সাহাবী আনাস (রা.) বলেন,রাসুলুল্লাহ সা. বলেছেন,‘ইলম (ধর্মীয় জ্ঞান) অর্জন করা প্রত্যেক মুসলমানের উপর ফরজ।’ (ইবনে মাজাহ: ২২৪)

পবিত্র কুরআন ও হাদিস ‘ইলম’ শব্দ দ্বারা উদ্দেশ্য হলো ধর্মীয় জ্ঞান।উল্লিখিত হাদিসে প্রত্যেক মুসলমানের উপর যে জ্ঞানার্জন ফরজ করা হয়েছে তা হলো,ধর্মীয় জ্ঞানের সে অংশটি আয়ত্ত করা যা ঈমান ও ইসলামের জন্য জরুরি এবং যার অবর্তমানে মানুষ না পারে ফরজসমূহ আদায় করতে,আর না পারে হারাম থেকে বেঁচে থাকতে! সুতরাং যে সমস্ত বিষয় জানার মাধ্যমে হালাল হারামের পার্থক্য করা যায় তা জানা আবশ্যক।

আবার ইসলামের বিশুদ্ধ আকিদা, পাক-নাপাকের হুকুম,নামাজ, রোজা,হজ্জ,জাকাতসহ অন্যান্য ইবাদত যেগুলিকে শরিয়ত ফরজ,সুন্নত,ওয়াজিব বা মুস্তাহাব কিংবা হারাম করেছেন সে সকল বিষয়ে জ্ঞান রাখা যা কিনা মানব জীবনে দৈনন্দিন কাজ-কথায় ব্যবহৃত হয়ে থাকে।অনুরূপভাবে ক্রয়-বিক্রয়ের সঠিক প্রক্রিয়া,ব্যবসায়ে কোন জিনিস হালাল,মুমিনের জন্য সুদের ব্যবসা কেনো হারাম অথবা বিবাহ,বিচ্ছেদ, সন্তান জন্মদান ও তাদের হক, পিতামাতার অধিকার ইত্যাদি যাবতীয় বিষয়াবলি।

এক কথায়, শরিয়ত মানুষের উপর যেসব কাজ ফরজ বা ওয়াজিব করে দিয়েছে,সেগুলোর হুকুম আহকাম সম্পর্কে জ্ঞানার্জন করা সবার জন্যই ফরজে আইন তথা অবশ্য পালনীয়।এছাড়াও অন্যান্য বিষয়,যেমন: ইসলামের যাবতীয় মাসয়ালা, কুরআন-হাদিসের হুকুম আহকাম ও ঈমানের শাখা-প্রশাখা ইত্যাদি আয়ত্তে আনার প্রচেষ্টা চালানো।যা সবার পক্ষে সম্ভব নয় বলে তা ফরজে আইনও নয়।কিন্তু গোটা মানব জীবনে মুসলিম হিসেবে বিশ্বের বুকে এর চর্চা করা,এর প্রচার প্রসার করাই মুমিন হিসেবে আমাদের একমাত্র দ্বায়িত্ব! আল্লাহর ইবাদত তথা উক্ত গুরু দ্বায়িতের জন্যই কেবল মানবজাতিকে সৃষ্টি করা হয়েছে এবং আশরাফুল মাখলুকাত তথা সেরা জীব হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে।

এবার আসুন, প্রত্যেকটি দেশ কিংবা শহরে যদি শরিয়তের উপরোক্ত ইলম ও আইন-কানুন শেখানোর জন্য সুদক্ষ আলেম থাকে কিন্তু শিক্ষাদানের সঠিক ব্যবস্থা না থাকে তবে কেবল গোত্র,জাতি হিসেবে নয় বরং সকল বিষয়ে সব দিক থেকে সে দেশ,জাতি পিছিয়ে যেতে বাধ্য! তাই যদি প্রতিটি শহর বা পল্লীতে অভিজ্ঞ আলেম থাকার পাশাপাশি ধর্মীয় শিক্ষা দানের জন্য উপযুক্ত মাদ্রাসা এডুকেশন সিস্টেমও যথাযথ ভাবে চালু থাকতে হবে।তাহলেই কেবল উক্ত শহর কিংবা গ্রামে গোমরাহি ছড়াবার কোনো অবকাশ থাকবে না,দাঙ্গা ফাসাদ হবে না।সুদ কিংবা ঘুষের লেনদেন হবে না,হবে না অন্যায় ভাবে হত্যা আর রাহাজানি।

একজন সুদক্ষ আলেম যেমন আপনার সন্তানকে দ্বীনি বিষয়াবলি সম্পর্কে জ্ঞান দিবে সাথে সে ওই জ্ঞানও লাভ করবে যাতে করে সে কেবল দুনিয়াতে শান্তিময় জীবনযাপনে অভ্যস্ত হবে না বরং সাথে সাথে পরকালীন মুক্তির পথও বাতলে নিতে সক্ষম হবে ইন শা আল্লাহ।

অন্য আয়াতে আল্লাহ তায়ালা স্পষ্ট করে বলে দিয়েছেন, ‘মুমিনগণ,তোমরা নিজেদেরকে এবং তোমাদের পরিবার পরিজনকে সেই অগ্নি থেকে রক্ষা করো,যার ইন্ধন হবে মানুষ ও প্রস্তর, যাতে নিয়োজিত আছে পাষাণ হৃদয়, কঠোরস্বভাব ফেরেশতাগণ।তারা আল্লাহ যা আদেশ করেন,তা অমান্য করে না এবং যা করতে আদেশ করা হয়,তাই করে।’ (সুরা তাহরিম: ৬)

সুতরাং বোঝা যাচ্ছে আপনার দুনিয়াবি জিন্দেগীতে হেরফের হলে তার শাস্তি-গ্লানি আপনাকে টানতে হবে পরকাল তথা জাহান্নাম পর্যন্ত! সুতরাং স্বাবধান হোন আপনার সন্তানকে শিক্ষিত না করে বরং সুশিক্ষায় শিক্ষিত করুন,ধর্মীয় জ্ঞান দিন।আজকের শিশুরাই আগামী দিনের ভবিষ্যৎ!

ধর্মীয় শিক্ষার ফজিলত:আবু দারদা (রা.) বলেন,আমি নবি করিম (সা.)কে বলতে শুনেছি,তিনি বলেছেন,‘যে ব্যক্তি জ্ঞানার্জনের কোনো পথ অবলম্বন করে,আল্লাহ তায়ালা তার জন্য জান্নাতের দিকে একটি পথ সুগম করে দেন।ফেরেশতাগণ জ্ঞান অন্বেষীর সন্তুষ্টির জন্য তাঁদের পাখাসমূহ অবনমিত করেন।জ্ঞান অন্বেষীর জন্য আসমান ও জমিনবাসী আল্লাহর নিকট ক্ষমা প্রার্থণা করে,এমনকি পানির মাছও।নিশ্চয় ইবাদতকারীর উপর আলিমের মর্যাদা তারকারাজির উপর চাঁদের মর্যাদার সমতুল্য।’ (ইবনে মাজাহ: ২২১)
সুবাহানাল্লাহ! হাদীসে কি সুন্দর বক্তব্য উপস্থিত হয়েছে নিজেই একবার দেখুন।শুধুমাত্র দ্বীনের জ্ঞান আহরণের কাজে অগ্রসর হলে আসমানের ফেরেস্তাগণ আপনার কিংবা আপনার সন্তানের জন্য তাদের রহমতের পাখা গুলো মেলে দিবেন, আপনার জন্য উন্মুক্ত হবে ক্ষমার দরজা সমূহ সাথে আরো পাচ্ছেন সুমহান মর্যাদা! সুতরাং আপনি চিন্তা করুন কোন জ্ঞান আহরণের পথে নিজেকে ধাবিত করবেন যা কেবল দুনিয়ার কাজেই সীমাবদ্ধ নাকি যেটি আপনার দুনিয়ার সাথে সাথে পরকালীন জীবনেরও মুক্তির পথ ও পাথেয় সংগ্রহ করবে।

বিশুদ্ধ একটি হাদিসে উল্লেখ আছে,মুয়াবিয়া (রা.) বলেন,আমি রাসুলুল্লাহ (সা.)কে বলতে শুনেছি, ‘আল্লাহ যার মঙ্গল চান,তাকে ধর্মীয় জ্ঞান দান করেন।আমি তো বিতরণকারী মাত্র,আল্লাহই দাতা। সর্বদাই এ উম্মত কেয়ামত পর্যন্ত আল্লাহর হুকুমের উপর অটল থাকবে, বিরোধিতাকারীরা তাদের কোনো ক্ষতি করতে পারবে না।’ (বুখারি: ৭১)

আবার আবু হুরাইরা (রা.) বলেন, রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন,‘ইমানদার ব্যক্তির মৃত্যুর পর সমস্ত আমল বন্ধ হয়ে যায়।কিন্তু তিনটি আমল এমন, মৃত্যুর পরও যার সওয়াব মৃত ব্যক্তি লাভ করেন।একটি হলো,যে জ্ঞান সে অন্যকে শিক্ষা দিয়েছে এবং তার প্রচার করেছে।’ (ইবনে মাজাহ: ২৪০)

সুতরাং যেকোনো ব্যক্তির জন্য জান্নাতের রাস্তা সুগম হওয়া,কিংবা অন্যান্য প্রাণীকুলের নাজাতের দোয়া পাওয়া,মৃত্যুর পরও সওয়াবের ধারাবাহিকতা চালু থাকা ইত্যাদি অত্যন্ত গৌরব ও কল্যাণের কথা,যা কেবল সৌভাগ্যরাই লাভ করতে সক্ষম।তাই দুনিয়া ও আখেরাতে সৌভাগ্যবানদের অন্তর্ভুক্ত হতে হলে আমাদেরকে ধর্মীয় শিক্ষার প্রতি যত্মবান হতে হবে,সন্তানেরকে মাদ্রাসা শিক্ষায় শিক্ষিত করতে হবে।মাদ্রাসা গুলোকে সমৃদ্ধ করতে হবে,আল্লাহ আমাদের সকলকে সেই তাওফিক দান করুক,ওমা তাওফিক ইল্লা-বিল্লাহ।

লেখকঃ
তাহেরা আক্তার
শিক্ষিকা, গুটিয়া ইসলামিয়া দাখিল মাদ্রাসা।