যায়, সেটা যত কমই হোক। মানুষের মধ্যেও এই টানাটানি রয়ে গেছে এবং এরই ফাঁকে কারও সন্দেহ হয় অতি, হারায় বিশ্বাস।
জীবনানন্দ দাশ যেমন বলে গেছেন অনেকদিন আগে, ‘তবু’ কবিতাটির কথাই বলছি আমি, মনে হয় যেন আজই বললেন আবার-
‘এই পৃথিবীর অন্ধকারে মানুষের হৃদয়ে বিশ্বাস/ কেবলি শিথিল হ’য়ে যায়; তবু তুমি/ সেই শিথিলতা নও, জানি, তবু ইতিহাসরীতিপ্রতিভার/ মুখোমুখি আবছায়া দেয়ালের মতো নীল আকাশের দিকে/ ঊর্ধ্বে উঠে যেতে চেয়ে তুমি/ আমাদের দেশে কোনো বিশ্বাসের দীর্ঘ তরু নও।’
#সমকাল