করোনাভাইরাসের কারণে দুই দফা বন্ধ থাকার পর হবিগঞ্জ জেলার চুনারুঘাটের সাতছড়ি জাতীয় উদ্যান ও রেমা-কালেঙ্গা বন্যপ্রাণি অভয়ারণ্য খুলে দেওয়া হয়েছে। ২১ মে আগস্ট রাতে সাতছড়ি বন্যপ্রাণি রেঞ্জ কর্মকর্তা মাহমুদ হোসেন এ তথ্য নিশ্চিত করে জানান, করোনার কারণে প্রথম দফা ২০২০ সালের ১৯ মার্চ এ পর্যটন স্পটটি বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছিল। এরপর থেকে প্রায় ৮ মাস বন্ধ থাকার পর ১ নভেম্বর এ উদ্যান খুলে দেয়া হয়। করোনা পরিস্থিতি জটিলতর হওয়ায় চলতি বছরের ১ এপ্রিল থেকে দ্বিতীয় দফায় উদ্যান বন্ধ রাখার ঘোষণা আসে। এরপর এবার প্রায় সাড়ে তিন মাস পর ২১ আগস্ট থেকে আবার এই উদ্যান খোলা হলো। তিনি জানান, দুই দফা উদ্যান বন্ধ থাকায় হতাশায় ছিলেন দর্শনার্থীরা। আর এসব স্থানে দর্শনার্থীদের প্রবেশ বন্ধে কঠোর অবস্থানে ছিল কর্তৃপক্ষ।
কলেঙ্গা রেঞ্জ কর্মকর্তা খলিলুর রহমান বলেন, ‘কালেঙ্গাও চালু করা হয়েছে। পর্যটকরা আসতে শুরু করেছেন। আমাদের পুরোপুরি প্রস্তুতি আছে।’ খোলা থাকলে সাতছড়িতে প্রতিদিন ৫০০ থেকে পাঁচ হাজার পর্যন্ত পর্যটক আসেন। বয়স্কদের টিকিট বিক্রি হয় ৩০ টাকা এবং অপ্রাপ্ত বয়স্কদের জন্য ২৫ টাকা। দুই দফায় প্রায় এক বছর বন্ধ থাকার পর হবিগঞ্জের বিনোদন স্পটগুলো চালু হওয়ায় দর্শনার্থীরা উচ্ছ্বাস ও আনন্দে মেতেছেন। তারা (পর্যটক) সাতছড়ি, কালেঙ্গাসহ বিনোদন স্পটগুলোতে আসতে শুরু করেছেন। কয়েকজন দর্শনার্থী জানান, ‘হবিগঞ্জে করোনা পরিস্থিতি বেশ নিয়ন্ত্রিত। তাই ঘুরতে এলাম। শহরে ঘুরে আনন্দ নেই। বনে ঘুরে বেড়ানোর আনন্দ বেশি। সাতছড়ি জাতীয় উদ্যান ও রেমা-কালেঙ্গা বন্যপ্রাণি অভয়ারণ্য খুলে দেওয়ায় ভাল লাগছে।
বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন (বাপা) জেলা শাখার সাধারণ সম্পাদক তোফাজ্জল সোহেল সর্তকার সুরে বলেন, ‘করোনা পুরোপুরি বিদায় নেয়নি। তাই স্বাস্থ্যবিধি মেনে যেন তারা (দর্শনার্থীরা) সাতছড়ি, কালেঙ্গাসহ বিনোদন স্পটগুলোতে প্রবেশ করেন।’ ১৯১২ সালে প্রায় ১০ হাজার একর দুর্গম পাহাড়ি জমি নিয়ে গঠিত রঘুনন্দন হিলস্ রিজার্ভই কালের পরিক্রমায় আজকের সাতছড়ি উদ্যান। অবশ্য জাতীয় উদ্যান হওয়ার ইতিহাস বেশি দিনের নয়। ২০০৫ সালে ৬০০ একর জমিতে জাতীয় উদ্যান করা হয়। এ উদ্যানের ভেতরে রয়েছে অন্তত ২৪টি আদিবাসী পরিবারের বসবাস। পর্যটকদের জন্য চালু করা প্রজাপতি বাগান, ওয়াচ টাওয়ার, হাঁটার ট্রেইল, খাবার হোটেল, রেস্ট হাউস, মসজিদ ও স্টুডেন্ট ডরমিটরি রয়েছে। উদ্যানে দুই শতাধিক প্রজাতির উদ্ভিদের মধ্যে শাল, সেগুন, আগর, গর্জন, চাপালিশ, পাম, মেহগনি, কৃষ্ণচূড়া, ডুমুর, জাম, জামরুল, সিধা জারুল, আওয়াল, মালেকাস, আকাশমনি, বাঁশ, বেত ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য। ১৯৭ প্রজাতির জীবজন্তুর মধ্যে প্রায় ২৪ প্রজাতির স্তন্যপায়ী, ১৮ প্রজাতির সরীসৃপ, ৬ প্রজাতির উভচর। আরও আছে প্রায় ২০০ প্রজাতির পাখি। রয়েছে লজ্জাবতী বানর, উল্লুক, চশমা পরা হনুমান, শিয়াল, কুলু বানর, মেছো বাঘ, মায়া হরিণের বিচরণ। সরীসৃপের মধ্যে আছে কয়েক জাতের সাপ। কাও ধনেশ, বন মোরগ, লাল মাথা ট্রগন, কাঠঠোকরা, ময়না, ভিমরাজ, শ্যামা, ঝুটিপাঙ্গা, শালিক, হলদে পাখি, টিয়া প্রভৃতির আবাসস্থল এই উদ্যান। কালেঙ্গা বিট কর্মকর্তা শ্যামাপদ মিশ্র বলেন, ‘রেমা-কালেঙ্গার বন্যপ্রাণী অভয়ারণ্য মূলত তরফ পাহাড় সংরক্ষিত বনভূমির একটি অংশ। যা দেশের অবশিষ্ট প্রাকৃতিক পার্বত্য বনভূমির মধ্যে সর্ববৃহৎ।
অভয়ারণ্যটি হবিগঞ্জ জেলার চুনারুঘাট উপজেলার অর্ন্তগত গাজীপুর ও রানীগাও ইউনিয়নে অবস্থিত।’ এ বনাঞ্চলটি ঢাকা থেকে আনুমানিক ১৩০ কিলোমিটার উত্তর পূর্ব দিকে এবং সিলেট থেকে ৮০ কিলোমিটার দক্ষিণ পশ্চিম দিকে অবস্থিত। বনাঞ্চলটি বাংলাদেশ-ভারত সীমান্ত বরাবর বিস্তৃত রয়েছে। অপেক্ষাকৃত দুর্গম স্থানে অবস্থিত বলে এই সমৃদ্ধ মিশ্র চিরহরিৎ বনটি এখনো টিকে রয়েছে। অভয়ারণ্যটির আশেপাশে রয়েছে ৩টি চা-বাগান।
এ অভয়ারণ্যটিকে ১৯৭৪ সালে বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ (সংশোধন) আইন অনুসারে প্রথমত ১৯৮২ সালে প্রতিষ্ঠা করে পরবর্তীতে ১৯৯৬ সালে একে সম্প্রসারণ করা হয়। রেমা কালেঙ্গা বন্যপ্রাণী অভয়ারণ্যে বিভিন্ন বিরল প্রজাতির উদ্ভিদ ও পশুপাখির আবাসস্থল এবং বিশেষ করে পাখি দর্শনের দেশের অন্যতম শ্রেষ্ঠ স্থান। পূর্ববতী জরিপে ৩৭ প্রজাতির স্তন্যপায়ী, ১৬৭ প্রজাতির পাখি, ৭ প্রজাতির উভচর, ১৮ প্রজাতির সরীসৃপ এবং ৬৩৮ প্রজাতির উদ্ভিদ ছিল। বিভিন্ন আদিবাসী সম্প্রদায়ের মধ্যে ত্রিপুরা, সাঁওতাল ও উড়াং এই বনভূমির আশেপাশে এবং অভ্যন্তরে বসবাস করে আসছে।
দৈনিক কলম কথা সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।