অধ্যাপক ডাক্তার রকিবুল আনোয়ার
গর্ভাবস্থায় কোষ্ঠকাঠিন্যঃ-
ইস্ট্রোজেন এবং প্রজেশ্টারোন দুই গুরুত্বপূর্ণ হরমোন গর্ভাবস্থায় গর্ভবতী মা ও সন্তানের জন্য অপরিহার্য ভূমিকা পালন করে; ভ্রƒণের প্রতিস্থাপন, বিকাশ এবং সফলতার সঙ্গে নবজাতকের জটিলতাবিহীন জন্ম এ হরমোনদ্বয়ের ওপর নির্ভরশীল।
যদিও গর্ভের সফলতার জন্য এ হরমোনদ্বয় অত্যাবশ্যকীয়, বিশেষভাব প্রজেশ্টারোন, গর্ভাবস্থায় নানাবিধ অস্বস্তিকর উপসর্গগুলোর সূচনার জন্যও দায়ী। গর্ভাবস্থায় পরিপাকতন্ত্রের ওপর প্রজেশ্টারোনের প্রভাব বিশেষভাবে লক্ষণীয়। প্রজেশ্টারোন পরিপাকতন্ত্রের মাংসপেশির শৈথিল্যের জন্য বহুলাংশে দায়ী। মাংসপেশির শৈথিল্য খাদ্য পরিপাক এবং পরিপাকতন্ত্রের মধ্য দিয়ে খাদ্যের পরিভ্রমণের সময় বাড়িয়ে দেয় এবং প্রাথমিকভাবে কোষ্ঠকাঠিন্যের সূচনা করে।
পরিপাকতন্ত্রের শৈথিলতা শুধু কোষ্ঠকাঠিন্যই নয়, কোষ্ঠকাঠিন্য সংশ্লিষ্ট জটিলতা, যেমন পাইলস, ফিশার, থ্রোম্বস্থ পাইলসের সূচনা করতে পারে। এছাড়াও পাকস্থলী ও ক্ষুদ্রান্ত্র মাংসপেশির শিথিলতা অজীর্ণ, বদহজম, অগ্নিমন্দার মতো অস্বাচ্ছন্দ্যদায়ক উপসর্গের সৃষ্টি করে।
গর্ভাবস্থায় এসব উপসর্গ অত্যন্ত স্বাভাবিক এবং গর্ভবতী মায়েদের এ জন্য লজ্জিত হওয়ার কোনো কারণ নেই।
কোষ্ঠকাঠিন্য স্বভাবতই শারীরিকভাবে অস্বস্তিকর, মলত্যাগ সময়বহুল, মল শক্ত এবং ছোট আকারের হয়, পেটে চাপ বা কোঁত দিতে হয়, মলত্যাগে স্বস্তি হয় না এবং মলত্যাগ প্রক্রিয়া অনেক সময়ই ক্লান্তিকর অনুভূত হয়। এছাড়াও কোষ্ঠকাঠিন্য তলপেট ও নিচের পিঠে ব্যথা, পেটফাঁপা, বমিবমি ভাবের উদ্রেক করা ইত্যাদি একক অথবা একসঙ্গে একাধিক উপসর্গ প্রদর্শন করতে পারে। একাধিক উপসর্গ একসঙ্গে প্রদর্শন কোষ্ঠকাঠিন্যের প্রবলতার ওপর নির্ভরশীল।
গর্ভাবস্থায় কোষ্ঠকাঠিন্য এতই স্বাভাবিক যে অন্যান্য লক্ষণের সঙ্গে সঙ্গে কোষ্ঠকাঠিন্যতাকেও গর্ভধারণের একটি লক্ষণ হিসেবে বিবেচনা করা যেতে পারে।
গর্ভকালীন কোষ্ঠকাঠিন্য নিরাময়ের জন্য বেশ কয়েকটি কার্যকরী চিকিৎসা আছে। এছাড়াও প্রতিকারের পাশাপাশি পরিপাকতন্ত্রের উপসর্গ পরিহার করতে আমি সব সময়ই স্বাস্থ্যকর খাদ্যাভাস অনুসরণ এবং সহজে অনুকরণযোগ্য জীবন-পদ্ধতি পরিবর্তনের উপদেশ দিয়ে থাকি। এ উপদেশগুলো গর্ভকালীন কোষ্ঠকাঠিন্য থেকে পরিত্রাণ পেতে সাহায্য করে।
আমার উপদেশগুলো
১। প্রচুর পানি পান করা।
২। ফাইবারসমৃদ্ধ স্বাস্থ্যকর খাবার খাওয়া, যেমন- ফাইবারযুক্ত বাদামি পাউরুটি, ফল, শাক-সবজি, ডাল ও মটরশুঁটি।
৩। একবারে অনেক খাবার একসঙ্গে খাবার পরিবর্তে অল্প করে সারাদিনে বেশ কয়েকবার খাওয়া অভ্যাস করা যা পরিপাকতন্ত্রের ওপর থেকে চাপ বা ধকল কমিয়ে দিতে সাহায্য করে।
৪। মনে রাখতে হবে ফাইবার বা আঁশযুক্ত খাবার বেশি খেলে খাবারের সঙ্গে সারাদিনে পানি পানের পরিমাণও বাড়িয়ে দিতে হবে।
জীবনপ্রণালী পরিবর্তনে আমার উপদেশ হবে-
১। অল্প করে কিন্তু নিয়ম করে প্রত্যেহ হালকা ব্যয়াম করা।
২। পিঠের নিুদেশে ওপর থেকে নিচে মর্দন করা।
৩। সকালে ঘুম থেকে ওঠার অথবা খাবার খাওয়ার পরপরই নিয়ম করে মলত্যাগের চেষ্টা করা। মলত্যাগের অনুভূতি এলে দেরি না করে মলত্যাগ করা।
গর্ভকালীন কোষ্ঠকাঠিন্য নিরাময়ের জন্য কার্যকর চিকিৎসা
১। স্বাস্থ্যকর খাবার এবং জীবন পদ্ধতি অনুসরণ করার পরেও যদি কোষ্ঠকাঠিন্য নিরাময় না হয় তাহলে ওষুধের প্রয়োজন হতে পারে। অবশ্য মনে রাখতে হবে যে কোনো ওষুধ মায়ের শরীরে প্রবেশ করলে ভ্রƒণ/পেটের বাচ্চার ওপর তার পতিক্রিয়া হতে পারে। আর তাই বিশেষজ্ঞের উপদেশ ছাড়া কোনো ওষুধ খাওয়া উচিত নয়।
বাংলাদেশে পশ্চিমা দেশগুলোর মতো এখন ধাত্রী বিদ্যায় শিক্ষিত মিডওয়াইফ প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা হয়েছে এবং মিডওয়াইফ দ্বারা গর্ভকালীন মায়েদের সেবার অনেক উন্নতি সাধন হয়েছে।
২। কোষ্ঠকাঠিন্য নিরাময়ের জন্য যেসব ওষুধ পরিপাকতন্ত্রে থেকে যায় কিন্তু রক্তে প্রবেশ করে না যেমন ল্যাক্টুলোজ, গর্ভকালীন মায়েদের ব্যবহারযোগ্য কিন্তু সেনা জাতীয় ওষুধ নয়। কোষ্ঠকাঠিন্যের ফলে পেটে ব্যথা হলে সবচেয়ে কম পরিমাত্রায় প্যারাসিটামল ট্যাবলেট ব্যবহার করা যেতে পারে শুধু স্বল্প সময়ের জন্য। কোষ্ঠকাঠিন্য যদি আরও জটিলতার সৃষ্টি করে তাহলে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের পরামর্শ গ্রহণ করা অত্যাবশ্যক।
এর পরের সংখ্যায় গর্ভকালীন মায়েদের পাইলস সম্পর্কে আলোচনার ইচ্ছা রাখি।
গর্ভকালীন মায়েদের পাইলস বা হিমোরয়েডস
পাইলস বা হিমোরয়েডস পায়ুপথ ও মলাশয়ের শেষ অংশে অবস্থিত গদি বা বালিশের ন্যায় রক্তনালিসমৃদ্ধ স্ফীত অংশ, যা পায়ুপথ দিয়ে মল নির্গমণ নিয়ন্ত্রণে সাহায্য করে। যদিও সব মানুষের স্বাভাবিক দেহের অংশ, শুধু উপসর্গ দেখা দিলেই ওই স্ফীত রক্তনালিসমৃদ্ধ অংশগুলোকে পাইলস বা হিমোরয়েডস বলা হয়ে থাকে। যদিও পাইলসের উপসর্গ যে কোনো মানুষের হওয়া সম্ভব গর্ভকালীন মায়েদের গর্ভকালীন হরমনের প্রভাবে পাইলস হওয়ার সম্ভাবনা অনেক বৃদ্ধি পায়, অনেক ক্ষেত্রেই পায়ুপথের বাইরে বেরিয়ে আসে এবং জটিলতার সম্ভবনা বহুলাংশে বেড়ে যায়।
পাইলসের যেসব উপসর্গ লক্ষণীয়
পায়ুপথে রক্ত যাওয়া সাধারণত টকটকে লাল, চুলকানি, বেদনা, জ্বালা অথবা পায়ুপথের চারিধারে ফোলা, মলত্যাগের সময়ে পায়ুপথে ব্যথা অনুভব করা এবং মলত্যাগের পর শ্লেষা নির্গমন, এক বা একাধিক পাইলস পায়ুপথের বাইরে বেরিয়ে আসা যেগুলো স্বতঃস্ফূর্তভাবে মলত্যাগের পর পায়ুপথের মধ্যে ফিরে যায় অথবা চাপ দিয়ে ভিতরে পৌঁছে দিতে হয়। অনেক ক্ষেত্রে পাইলসগুলো সব সময়ে বাইরেই অবস্থান করে।
কোষ্ঠকাঠিন্য পাইলসের উপসর্গ সৃষ্টি করে ও বৃদ্ধি করে এবং তাই কোষ্ঠকাঠিন্য পাইলসের সঙ্গে থাকলে তার চিকিৎসা অত্যন্ত জরুরি। ওষুধের মাধ্যমে চিকিৎসার আগে অথবা পাশাপাশি কোষ্ঠকাঠিন্য ও পাইলসের উপসর্গ পরিহার করতে আমি সব সময়ই স্বাস্থ্যকর খাদ্যাভাস অনুসরণ এবং সহজে অনুকরণযোগ্য জীবন-পদ্ধতি পরিবর্তনের উপদেশ দিয়ে থাকি। এ উপদেশগুলো গর্ভকালীন কোষ্ঠকাঠিন্য এবং পাইলস থেকে পরিত্রাণ পেতে সাহায্য করে। এ উপদেশগুলো আমি আগেই কোষ্ঠকাঠিন্য সম্পর্কে আলোচনার সময় বিশেষভাবে উল্লেখ করেছি।
গর্ভকালীন সময়ে বেশিক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকা অথবা টয়লেটে বেশি সময় বসে থাকা সমীচীন নয়। অনেক সময় কাপড় বরফযুক্ত পানিতে ভিজিয়ে খুব হাল্কাভাবে পাইলসে চেপে রাখলে আরাম পাওয়া যেতে পারে। পাইলস বেরিয়ে এলে সাবধানতার সঙ্গে পিচ্ছিল লুবরিকেন্ট জেলি দিয়ে ভেতরে ঢোকানোর চেষ্টা করতে হবে। মলত্যাগের সময় অযথা চাপ বা কোঁত দেয়া পরিহার করতে হবে। মলত্যাগের পর শুষ্ক কাগজের পরিবর্তে ভেজা কাগজ দিয়ে হাল্কা ছোঁয়ার মাধ্যমে পরিষ্কার করতে হবে।
পাইলস ফুলে বা বেরিয়ে থাকলে ওমা গরম পানিতে পাইলস ডুবিয়ে বসলে অনেক সময় আরাম লাগতে পারে। উপসর্গ বেশি হলে ডাক্তার বা মিডওয়াইফের সঙ্গে পরামর্শ করে প্রদাহনাশক ক্রিম বা অয়েন্টমেন্ট ব্যবহার করতে পারা যাবে। ডাক্তার বা মিডওয়াইফের সঙ্গে পরামর্শ ছাড়া কোনো ওষুধ ব্যবহার করা উচিত হবে না। জীবন সংকটময় জটিলতা না হলে গর্ভকালীন সময়ে সার্জারি বা শল্যচিকিৎসা পরিহার করা হয় কারণ বাচ্চার জন্মের পরে সাধারণত পাইলস উপসর্গের উন্নতি হয়। বাচ্চা জন্মের পর যাদের গর্ভাবস্থায় পাইলস ছিল তাদেরকে ডাক্তারের অথবা মিডওয়াইফের কাছে পুনঃপরামর্শ গ্রহণ করা উচিত।
দৈনিক কলম কথা সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।