সাধারণত শীত মৌসুমে দেশে ফ্লু-জাতীয় রোগের প্রকোপ বাড়ে। এ বছরও তার ব্যতিক্রম নয়। পাশাপাশি বেড়েছে নভেল করোনাভাইরাসের সংক্রমণ। সব মিলিয়ে বেড়ে গেছে জরুরি ওষুধের চাহিদা। যেহেতু কভিড-১৯-এর উপসর্গগুলো ফ্লু-জাতীয় রোগের মতো, তাই এ রোগ নিরাময়েও ফ্লুর প্রচলিত ওষুধগুলোই সেবন করছে সাধারণ মানুষ। ফলে বছরের শুরুতে ঠাণ্ডা-সর্দি-কাশির মতো মৌসুমি রোগ, বায়ুপ্রবাহে বাধা ও শ্বাস-প্রশ্বাসসংক্রান্ত সমস্যার (সিওপিডি) ওষুধ ও ব্যবস্থাপত্র ছাড়া কেনা যায় এমন ওষুধের চাহিদা দেশজুড়ে বেড়েছে। ৪০-৫০ শতাংশ চাহিদা বাড়লেও পর্যাপ্ত জোগান রয়েছে বলে জানিয়েছে ওষুধ উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানগুলো।
প্রায় চার মাস নিম্নমুখী থাকার পর গত বছরের ডিসেম্বরের শেষার্ধ থেকে সারা দেশে আবারো বাড়তে শুরু করে করোনাভাইরাসের সংক্রমণ। বর্তমানে দেশে এক লাখের বেশি সক্রিয় কভিড-১৯ রোগী রয়েছে, যাদের ৯৫ শতাংশের বেশি বাড়িতে বসেই চিকিৎসা নিচ্ছে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, করোনাভাইরাসের সংক্রমণ বাড়ার কারণে উপসর্গভিত্তিক জরুরি ওষুধের চাহিদাও বেড়েছে।
দেশের বেশ কয়েকটি ওষুধ প্রস্তুতকারক ও উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, চাহিদা বাড়ার সারিতে প্রথমেই রয়েছে প্যারাসিটামল জেনেরিকের ওষুধ। মৌসুমি জ্বর, সর্দি ও ঠাণ্ডার কারণে এ ওষুধের চাহিদা বেড়েছে। আগের চেয়ে প্রায় ৩০০ শতাংশ চাহিদা বেড়েছে ওষুধটির। একই সঙ্গে সর্দি, চর্মরোগের জন্য অ্যান্টি-হিস্টামিন (ওরাল) জেনেরিক ওষুধের চাহিদাও তিন গুণের মতো বেড়েছে। ভিটামিন সি ও ডির চাহিদা ৭০ শতাংশের ওপরে। আর অ্যান্টি-অ্যাজমার ওষুধের চাহিদা ১০০ শতাংশ বেড়েছে। বায়ুপ্রবাহে বাধা ও সিওপিডির যেসব ওষুধ প্রয়োজন হয় তার চাহিদা মূলত ৩০০ শতাংশের বেশি রয়েছে।
রাজধানীসহ সারা দেশের বেশ কয়েকটি ওষুধের বিপণিবিতানে খোঁজ নিয়ে জানা যায়, শরীরব্যথা, গলাব্যথা, ঠাণ্ডা, জ্বর এসব সমস্যা সমাধানের ওষুধের চাহিদা গত মাসের চেয়ে ৪০ শতাংশের বেশি বেড়েছে। সঙ্গে গ্যাস্ট্রিকের ওষুধের চাহিদাও বাড়তি। রাজধানীর পান্থপথে একটি ওষুধের দোকানের স্বত্বাধিকারী রশিদ ফারদিন বণিক বার্তাকে বলেন, প্রতি ১০ জন ক্রেতার মধ্যে আটজনই মৌসুমি রোগ ও কভিডের উপসর্গ অনুযায়ী ওষুধ কিনছে। চাহিদা অনুযায়ী জোগান রয়েছে। তবে কখনো কখনো অতিরিক্ত চাহিদার কারণে এসব ওষুধ পেতে সময় লেগে যাচ্ছে। তার সঙ্গে যখন কথা হচ্ছিল তখনো প্যারাসিটামল ও অ্যান্টি-হিস্টামিন জেনেরিক ওষুধের জন্য দোকানটিতে ক্রেতার ভিড় দেখা যায়।
তবে এ বছর এখনো কভিড আক্রান্ত সংকটাপন্ন রোগীর জন্য জরুরি ওষুধের চাহিদা তেমন বাড়েনি বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা। করোনা আক্রান্ত রোগীদের ফুসফুসের সংক্রমণ রোধে প্রয়োগ করা হয় মক্সিফ্লক্সাসিন জেনেরিকের ইনজেকশন ও ওরাল ওষুধ। গত বছরের আগস্টে ওষুধটির চাহিদা স্বাভাবিক সময়ের চেয়ে ১০ গুণ বেড়েছিল। সে সময় স্বাভাবিকের চেয়ে তিন-চার গুণ চাহিদা বেড়েছিল বিভিন্ন ভিটামিনের সংমিশ্রণে তৈরি ভাইডালিন ইনজেকশনের। দেশের একটি মাত্র প্রতিষ্ঠান ইনজেকশনটি উৎপাদন করায় তখন ঘাটতি দেখা গিয়েছিল। সংকটাপন্ন করোনা রোগীদের রক্ত চলাচল স্বাভাবিক রাখতে এনোক্সপেরিন ইনজেকশনের মাধ্যমে রোগীর শরীরে প্রয়োগ করা হয়। গত বছর ওষুধটির চাহিদাও ১০ গুণ বেড়েছিল। ফলে বেশ সংকট তৈরি হয়।
এ বছর এখন পর্যন্ত এসব ওষুধের চাহিদা বাড়েনি। তবে করোনা পরিস্থিতির অবনতি হলে চাহিদা বাড়তে পারে। সে কারণে আগে থেকেই প্রস্তুতি রাখার পরামর্শ দিচ্ছেন সংশ্লিষ্টরা।
এ বিষয়ে স্কয়ার ফার্মাসিউটিক্যালসের বিপণন বিভাগের মহাব্যবস্থাপক আতিকুজ্জামান বণিক বার্তাকে বলেন, করোনা রোগীদের মাধ্যমিক পর্যায়ের জটিলতা ঠেকাতে অ্যান্টিব্যাকটেরিয়াল অ্যাজিথ্রোমাইসিন ইনজেকশন প্রয়োগ ও ওরাল ওষুধ সেবন করানো হয়। বর্তমানে বিভিন্ন অ্যান্টিবায়োটিকের সঙ্গে এ ওষুধের চাহিদা দ্রুতগতিতে বাড়ছে। সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণে আনতে কার্যকরী এ ওষুধের চাহিদা বেড়েছে দ্বিগুণ।
কিছু নির্দিষ্ট ওষুধের চাহিদা বেড়েছে জানিয়ে এ কর্মকর্তা বলেন, তবে জোগানে ঘাটতি হওয়ার মতো পরিস্থিতি এখনো সৃষ্টি হয়নি। সারা দেশের চেয়ে ঢাকায় চাহিদা বেশি বেড়েছে। ওষুধের চাহিদা আরো বাড়লেও সংকট হবে না। আমরা স্থানীয় ও আন্তর্জাতিক বাজারেও চাহিদার বিষয় বিবেচনা করে উৎপাদন করি। আমাদের আরো উৎপাদনের সক্ষমতা রয়েছে।
এদিকে সংকটাপন্ন করোনা রোগীদের চিকিৎসায় রেমডিসিভির ইনজেকশন প্রয়োগ নিয়ে পক্ষে-বিপক্ষে মত রয়েছে। ওষুধটি প্রয়োগের ফলে শুধু হাসপাতালে থাকার সময়ই বাড়ে বলে বিভিন্ন গবেষণায় দাবি করা হয়েছে। তবে গত বছর ডেল্টার সংক্রমণ বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে এর চাহিদা অনেক বেড়েছিল। সরকারিভাবেও কিনে হাসপাতালের রোগীদের দেয়া হয়েছিল। এর মধ্যে গত আগস্টে ওষুধটি কিনতে গিয়ে জোগানস্বল্পতায় বিপাকে পড়েছিল সরকারের কেন্দ্রীয় ঔষধাগার (সিএমএসডি)। এখন দেশের আটটি প্রতিষ্ঠান রেমডিসিভির উৎপাদন করছে। প্রতিষ্ঠানভেদে ২ থেকে ৫ হাজার টাকা নির্ধারিত মূল্যের বাইরে সে সময় অতিরিক্ত দাম রাখতে দেখা যায় ফার্মেসিগুলোকে। একইভাবে সংকটাপন্ন করোনা রোগীদের শরীরে টসিলিজুমাব জেনেরিকের একটেমরা ইনজেকশন জরুরি। দেশীয় কোনো প্রতিষ্ঠান ওষুধটি উৎপাদন না করলেও এ জেনেরিকের ভিন্ন ওষুধ রয়েছে। তবে গত বছরের মাঝামাঝিতে সুইজারল্যান্ডের ওষুধ প্রস্তুতকারক প্রতিষ্ঠান রোসের একটেমরার সর্বোচ্চ চাহিদা ছিল। চাহিদা ও আমদানিতে ঘাটতি থাকায় উচ্চমূল্যে ওষুধটি বিক্রি হতে দেখা যায়।
চিকিৎসকরা বলছেন, করোনা রোগীদের চিকিৎসার জন্য নির্দিষ্ট কোনো ওষুধ নেই। উপসর্গ অনুযায়ী বিভিন্ন ওষুধ দেয়া হয়। এতে রোগীর সংখ্যা বাড়লে স্বাভাবিকভাবেই ওষুধের চাহিদা বাড়তে থাকে। তবে বর্তমানে করোনা নিয়ে মানুষের মধ্যে উদ্বেগ ও ভীতি থাকায় কেউ কেউ এসব ওষুধ বেশি করে কিনছে। চিকিৎসকের পরামর্শ ছাড়া ওষুধ সেবনের ফলে বড় ধরনের ক্ষতির শঙ্কা রয়েছে। শ্বাস প্রদাহের (আরটিআই) জন্য বিভিন্ন ইনজেকশন ও ওরাল ওষুধের চাহিদা বেড়েছে।
ওষুধের চাহিদা বৃদ্ধিকে স্বাভাবিকভাবেই দেখছেন বিকন ফার্মাসিউটিক্যালসের ফার্মাসিউটিক্যাল পণ্য ব্যবস্থাপনা বিভাগের উপব্যবস্থাপক মাসুদ বিল্লাহ। তিনি বলেন, স্বাভাবিকভাবেই ওষুধের চাহিদা বেড়েছে। প্রতি বছরই ডিসেম্বর ও জানুয়ারিতে ওষুধের চাহিদা মৌসুমি আবহাওয়ার কারণে বাড়ে। দুই বছর ধরে তার সঙ্গে যুক্ত হয়েছে কভিড সংক্রমণ। তবে জোগানে ঘাটতির মতো পরিস্থিতি হবে না। আমাদের উৎপাদন ও বিপণন সক্ষমতা ভালো।
মানুষ ভয়ের কারণে বেশি ওষুধ সেবন করছে বলে মনে করছেন ল্যাবএইড গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ডা. এএম শামীম। তিনি বলছেন, ওষুধের চাহিদা বেড়েছে। তবে বেশির ভাগ ক্ষেত্রে দেখা যায়, মানুষ আতঙ্কিত হয়ে ওষুধ গ্রহণ করছে। যারা বাসায় থাকছে তাদের মধ্যে এ প্রবণতা বেশি। আমরা দেখেছি, অনেক ক্ষেত্রে বেশি পরিমাণে ওষুধ প্রয়োগের ফলে বিভিন্ন ধরনের শারীরিক জটিলতা সৃষ্টি হয়েছে। ফাঙ্গাসের সংক্রমণও হতে দেখা গেছে।
বাংলাদেশ ওষুধ শিল্প সমিতির (বিএপিআই) তথ্য বলছে, দেশে ওষুধ প্রস্তুতের জন্য দুই ধরনের কাঁচামাল আমদানি করা হয়। একটি হলো কাঁচামাল তৈরির প্রয়োজনীয় উপাদান এবং আরেকটি হলো সরাসরি ব্যবহার করা হয় এমন কাঁচামাল। এসব কাঁচামালের বেশির ভাগই চীন থেকে আমদানি করা হয়। সম্প্রতি চীন থেকে এর সরবরাহ সংকট রয়েছে। বেশি দামে এসব কাঁচামাল আমদানি করা হয়। তবে প্রতিষ্ঠানগুলো বেশি দামে কাঁচামাল আনলেও ওষুধের দাম বাড়াচ্ছে না বলে মন্তব্য করেন বি এপিআই মহাসচিব এসএম শফিউজ্জামান। তিনি বণিক বার্তাকে বলেন, আমরা সরকারের কাছে আবেদন করেছি, যেন সরকার খোঁজখবর নিয়ে দাম সমন্বয় করার ক্ষেত্রে পদক্ষেপ নেয়। বর্তমানে ওষুধের চাহিদা অস্বাভাবিক নয়। গত মাসের চেয়ে ৩০-৪০ শতাংশ চাহিদা বেড়েছে।
চাহিদা বাড়লেও কোনো ধরনের অস্থিতিশীল পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়নি বলে দাবি করছে ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তর। অধিদপ্তরের উপপরিচালক মো. অজিউল্লাহ বলেন, ওষুধের চাহিদা ও সরবরাহ পর্যবেক্ষণের জন্য সারা দেশে আমাদের লোকবল রয়েছে। কোনো সংকট নেই। সংকট সৃষ্টি হলে আমরা ওষুধ প্রস্তুতকারক প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে কথা বলে দ্রুত সরবরাহের ব্যবস্থা করব। কোনো উপসর্গভিত্তিক চিকিৎসার জন্য ওষুধের সংকট যেন সৃষ্টি না হয় সে বিষয়ে আমরা সতর্ক।
দৈনিক কলম কথা সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।