- তরুণরাই আক্রান্ত হচ্ছে বেশি,
- আইসিইউ শয্যা মিলছে না,
- সঠিকভাবে কোয়ারেন্টাইন মানার তাগিদ বিশেষজ্ঞদের!
দেশে হঠাৎ করে করোনা সংক্রমণ বেড়ে গেছে। স্বাস্থ্যবিধি না মানা এবং বিদেশফেরতরা যথাযথভাবে কোয়ারেন্টাইনে না থাকায় এমন অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে বলে জানিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা। নতুন করে আক্রান্তদের মধ্যে তরুণদের সংখ্যা বেশি। মৃতের হার বেশি বয়স্কদের।
এদিকে সংক্রমণের সংখ্যা বাড়ায় সরকারি-বেসরকারি হাসপাতালে আইসিইউ বেড পাওয়া দুষ্কর হয়ে পড়েছে। আরেকটি ভয়ংকর তথ্য হলো, করোনা রোগীদের চিকিত্সার জন্য যে আইসিইউ ম্যানেজমেন্ট প্রোটোকল আছে, তাতে কাজ হচ্ছে না। এতে চিকিত্সকরা বিব্রতকর অবস্থায় পড়ছেন। অনেকে ধারণা করছেন, করোনা ভাইরাসের যুক্তরাজ্যের নতুন যে ধরনটি (ক্ষিপ্ত প্রকৃতির) সেটি হয়তো বাংলাদেশে এসেছে।
বিদেশফেরতদের কোয়ারেন্টাইনে না রেখে ছেড়ে দিতে বড় জায়গা থেকে তদ্বির আসে। এ কারণে লন্ডন থেকে যারা দেশে এসেছেন, তাদের অনেকেরই যথাযথভাবে কোয়ারেন্টাইনে রাখা হয়নি। এ কারণে হয়তো করোনা ভাইরাসের লন্ডনের ধরনটি দেশে ছড়িয়ে পড়েছে।
- বিশেষজ্ঞ চিকিত্সকরা বলেন, আগে করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত রোগীদের দুই থেকে তিন সপ্তাহ পরে সাধারণত আইসিইউ প্রয়োজন হতো। কিন্তু বর্তমানে আক্রান্ত রোগী হাসপাতালে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই আইসিইউ ম্যানেজমেন্টে রাখার প্রয়োজন হচ্ছে। এটির সঙ্গে করোনা ভাইরাসের লন্ডনের ধরনটির মিল রয়েছে। এছাড়া রোগীরা দেরিতে হাসপাতালে যাওয়ার কারণেও হয়তো সঙ্গে সঙ্গে আইসিইউ সাপোর্টের প্রয়োজন পড়ছে। এমন অবস্থার মধ্যে ভয়ংকর পরিস্থিতিতে যাওয়ার আগেই করোনা নিয়ন্ত্রণে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়ার পরামর্শ দিয়ে বিশেষজ্ঞ চিকিত্সকরা বলেন, সবারই স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলতে হবে, মাস্ক পরতে হবে। বিদেশফেরতরদের সঠিকভাবে কোয়ারেন্টাইনে রাখতে হবে।
পরিস্থিতি আরও খারাপ হওয়ার আগেই বেশকিছু পরামর্শ মানার অনুরোধ করেছেন কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতালের অ্যানেস্থেসিওলজির অধ্যাপক ডা. শাহজাদ হোসাইন মাসুম। সম্প্রতি নিজের ফেসবুকে দেওয়া এক স্ট্যাটাসে তিনি এসব পরামর্শ দেন। এগুলোর মধ্যে রয়েছে— সব সামাজিক জমায়েত থেকে অসামাজিকভাবে দূরে থাকা; পরিবারের বয়োজ্যেষ্ঠদের নিরাপদে রাখা; গত বছর মার্চ মাসে যে সব সাবধানতা পালন করা হয়েছিল, সেগুলোই একইভাবে পালন করা; নিজে মাস্ক পরতে হবে, অন্যকেও পরতে বাধ্য করতে হবে; হাত সাবান দিয়ে বারবার ধোয়া, না পারলে স্যানিটাইজ করা এবং অপ্রয়োজনে বাড়ি থেকে বের হওয়া একদম বন্ধ করে দেওয়া।
স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক বলেন, করোনা সংক্রমণ একটু বাড়ছে। আগের মতো আবারও সারা দেশে চিকিত্সা সেবার সর্বাত্মক প্রস্তুতি রাখার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। সব হাসপাতাল প্রস্তুত রাখা হয়েছে। তিনি বলেন, টিকা নেওয়ার পরও স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলতে হবে। দুই ডোজ টিকা নেওয়ার পরও কারোর এন্টিবডি হতে পারে, আবার না-ও হতে পারে। এ কারণে করোনা নির্মূল না হওয়া পর্যন্ত সবার স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলতে হবে। মন্ত্রী আরো বলেন, অনেকে স্বাস্থ্যবিধি মানে না। জনসমাগম হচ্ছে, পর্যটন কেন্দ্রগুলোতে গিয়ে গাদাগাদি করে থাকছে। এ কারণে করোনা সংক্রমণ বাড়ছে। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. আবুল বাশার মোহাম্মদ খুরশীদ আলম বলেন, স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার কোনো বিকল্প নেই। করোনা থেকে রক্ষা পেতে হলে সবারই স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলতে হবে।প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ব্যক্তিগত চিকিত্সক অধ্যাপক ডা. এ বি এম আবদুল্লাহ বলেন, দেশে করোনা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাখতে হলে স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার বিকল্প নেই। যেসব দেশ স্বাস্থ্যবিধি মানেনি, সেসব দেশে করোনা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে গেছে। আমাদের দেশে এখন কেউ মাস্ক পরতে চায় না, স্বাস্থ্যবিধি মানতে চায় না। এ ব্যাপারে জনগণকে সচেতন হতে হবে।
কোভিড-১৯ বিষয়ক জাতীয় কারিগরি পরামর্শক কমিটির সদস্য, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ভিসি ও বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইরোলজি বিভাগের সাবেক চেয়ারম্যান অধ্যাপক ডা. নজরুল ইসলাম বলেন, লন্ডন থেকে যারা দেশে আসে তাদের তেমনভাবে কোয়ারেন্টাইনে রাখা হয়নি। যার খেসারত দিতে হচ্ছে। অথচ আমরা লন্ডনে গেলে দুই সপ্তাহ কোয়ারেন্টাইনে থাকতে হয়। তিনি বলেন, লন্ডন-আফ্রিকা থেকে যারা আসছেন তাদের সঠিকভাবে কোয়ারেন্টাইনে রাখার ব্যবস্থা করতে হবে। স্বাস্থ্যবিধি মানার ক্ষেত্রে প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনা অক্ষরে অক্ষরে পালন করতে হবে। মাস্ক ছাড়া মানুষ ঘুরে বেড়াচ্ছে। বিশেষ করে তরুণরা আক্রান্ত হচ্ছে বেশি। আর মারা যাচ্ছে বেশি বৃদ্ধরা। স্বাস্থ্যবিধি না মানলে ভবিষ্যতে ভয়ংকর অবস্থার সৃষ্টি হবে।
অধ্যাপক ডা. নজরুল ইসলাম বলেন, ‘শীতে আমাদের দেশে ইনফ্লুয়েঞ্জা-এ, প্যারা-ইনফ্লুয়েঞ্জা-থ্রি, রেসপিরেটরি সিনসিটিয়াল ভাইরাস (আরএসভি) ও রাইনোভাইরাস প্রবলভাবে থাকে। এগুলোর কারণেই শীতে সর্দি, কাশি, জ্বর ও নিউমোনিয়ার রোগী বেশি দেখা যায়। এসব ভাইরাস রেসপিরেটরি ভাইরাস। করোনাভাইরাসও একই। আর ভাইরাসের নিয়ম হচ্ছে, শরীরে যখন একটি ঢোকে, সেটা সহজে অন্য ভাইরাস ঢুকতে দেয় না। ঢুকলেও বের করে দেয়। এ কারণে দেশে শীতকালে করোনা সংক্রমণ কম ছিল। এখন শীত চলে গেছে। তাই করোনা হয়তো বাড়ছে।
আইইডিসিআরের প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা এ এস এম আলমগীর বলেন, এক সপ্তাহ ধরে করোনা সংক্রমণ বাড়ছে। এর অন্যতম কারণ জনসমাগম, বিভিন্ন অনুষ্ঠান ও পর্যটন কেন্দ্রগুলোতে স্বাস্থ্যবিধি না মানা। সব বিনোদন কেন্দ্র এখন উন্মুক্ত। পর্যটন কেন্দ্রের আশপাশের হোটেলে ঠাঁই নেই। মানুষ গাদাগাদি করে থাকছে। তিনি বলেন, করোনার দুই ডোজ নেওয়ার এক সপ্তাহ পর শরীরে এন্টিবডি তৈরি হয়। তাই সবারই স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলতে হবে। নইলে পরিস্থিতি ভয়াবহ হবে।
বাংলাদেশ সোসাইটি অব এনেসথেসিওলজিস্টের সভাপতি এবং বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের এনেসথেসিওলজি বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ডা. দেবব্রত বণিক বলেন, করোনা সংক্রমণ বাড়ায় এখন সরকারি-বেসরকারি হাসপাতালে আইসিইউ বেড পাওয়া কঠিন। আর করোনা রোগীদের জন্য যে আইসিইউ ম্যানেজমেন্ট প্রোটোকল আছে, তাতে কাজ হচ্ছে না। তিনি বলেন, এখনো সময় আছে, করোনা নিয়ন্ত্রণে দ্রুত ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। মানুষকে স্বাস্থ্যবিধি মানতে শুরুর দিকে যে ধরনের ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছিল, এখন সেই ধরনের ব্যবস্থা নিতে হবে।
ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল নাজমুল হক বলেন, হাসপাতালে আগের চেয়ে করোনা রোগী ভর্তি বেড়েছে। তবে হিমশিম খাওয়ার মতো পরিস্থিতি এখনো হয়নি। চিকিত্সাসেবা দিতে রোগীদের আইসিইউয়ের পাশাপাশি এসডিইউ ইউনিটে রাখা হচ্ছে।
মুগদা মেডিক্যাল কলেজের অধ্যক্ষ অধ্যাপক ডা. আহমেদুল কবীর বলেন, সরকারি-বেসরকারি হাসপাতালে আইসিইউ সিট পাওয়া যাচ্ছে না। করোনার দ্বিতীয় ওয়েব বলা চলে। কোয়ারেন্টাইন ও স্বাস্থ্যবিধি মানতে মানুষকে বাধ্য করতে হবে। নইলে ভয়ংকর পরিস্থিতি দেখা দেবে।
প্রসঙ্গত, যুক্তরাজ্যে বাইরের কোনো দেশ থেকে গেলে দুই সপ্তাহ কোয়ারেন্টাইনে রাখতে হয়। আমাদের দেশে প্রথম দিকে দুই সপ্তাহ রাখা হতো। পরে তা এক সপ্তাহ করা হয়। কেউ নিজ খরচে কোয়ারেন্টাইনে থাকতে চাইলে তারা হোটেলে থাকবেন সরকারের নিয়ন্ত্রণে। আর সরকারি খরচে হাজি ক্যাম্পে কোয়ারেন্টাইনে থাকতে হবে। এক সপ্তাহ পরে করোনা টেস্ট করা হয়। রিপোর্টে নেগেটিভ আসলে ছেড়ে দেওয়া হয়। আর পজিটিভ রিপোর্ট আসলে হাসপাতালে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। তবে বিশ্বের অন্যান্য দেশ থেকে যারা আসে সে সব যাত্রীর ক্ষেত্রে কেবল করোনামুক্ত সার্টিফিকেট আনলে ছেড়ে দেওয়া হয়।
টানা চার দিন শনাক্ত হাজারের বেশি
এদিকে দেশে টানা চতুর্থ দিনের মতো ১ হাজারের বেশি ব্যক্তির শরীরে করোনার সংক্রমণ শনাক্ত হয়েছে। গত ২৪ ঘণ্টায় (শুক্রবার সকাল ৮টা থেকে শনিবার সকাল ৮টা পর্যন্ত) ১ হাজার ১৪ জনের করোনা সংক্রমণ শনাক্ত হয়েছে। এ সময় করোনায় আরো ১২ জনের মৃত্যু হয়েছে। গতকাল শনিবার বিকালে সংবাদমাধ্যমে বিজ্ঞপ্তি পাঠিয়ে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর জানিয়েছে, গত এক দিনে মারা যাওয়া ১২ জনকে নিয়ে দেশে করোনা ভাইরাসে মোট ৮ হাজার ৫২৭ জনের মৃত্যু হলো। আর গত ২৪ ঘণ্টায় আরো ১ হাজার ১৪ জনের মধ্যে সংক্রমণ ধরা পড়ায় দেশে করোনা ভাইরাসে আক্রান্তের সংখ্যা বেড়ে ৫ লাখ ৫৬ হাজার ২৩৬ জন হয়েছে। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের হিসাবে বাসা ও হাসপাতালে চিকিত্সাধীন আরো ১ হাজার ১৩৮ জন রোগী সুস্থ হয়ে উঠেছেন গত এক দিনে। তাতে এ পর্যন্ত সুস্থ রোগীর মোট সংখ্যা বেড়ে ৫ লাখ ১০ হাজার ৩১০ জন হয়েছে।
ডেকক/এনপ্র
দৈনিক কলম কথা সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।