বিভিন্ন রকমের খাদ্যদ্রব্য ও ফিজি ড্রিঙ্কের মতো কোমল পানীয়তে অ্যাসপার্টেম নামের যে সুইটেনার বা কৃত্রিম চিনি ব্যবহার করা হয় তা অতিরিক্ত মাত্রায় গ্রহণ করলে এই রাসায়নিক পদার্থ মানুষের দেহে ক্যান্সারের কারণ হতে পারে বলে বিজ্ঞানীরা সতর্ক করে দিয়েছেন।


এ কারণে দিনে সর্বোচ্চ কতোটুকু অ্যাসপার্টেম গ্রহণ করা যেতে পারে সেবিষয়ে আন্তর্জাতিক স্বাস্থ্য গবেষকদের পক্ষ থেকে কিছু সুপারিশ করা হয়েছে।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার বিশেষজ্ঞদের দুটো গ্রুপ এসংক্রান্ত হাজার হাজার বৈজ্ঞানিক গবেষণার ফলাফল পর্যালোচনা করে দেখছেন। ইতোমধ্যেই তারা ঘোষণা করেছেন যে এটি হয়তো ক্যানসারের কারণ হতে পারে।
তারা বলছেন, কত মাত্রায় অ্যাসপার্টেম গ্রহণ করলে ‘ক্যানসার হতে পারে’ তা নিয়ে মানুষের মধ্যে প্রায়শই ভীতি ও বিভ্রান্তি তৈরি হয়।

বেশির ভাগ মানুষই যতটুকু মাত্রায় খাওয়া নিরাপদ, তার চেয়ে কম পরিমাণে অ্যাসপার্টেম সুইটেনার গ্রহণ করে থাকে। তবে যারা বেশি মাত্রায় এই কৃত্রিম চিনি গ্রহণ করেন, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা তাদেরকে এর পরিমাণ কমিয়ে আনার সুপারিশ করছে।

চিনিমুক্ত খাবার ও ডায়েট পানীয়তে এই অ্যাসপার্টেম ব্যবহার করা হয়। কারণ এই রাসায়নিক পদার্থটি চিনির চেয়েও ২০০ গুণ বেশি মিষ্টি।
ডায়েট কোক, কোক জিরো, পেপসি ম্যাক্স এবং সেভেন আপ ফ্রির মতো বিখ্যাত সব ব্র্যান্ডে এই কৃত্রিম চিনি অ্যাসপার্টেম ব্যবহার করা হয়। এছাড়াও আরো প্রায় ছয় হাজারের মতো পণ্যে এই রাসায়নিক পদার্থটি ব্যবহার করা হয় যার মধ্যে রয়েছে টুথপেস্ট ও চুইং গাম থেকে শুরু করে দই পর্যন্ত।
অ্যাসপার্টেমের ব্যবহার শুরু হয় ১৯৮০-এর দশকে। এর পর এটি বিভিন্ন পণ্যে ব্যাপকভাবে ব্যবহার করা শুরু হয়। কিন্তু স্বাস্থ্যের জন্য এই রাসায়নিক কতোটা নিরাপদ তা নিয়ে তখন থেকেই বিতর্ক ছিল।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার পুষ্টি ও খাদ্য নিরাপত্তা বিভাগের পরিচালক ড. ফ্রান্সেসকো ব্রাঙ্কার কাছে বিবিসির জেমস গ্যালাহার জানতে চেয়েছিলেন, কোনটা স্বাস্থ্যকর : চিনি না কি সুইটেনার?

এই প্রশ্নের জবাবে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার ওই বিশেষজ্ঞ বলেন, ‘চিনিযুক্ত কোলা না কি সুইটেনার দেওয়া কোলা, কোনটা ভালো এবিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতে গেলে, আমি মনে করি সেখানে একটা তৃতীয় অপশন থাকা উচিত। এসবের পরিবর্তে আমি পানি পান করতে বলবো যাতে সবমিলিয়ে মিষ্টিজাতীয় খাদ্য গ্রহণের পরিমাণ কমিয়ে আনা যায়।’

তিনি বলেন, বৈজ্ঞানিক গবেষণায় এখনো পর্যন্ত যেসব পর্যালোচনা হয়েছে তাতে অ্যাসপার্টেম যে স্বাস্থ্যের জন্য ভালো নয় সে বিষয়ে ‘সতর্ক হওয়া’ প্রয়োজন হয়ে পড়েছে।

তবে তিনি বলেন, যারা মাঝেমধ্যে সুইটেনার দেওয়া পানীয় বা খাদ্য গ্রহণ করেন তাদের এ বিষয়ে ‘উদ্বিগ্ন হওয়ার প্রয়োজন নেই’, কিন্তু ‘যারা বেশি পরিমাণে গ্রহণ করেন সমস্যাটা তাদের।’

এ বিষয়ে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার ক্যান্সার বিশেষজ্ঞদের যে দলটি তথ্যপ্রমাণ বিশ্লেষণ কর দেখছে সেটি হচ্ছে, ক্যানসার গবেষণা সংক্রান্ত আন্তর্জাতিক সংস্থা ইন্টারন্যাশনাল এজেন্সি ফর রিসার্চ অন ক্যানসার বা আইএআরসি।
এই সংস্থাটি ক্যানসারের সম্ভাব্য কারণ হিসেবে চারটি শ্রেণির কথা উল্লেখ করেছে:

এই শ্রেণিতে দেখা যাচ্ছে, অ্যাসপার্টেম ক্যানসারের ‘সম্ভাব্য কারণের’ ঘরে চলে এসেছে। এই ঘরে আলোভেরা এবং সীসার মতো আরো কিছু পণ্যও রয়েছে যেগুলো ক্যান্সারের সম্ভাব্য কারণ হতে পারে।

মূলত তিনটি গবেষণার ফলাফল থেকে এই সিদ্ধান্তে আসা গেছে যেখানে এসবের সঙ্গে এক ধরনের লিভার ক্যান্সারের ‘সম্ভাব্য’ যোগসূত্র পাওয়া গেছে।

তবে এই ‘সম্ভাব্য’ বলতে বৈজ্ঞানিক তথ্যপ্রমাণ কতোটা শক্তিশালী শুধু সেটা বোঝানো হয়েছে। তথ্যপ্রমাণ যদি আরও শক্তিশালী হতো তাহলে অ্যাসপার্টেম আরও ওপরের ঘরে চলে যেত।

আইএআরসির একজন গবেষক ড. ম্যারি শুবাওয়ার-বেরিগান বলেছেন, ‘যেসব তথ্য প্রমাণ পাওয়া গেছে সেগুলো যথেষ্ট উচ্চ মানের অথবা বিশ্বাসযোগ্য নয় এবং সুইটেনার বা কৃত্রিম চিনির বিষয়ে জানতে হলে গবেষকদের এবিষয়ে আরো কাজ করতে হবে।’

ক্যানসারের সম্ভাব্য কারণের এই শেণি-বিন্যাস থেকে প্রায়শই বিভ্রান্তিকর শিরোনাম তৈরি হয়। অ্যালকোহল এবং প্লুটোনিয়াম এই একই শ্রেণিতে পড়ে (এই দুটো যে ক্যানসারের কারণ তা প্রমাণিত), কিন্তু এর একটি অন্যটির চেয়ে অনেক বেশি বিপজ্জনক।

এ কারণে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা এবং জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষিবিষয়ক সংস্থার বিশেষজ্ঞদের নিয়ে গঠিত যৌথ একটি কমিটি ঠিক কত মাত্রায় কৃত্রিম চিনি বা সুইটেনার গ্রহণ করা নিরাপদ সেটা খুঁজে বের করার জন্য কাজ করছে।

এই কমিটি ক্যানসারের ঝুঁকিসহ হৃদরোগ ও টাইপ টু ডায়াবেটিসের মতো আরো কিছু রোগ বিশ্লেষণ করে দেখেছে, কিন্তু ১৯৮১ সালে অ্যাসপার্টেম ব্যাবহারের বিষয়ে যে সুপারিশ করা হয়েছিল, তাতে পরিবর্তন আনার জন্য ‘যথেষ্ট কারণ’ খুঁজে পায়নি।

এই নিরাপদ সীমা হচ্ছে, আপনার শরীরের যে ওজন তার প্রত্যেক কেজির জন্য প্রতি দিন আপনি ৪০ মিলিগ্রাম অ্যাসপার্টেম সুইটেনার গ্রহণ করতে পারেন।

গবেষকরা বলছেন, এই পরিমাণ অ্যাসপার্টেম গ্রহণ করা কারো লক্ষ্য হওয়া উচিত নয়, এটা হচ্ছে নিরাপদ স্বাস্থ্যের জন্য অ্যাসপার্টেম গ্রহণের সর্বোচ্চ সীমা। তবে এই সুপারিশ যেহেতু দেহের ওজনের ভিত্তিতে করা হয়েছে, তাই শিশুরা খুব সহজেই সর্বোচ্চ সীমার কাছাকাছি পৌঁছে যেতে পারে।
ড. ব্রাঙ্কা বলছেন, কোনো পরিবার যখন খেতে বসে তখন তাদের খাওয়ার টেবিলে মিষ্টি ফিজি ড্রিঙ্কের বোতল রাখা ‘ভালো কিছু নয়,’ কারণ এর ফলে শিশুরা মিষ্টির প্রতি আসক্ত হয়ে পড়তে পারে।

তিনি জোর দিয়ে বলেছেন, চিনির পরিবর্তে সুইটেনার গ্রহণ করলে যে মানুষের ওজন কমে যায় সেবিষয়েও নিশ্চিত করে কিছু প্রমাণিত হয়নি।
এ কারণে তার উপদেশ হচ্ছে, মিষ্টিজাতীয় খাদ্য কম খাওয়া। অর্থাৎ চিনি এবং সুইটেনার দুটোই কমিয়ে দেওয়া। তিনি বলেন এজন্য বিভিন্ন কোম্পানির সামনে চ্যালেঞ্জ হচ্ছে – কম মিষ্টি এরকম খাদ্য তৈরি করা যা একই সাথে সুস্বাদু হবে।

অ্যাসপার্টেম যদি ক্যানসারের কারণও হয়, সেটি কিভাবে এর জন্য দায়ী এবিষয়ে আরও গবেষণার প্রয়োজন। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার রিপোর্টে দেখা গেছে পাকস্থলীতে অ্যাসপার্টেম ভেঙে তিনটি পদার্থে পরিণত হয়- ফেনিলালানাইন, অ্যাস্পার্টিক এসিড এবং মিথানল।

তবে আরও অনেক খাবার হজম করার জন্যও এগুলোর প্রয়োজন। এসবের সঙ্গে ক্যানসারের কোনো সম্পর্ক নেই। গবেষকরা আরও বলছেন অ্যাসপার্টেম মানবদেহের ডিএনএতে সরাসরি এমন কোনো পরিবর্তন ঘটায় না যার ফলে ক্যান্সার হতে পারে। তবে এর ফলে শরীরের প্রদাহের মাত্রা বেড়ে যেতে পারে।

ইন্টারন্যাশনাল সুইটেনার্স অ্যাসোসিয়েশনের মহাসচিব ফ্রান্সেস হান্ট-উড বলছেন, ‘এই গবেষণা অ্যাসপার্টেম গ্রহণ কতটা নিরাপদ সেটা আবারও নিশ্চিত করেছে।’

তিনি বলেন, ‘পরিপূর্ণ ডায়েটের অংশ হিসেবে যখন অ্যাসপার্টেমের মতো অল্প কিম্বা শূন্য ক্যালোরির সুইটেনার ব্যবহার করা হয়, তখন ভোক্তারা তাদের চিনি গ্রহণের মাত্রা কমানোর একটা সুযোগ পান যা জনস্বাস্থ্যের জন্য খ্বু জরুরি।’

তবে কিছু কিছু লোক আছে যাদের জন্য অ্যাসপার্টেম গ্রহণ করা নিরাপদ নয়। তাদের মধ্যে রয়েছে বংশগতভাবে পাওয়া পিকেইউ রোগী যারা অ্যাসপার্টেম ভেঙে তৈরি হওয়া ফেনিলালানাইন হজম করতে পারে না।
সূত্র : বিবিসি