গত ২৬ শে সেপ্টেম্বর কক্সবাজারের মহেশখালীর ধলাকাটা এলাকা থেকে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় প্রাণিবিদ্যা বিভাগের সহকারী অধ্যাপক দিলীপ কুমার বিসর্গ দাশের  পিএইচডি প্রজেক্টের জিপিএস ট্যাগকৃত একটি পাখি একজন স্থানীয় ধরে ফেলে। এরপর পাখিটির করুন মৃত্যু হয়।

পাখিটর মৃত্যু নিয়ে নিজ ফেসবুক পোস্টে এই পাখি গবেষক লিখেন ২৬ সেপ্টেম্বর পাখিটির পিঠে জিপিএস ট্যাগ দেখে স্থানীয়দের মধ্যে এটি মায়ানমার থেকে পাঠানো গোয়েন্দা পাখি আখ্যা দেওয়া সহ অকল্পনীয় সব বিভ্রান্তিকর গুজবের সৃষ্টি হয়। ফলে এটি স্থানীয় মানুষের মাঝে দারুণ আলোড়ন তৈরি করে। এলাকার চেয়ারম্যান বিষয়টি স্থানীয় প্রশাসন, গোয়েন্দা সংস্থা ও মিডিয়ার নজরে আনেন। মিডিয়া বিষয়টি যাচাই বাছাই না করেই প্রচার করলে গুজবটি ভাইরাল হয়। স্থানীয় প্রশাসন পাখিটিকে বন বিভাগে হস্তান্তর করতে নির্দেশ দেয়। কিন্তু গুজবের ফলে অজানা আশংকায় ধলাকাটার চেয়ারম্যান বন বিভাগের স্থানীয় প্রতিনিধির হাতে হস্তান্তর করতে অপারগতা জানায়। বন বিভাগের উচ্চ পদস্থ কর্মকর্তার উপস্থিতির দাবি জানান। বন বিভাগের বিট অফিসার মাঝ রাতে ধলাকাটায় পৌঁছালে সাংবাদিক সন্মেলন করে পাখিটি হস্তান্তর করা হয়। অতিরঞ্জিত গুজবের ফলে পাখিটির হস্তান্তর প্রক্রিয়াটি দীর্ঘ ও জটিল আকার ধারণ করে। ফলশ্রুতিতে পাখিটি উদ্ধার করে মহেশখালীতে নিয়ে যাবার পথে পাখিটি মারা যায়।


তিনি তার ফেসবুক পোস্টে আরো উল্লেখ করেন পাখিটির নাম দিয়েছিলাম ফিরোজ, আমার শিক্ষাগুরু জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক মোহাম্মদ মোস্তফা ফিরোজ এর নামে। পাখিটির প্রজাতির সাধারণ নাম কালো-লেজ জৌরালি (Black-tailed Godwit)। বাংলাদেশের কালো-লেজ পাখির পরিযায়নের উপর গবেষণার লক্ষে ২০২১ সালের ৩০ ডিসেম্বর এই পাখিটির পিঠে নিঝুম দ্বীপ থেকে একটি হাল্কা জিপিএস ট্যাগ (৪.৫ গ্রাম) ও পায়ে বাংলাদেশের জন্য নির্ধারিত রঙ্গিন পতাকা (দুইটি হলুদ রঙের পতাকা) ও আংটি (নীল, হলুদ ও সবুজ রঙের) পরিয়ে সুস্থ সবল অবস্থায় ছেড়ে দিই। ছাড়ার পর প্রায় ৫ মাস ফিরোজ নিঝুম দ্বীপ ও তার আশেপাশের এলাকায় বিচরণ করে। ২৩ মে ২০২২ তারিখে ফিরোজ উত্তরের পথে উড়াল দেয়। প্রায় ৪০০০ কিমি পথ পাড়ি দিয়ে ৮ জুন ২০২২ তারিখে চীনের ইনার মঙ্গোলিয়া প্রদেশের জিলিঙ্গল লিগ এলাকায় পৌঁছায়। মাঝে চীনের নিঞ্জিয়া অঞ্চলে তিন দিনের জন্য বিশ্রাম নেয়। চীন থেকে ১.৫ মাস পরে ২৪ শে জুলাই ২০২২ তারিখে ফের বাংলাদেশের পথে রওয়ানা দেয়।ফিরোজের নিঝুম দ্বীপ থেকে চীন হয়ে ফের নিঝুম দ্বীপের পথে দীর্ঘ প্রায় ৮০০০ কিমি রোমাঞ্চকর দুঃসাহসী প্রতিবন্ধময় ক্লান্তিকর যাত্রার দুঃখজনক সমাপ্তি ঘটে। ২৬ শে সেপ্টেম্বর বাংলাদেশের মহেশখালীর ধলাকাটায় এক স্থানীয় লোক ধরে ফেললে ফিরোজের অকাল মৃত্যু ঘটে।
কেন এই মৃত্যু ?
মূলত স্ট্রেস। পাখিটি দীর্ঘ ক্লান্তিকর পথ পরিযায়ন করে দুর্বল ও ক্লান্ত ছিল। প্রয়োজন ছিল নিবিড় বিশ্রামের । হয়তো ধলাকাটায় সে দুএকদিন বিশ্রাম নিয়ে নিঝুম দ্বীপের পথে উড়াল দিত। কিন্তু পাখিটিকে বিকেলে ধরার পর থেকে মাঝ রাতে পর্যন্ত পাখিটির আশেপাশে মানুষের ভিড়, সঠিক পরিচর্যা না করে পাখিটিকে যেন তেন ভাবে ধরে ভিডিও করা, আশেপাশের চিৎকার চেঁচামেচি ও পাখিটিকে শত ভিড়ের মধ্য নিয়ে সংবাদ সন্মেলন, এই সমস্ত কিছুর চাপ পাখিটির পক্ষে নেয়া সম্ভবপর হয়নি।
কল্পনা করুন আপনাকে একটি বাঘের খাঁচায় ঢুকিয়ে দেয়া হলো। বাঘ শান্ত, আপনাকে কিছুই করছে না। তথাপি আপনার মনে কি পরিমাণ চাপ তৈরি হবে? অধিকাংশ মানুষ এমন পরিস্থিতিতে হার্ট এটাক করে মারা পড়বে।

জিপিএস ট্যাগ কি ? কেন ব্যবহার করা হয়?

জিপিএস ট্যাগ একধরনের যন্ত্র যার মাধ্যমে স্যাটেলাইটের সাথে যোগাযোগের মাধ্যমে ওই যন্ত্রটির অবস্থান সম্পর্কে জানা যায়। একি প্রযুক্তি ব্যবহার করে আমরা উবার বা পাঠাওয়ের বা মোবাইলে আমাদের নিজেদের অবস্থান দেখতে পাই। বন্যপ্রাণী গবেষণায় জিপিএস ট্যাগ প্রায়শই ব্যবহার করা হয়ে থাকে প্রাণীদের চলাচল, আচরণ, স্থান নির্বাচন সংক্রান্ত প্রানিবিজ্ঞানের নানান গুরুতপূর্ন প্রশ্নের উত্তর খোঁজার জন্য। যেমন হাতি, বাঘ, সিংহ ও বাইসন সহ অনেক প্রাণীর গবেষণায় এইরকম যন্ত্র ব্যবহার করা হয়েছে। পূর্বের প্রযুক্তি আজকের মতন উন্নত ছিল না, জিপিএস ট্যাগ বড় ও ভারী হওয়ায় ছোট আকারের প্রানীতে ব্যবহার করা যেতো না। সাম্প্রতিক দশকে প্রযুক্তির উন্নতিতে জিপিএস ট্যাগ পাতলা ও ছোট হয়ে এসেছে। পাখি গবেষণায় এই যন্ত্র ব্যবহার করে নানান চমকপ্রদ ও সংরক্ষণের জন্য গুরুত্বপূর্ন তথ্যাদি পাওয়া যাচ্ছে। বাংলাদেশ বার্ড ক্লাব ও IUCN বাংলাদেশ পরিয়ায়ী হাঁস পাখির উপর জিপিএস ট্যাগ ব্যবহার করে সংরক্ষণের জন্য গুরুত্তপূর্ন গবেষণা কার্যক্রম পরিচালনা করছে।
কেন এই গবেষণা? 
এটি আমার পি এইচডি গবেষণার কাজ। পিএইচডি শুরুর পূর্বে আমি গত এক দশক ধরে পরিযায়ী পাখি নিয়ে গবেষণা করছি।
আমার পিএইচডি গবেষণার মাধ্যমে আমি বুঝতে চাই যে কেন একি প্রজাতির একটি পরিযায়ী পাখি (যেমনঃ কালো লেজ জৌরালি) দুইটি ভিন্ন রকমের বাস্তুসংস্থান (Ecosystem)  (যেমনঃ উপকূল ও হাওড়) বেছে নেয় প্রজননহীন শীতকাল কাটাবার জন্য? একি সাথে এরা কিভাবে হিমালয়ের মত বিশাল পর্বত , বিশাল গোবি মরুভূমি পাড়ি দিয়ে রাশিয়া থেকে বাংলাদেশে আসে ও ফিরে যায়?
এই গবেষণার গুরুত্ব কি? 
এর ফলে পাখি বিজ্ঞানের ও বাংলাদেশের মানুষের কি উপকার হতে পারে? কালো-লেজ জৌরালি পাখি আমাদের বন্ধু ও প্রহরী। এটি প্রহরীর মতন সর্বদা আমাদের পরিবেশ তথা জলাশয়ের স্বাস্থ্য, ঋতু বদল ও জলাশয় এলাকা ব্যবহারের ফলে যে পরিবর্তন ও প্রভাব তার সম্পর্কে আগাম ইঙ্গিত দিতে থাকে। এরা পরিবেশের পরিবর্তনের (ভাল মন্দ উভয়েরই) সত্যিকার নির্দেশ দেয়। এজন্য পরিবেশের পরিবর্তন বোঝার জন্য এরা অতি গুরুত্বপূর্ন।

জৌরালি পাখি কয়লা খনির ক্যানারি পাখির মত। আধুনিক প্রযুক্তি যুগের আগে কয়লা শ্রমিকরা খনিতে কাজ করার সময় খাঁচায় একটি ক্যানারি পাখি রাখত। যদি ক্যানারি পাখিটি অসুস্থ হয়ে পড়ত তাহলে তারা বুঝতে পারত যে খনির ভিতরের বাতাস বিষাক্ত। তেমনি জৌরালি পাখি বাংলাদেশের জলাশয় সহ মধ্য ও পূর্ব এশিয়ার অনেক দেশ সহ বিশাল এলাকার পরিবেশ, প্রতিবেশ ও ঋতু বদল সম্পর্কে সর্বদাই আমাদেরকে বার্তা দিয়ে যাচ্ছে।
আমার পি এইচ ডি গবেষণায় আমি প্রতিবেশগত গুরুত্বপূর্ন প্রশ্নের উত্তর খোঁজার মধ্য দিয়ে কিভাবে জৌরালি পাখির আগাম বার্তাকে আমাদের জানা, বোঝা ও পরিবেশ তথা মানুষের স্বাস্থ্য রক্ষায় ব্যবহার করা যায়, তার উপায় উদ্ভাবনের প্রচেষ্টায় আছি।
পৃথিবী ব্যাপী আমাদের প্রহরী বন্ধু পরিযায়ী পাখিদের ব্যবহার করে পরিবেশ ও প্রতিবেশের পরিবর্তন বোঝার জন্য নানান একাডেমিক গবেষণা কার্যক্রম চলছে। বাংলাদেশ পরিযায়ন সংক্রান্ত এই গবেষণায় একবারেই অনুপস্থিত এখনো পর্যন্ত পরিযায়ী পাখি নিয়ে বাংলাদেশে একটি পিএইচডি গবেষণা কাজও হয়নি। বর্তমানে বাংলাদেশে এ সংক্রান্ত মাত্র দুইটি পিএইচডি গবেষণা চলছে। একটি আমি করছি গ্রোনিংগেন বিশ্ববিদ্যালয়ে ও আরেকটি চলছে কেম্ব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ে।
পরিযায়ী গবেষণা সংক্রান্ত কাজে সমস্ত দক্ষিণ এশিয়া পিছিয়ে আছে। আমার কাজের মধ্য দিয়ে কাটিং এজ প্রযুক্তি ব্যবহার করে পরিযায়ী সৈকত পাখির গবেষণা দক্ষিণ এশিয়ায় বাংলাদেশ আগে শুরু করেছে বলা যায়।
আমার পিএইচডি গবেষণা বাংলাদেশকে বিশ্বের পরিযায়ী পাখির গবেষণায় সম্পৃক্ত করবার ক্ষুদ্র প্রয়াস। একি সাথে বাংলাদেশের পরিবেশের স্বাস্থ্য, জলবায়ুর পরিবর্তন, খাদ্য সুরক্ষা ও জলাশয়ের বৈচিত্র সম্পর্কে পরিযায়ী পাখির নির্দেশিত তথ্যাবলি কিভাবে মানুষের উপকারে ব্যবহার করা যায় তার প্রথম ধাপ।
এই গবেষণায় সাফল্য পেলে বিশ্বের পাখি বিজ্ঞানে বাংলাদেশের অবদান স্বীকৃতি পাবে ও পাখি বিজ্ঞানে বাংলাদেশ আধুনিক যুগে প্রবেশ করবে। একি সাথে বাংলাদেশের স্বনামধন্য জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ে পরিযায়ন গবেষণার সক্ষমতা তৈরি হবে। পরিযায়ন গবেষণায় বর্তমান ও ভবিষ্যতের শিক্ষার্থিরা প্রশিক্ষিত হয়ে বাংলাদেশ কে এই গবেষণায় নেতৃত্ব দিয়ে এগিয়ে নেবার সুযোগ পাবে।

ফিরোজের অনাকাঙ্ক্ষিত মৃত্যু আমার পিএইচডি গবেষণা তথা বাংলাদেশের পাখি বিজ্ঞানের প্রচেষ্টায় একটি অপূরণীয় ক্ষতি। তবে ফিরোজ আমাদেরকে একটি সুযোগ করে দিয়ে গেছে। মরে গিয়েও আমাদের এই দুঃসাহসী অতন্দ্র প্রহরী বন্ধু বাংলাদেশের মিডিয়া ও মানুষের, পাখি বিজ্ঞানের নানা কাজ ও ধরন সম্পর্কে অজ্ঞতা নির্দেশ করে গেছে । পাখি প্রেমী, বিজ্ঞানী, বন বিভাগ, এন জি ও, সরকারের নানা সংস্থা সহ বাংলাদেশের মিডিয়ার দ্বায়িত্ব আমাদের এই অজ্ঞতা দূরীকরণে কাজ করতে এগিয়ে আসা।

ভবিষ্যতে এইরকম জিপিএস ট্যাগ বা পায়ে রঙ্গিন পতাকা বা আংটি সহ কোন পাখি দেখলে তা ধরে যেন মৃত্যুর মুখে ঠেলে না দিতে সবার প্রতি আহ্বান জানান তিনি।