মাসুদ রানা জয় | পার্বত্যচট্রগ্রাম: করোনাকালে ঝরে পড়া রোধ এবং পিছিয়ে পড়া শিক্ষার্থীদের এগিয়ে নিতে গ্রামের বাড়ি বাড়ি গিয়ে পাঠদান করছেন সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকেরা। পাহাড়ে অনলাইনে সুবিধার বাইরে থাকা শিক্ষার্থীদের জন্য এমন উদ্যোগ নিয়েছে খাগড়াছড়ি জেলা শিক্ষা অধিদফতর। জেলার ৫৯৩টি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের বাড়িতে গিয়ে পাঠদান করাচ্ছেন শিক্ষকরা।
এতে করোনাকালীন শিক্ষার্থীরা শিখন ঘাটতি কাটিয়ে উঠছে। এর আওতায় এসেছে খাগড়াছড়ির ১ লক্ষ ২৭ হাজার শিক্ষার্থী। করোনার কারণে স্কুল বন্ধের সময় এভাবে পাঠদান চলবে জানিয়েছেন জেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা।

মহামারীর কারণে ২০২০ সালে ২২ মার্চ থেকে দেশের সব শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ রয়েছে। প্রাথমিক বিদ্যালয় বন্ধ থাকায় অনলাইন, টেলিভিশন ও বেতারের মাধ্যমে পাঠদানের উদ্যোগ নেয় সরকার। তবে দুর্গম পাহাড়ে ইন্টারনেট ও বিদ্যুৎ সুবিধা না থাকায় বঞ্চিত হচ্ছে শিক্ষার্থীরা। এছাড়া আর্থিক সামর্থ্যের অভাবে স্মার্টফোন না থাকায় বঞ্চিত হয়েছে অনেক শিক্ষার্থী। সব শিক্ষার্থী যাতে পাঠদানের আওতায় আসে সেজন্য গ্রামে গ্রামে গিয়ে পাঠদান করাচ্ছেন শিক্ষকরা।

 

প্রতিদিনই বিভিন্ন উপদলে বিভক্ত হয়ে বাড়িতে গিয়ে ওয়ার্কশিটের মাধ্যমে পাঠপরিকল্পনা বুঝিয়ে দিচ্ছেন। এক সপ্তাহ পরে সেই পাঠ শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে আদায় করছেন। এ কাজে শিক্ষার্থীদের অভিভাবকদের সম্পৃক্ত করা হয়েছে। এমন কার্যক্রমে খুশি শিক্ষার্থী ও অভিভাবকরা।

গতকাল রোববার সকালে সরেজমিনে খাগড়াছড়ি জেলা সদরে দক্ষিণ খবংপুড়িয়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে গিয়ে দেখা যায়, জ্যৈষ্ঠ মাসের প্রখর রোদ উপেক্ষা করে বিদ্যালয়ের আট শিক্ষকের দুটি দল গ্রামে গ্রামে যাচ্ছেন। মধ্য খবংপুড়িয়া এলাকার শিক্ষার্থীদের বাড়িতে গিয়ে ওয়ার্কশিট বুঝিয়ে দিচ্ছেন সহকারী শিক্ষক লেলিন বড়ুয়া, টুনটুনি চাকমা ও এমিলি দেওয়ান। এ সময় উপজেলা প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তর থেকে দেওয়া পাঠ পরিকল্পনা শিক্ষার্থীদের বুঝিয়ে দেন তারা।

 

বিদ্যালয়ের শ্রেণীকক্ষের মতোই শিক্ষার্থীদের ওয়ার্কশিটের কার্যক্রম বুঝিয়ে দেন। দক্ষিণ খবংপুড়িয়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ৪র্থ শ্রেণীর শিক্ষার্থী শ্রেষ্ঠা চাকমা, জয়া চাকমা ও ২য় শ্রেণীর শিক্ষার্থী রাহুল ত্রিপুরা, পরিপূর্ণা চাকমা ও বিদর্শী চাকমা জানায়, করোনার পর এক বছরের বেশি সময় ধরে আমরা বিদ্যালয়ে যেতে পারি না। বন্ধুদের সাথেও দেখা হয় না। এখন ম্যাডামরা বাড়িতে এসে আমাদের পড়াচ্ছেন। ওয়ার্কশিটের মাধ্যমে বাড়ির কাজ দিচ্ছেন। বাড়ির কাজ করে আমরা জমা দিচ্ছি। বাড়িতে আমাদের বন্ধুদের সাথে পড়াশোনা করতে পারছি। বাড়িতেই ক্লাসের মতো করে পাঠদান করতে পারায় আমরা খুশি।

শিক্ষার্থীদের অভিভাবক রেবিকা চাকমা ও প্রেমতা চাকমা জানান, বাড়ি বাড়ি শিক্ষকরা যেভাবে পাঠদান করাচ্ছেন তা বেশ কার্যকরী। বাচ্চারা পড়াশোনায় মনোযোগী হয়েছে। অনলাইনে অনেক সময় ঠিকমতো ক্লাস করতে পারত না। এখন শিক্ষকরা বাড়ি এসে পড়া বুঝিয়ে দিচ্ছেন, আবার আদায়ও করছেন।

দক্ষিণ খবংপুড়িয়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক বিজয়া খীসা বলেন, আমাদেরকে ৬ সপ্তাহের জন্য অন্তর্বর্তীকালীন পাঠ পরিকল্পনা দিয়েছে। আমাদের শিক্ষকরা বাড়ি বাড়ি গিয়ে পাঠদান করাচ্ছেন এবং শিক্ষার্র্থীদের হোমওয়ার্কের জন্য ওয়ার্কশিট বিতরণ করছেন। পাঠ দেওয়ার পর তা আবার আদায় করে শিক্ষকরা বিদ্যালয়ে জমা দিচ্ছেন। ২৯ মে থেকে ৮ জুলাই পর্যন্ত আরো ৬ সপ্তাহের জন্য অন্তর্বর্তীকালীন পাঠ পরিকল্পনা দিয়েছেন। শিক্ষার্থীদের শিখন ঘাটতি পূরণে শিক্ষকরা বিদ্যালয় বন্ধের সময় এসব কার্যক্রম চালাচ্ছেন।

পানছড়ি প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের সহকারী শিক্ষা কর্মকর্তা এডিন খীসা বলেন, গুগুল মিটের মাধ্যমে আমরা শিক্ষার্থীদের অনলাইনে ক্লাস নিচ্ছি। এর বাইরে অনেক শিক্ষার্থী রয়েছে যারা অনলাইনে পাঠদানের সুবিধা নিতে সক্ষম না। সে কারণে শিক্ষকরা গ্রামে গ্রামে ঘুরে পাঠদান করাচ্ছেন। এতে শিক্ষার্থীরা বেশ উপকৃত হচ্ছে। উপজেলা সহকারী শিক্ষা কর্মকর্তারা এসব কাজের তদারকি করছেন।

খাগড়াছড়ি জেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা ফাতেমা মেহের ইয়াসমিন বলেন, দুর্গম নাড়াইছড়ি থেকে শুরু করে উপজেলা সদর পর্যন্ত প্রতিটি বিদ্যালয়ের শিক্ষকরা পাঠদান দিচ্ছেন। ২১ মে এ কার্যক্রম শুরু হওয়ার পর বয়স্ক ও অসুস্থ শিক্ষক-শিক্ষিকা বাদে প্রায় ২৪০০ জন শিক্ষক ৭০০টি দলে ভাগ হয়ে গ্রামে গ্রামে গিয়ে শিক্ষার্থীদের পাঠপরিকল্পনা বিতরণ করছেন এবং শিক্ষার্থীদের তা ভালোভাবে বুঝিয়ে দিচ্ছেন। জেলার ১৭শ ৬টি গ্রামে ইতোমধ্যে পাঠদান প্রক্রিয়া সম্পন্ন হয়েছে।

তিনি জানান, দুর্গম পাহাড়ি এলাকায় শিক্ষার্থী অনুপাতে শিক্ষকদের পাঠদানের জন্য দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। দায়িত্বরত শিক্ষকরা ওই শিক্ষার্থীর সার্বিক বিষয় খোঁজখবর রাখবেন। স্বাস্থ্যবিধি মেনে মাস্ক পরে শিক্ষার্থীর সাথে দেখা করে তাদের কাছ থেকে পড়া আদায় করবেন। যেসব শিক্ষার্থী অনলাইনের মাধ্যমে ক্লাস করতে পারছে না তারা এই পাঠদানে উপকৃত হচ্ছে। যতদিন বিদ্যালয় বন্ধ থাকবে শিক্ষকরা এভাবে পাঠদান করবে। পুরো কাজে ৯ উপজেলার সহকারী শিক্ষা অফিসাররা তদারকি করছেন।