শুধু পাকিস্তানেই নয়, গোটা ক্রিকেট ইতিহাসে এক অনন্য নাম ইমরান খান। তার নেতৃত্বে ১৯৯২ সালে পাকিস্তানের ক্রিকেট বিশ্বকাপ জয় এখনো পাকিস্তানকে স্বতন্ত্রভাবে পরিচয় করিয়ে দেয়। সর্বকালের সেরা অলরাউন্ডার হিসেবে এখনো তার কৃতিত্ব লিপিবদ্ধ আছে আইসিসি (ইন্টারন্যাশনাল ক্রিকেট কাউন্সিল) ক্রিকেট হল অফ ফেম-এ। ক্রিকেট ক্যারিয়ারে ইস্তফা দিয়ে তিনি রাজনীতির সঙ্গে জড়িয়ে নেন নিজেকে। পাকিস্তানের জাতীয় ক্রিকেট দলনেতা থেকে নিজেকে পুরো বদলে ফেলে পরিণত করেছেন একজন পেশাদার রাজনীতিবিদ-এ। ২০১৮ সালে তিনি পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শপথ গ্রহণ করেন। ২০২২ সালের ১০ এপ্রিল অনাস্থা ভোটে হেরে তিনি প্রধানমন্ত্রীত্ব থেকে অপসারিত হন। এর বাইরে থাকা ব্যক্তি ইমরানের ঘটনাবহুল জীবন নিয়ে আজকের ফিচার।

খান ১৯৫২ সালের ৫ অক্টোবর লাহোরে জন্মগ্রহণ করেন। বাবা সিভিল ইঞ্জিনিয়ার ইকরামুল্লাহ খান নিয়াজী এবং মা শওকত খানম। তাদের পাঁচ ছেলেমেয়ের মধ্যে ইমরান দ্বিতীয় ও একমাত্র পুত্র। বড় বোন রুবিনা খানম এবং ছোট তিন বোন আলিমা খানম, উজমা খানব ও রানি খানম। বাবা-মা দুজনেই প্যাশতোন বংশোদ্ভূত। বাবার দিক থেকে ইমরান ১৬ শতকের সুলতান শের শাহ সুরির প্রধান সেনাপতি ও পাঞ্জাবের তৎকালীন গভর্নর হাইবত খান নিয়াজির বংশধর। অন্যদিকে মায়ের দিক থেকে তিনি সুফি, যোদ্ধা, কবি ও প্যাশতোন বর্ণমালার উদ্ভাবক পীর রোশানের বংশধর।

তার চাচাতো ভাই জাভেদ বুরকি এবং মজিদ খান ক্রিকেটার ছিলেন। শান্ত ও লাজুক ছেলে ইমরান খান বেড়ে উঠেছেন সচ্ছল ও উচ্চ-মধ্যবিত্ত পরিবারে।

ইমরান খান লাহোরের আইচিসন কলেজ, ক্যাথেড্রাল স্কুল এবং পরবর্তীতে ইংল্যান্ডের রয়্যাল গ্রামার স্কুল ওরচেস্টারে পড়াশোনা করেছেন। এই ওরচেস্টারেই তার ক্রিকেটের হাতেখড়ি হয়। ১৯৭২ সালে তিনি অক্সফোর্ডের কেবল কলেজে ভর্তি হন। কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে প্রত্যাখাত হওয়ার পর কেবল কলেজ একজন ক্রিকেট উৎসাহী পল হেইসের সহায়তায় তিনি এই কলেজে ভর্তি হতে পারেন। অতঃপর এখান থেকেই ১৯৭৫ সালে তিনি দর্শন, রাজনীতি এবং অর্থনীতিতে স্নাতক সম্পন্ন করেন।

ক্রিকেটে সুনামের রেশ ধরে ইমরান খান সেলিব্রিটি ব্র্যান্ড এন্ডোর্সার হিসাবে অনেক বিজ্ঞাপন এবং টেলিভিশন বিজ্ঞাপনে অভিনয় করেছিলেন। এর মধ্যে পেপসি পাকিস্তান, ব্রুক বন্ড, থামস আপ এবং ভারতীয় সাবান ব্র্যান্ড সিন্থোল অন্যতম। পাকিস্তানসহ পুরো ভারতবর্ষ জুড়ে তিনি একক ও অতুলনীয় তারকাতে পরিণত হয়েছিলেন। প্রয়াত জনপ্রিয় বলিউড অভিনেতা দেব আনন্দ তাকে তার ১৯৯০ সালের স্পোর্টস অ্যাকশন-থ্রিলার মুভি আউয়াল নাম্বার-এ অভিনয়ের প্রস্তাব দিয়েছিলেন। কিন্তু অভিনয়ে দক্ষতা না থাকার কথা বলে ইমরান সেই প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেন। ২০১০ সালে একটি পাকিস্তানি প্রযোজনা প্রতিষ্ঠান ইমরান খানের জীবনের উপর ভিত্তি করে একটি বায়োগ্রাফি চলচ্চিত্র নির্মাণ করে, যার শিরোনাম ছিল কাপ্তান: দ্য মেকিং অফ এ লিজেন্ড। ছবিটি পাকিস্তান ক্রিকেট দলের অধিনায়কত্ব থেকে শুরু করে ইমরানের গোটা কর্মজীবনকে তুলে ধরেছিলো। এ ছবিতে ১৯৯২-এর পাকিস্তানের ক্রিকেট বিশ্বকাপ জয়কে চিত্রায়িত করা হয়েছিল।

১৯৯৫ সালের ২১ জুন ইংল্যান্ডের রিচমন্ড রেজিস্ট্রি অফিসে একটি জাকজমকপূর্ণ অনুষ্ঠানে বিয়ে হয় ইমরান খান ও জেমিমা গোল্ডস্মিথের। তারপর সারে প্রদেশে গোল্ডস্মিথের বাড়িতে একটি সংবর্ধনা দেয়া হয়, যেখানে লন্ডনের অভিজাতরা উপস্থিত ছিলেন। এই বৈবাহিক অনুষ্ঠানটি ‘দ্যা ওয়েডিং অফ দ্যা সেঞ্চুরি’ নামে পরিচিত।

জেমিমা লেডি অ্যানাবেল ভেন-টেম্পেস্ট-স্টুয়ার্ট এবং যুক্তরাজ্যের অন্যতম ধনী ব্যক্তি স্যার জেমস গোল্ডস্মিথের জ্যেষ্ঠ সন্তান। ২০০৩ সালে তিনি লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্কুল অফ ওরিয়েন্টাল অ্যান্ড আফ্রিকান স্টাডিজের অন্তর্গত ইসলামের আধুনিক ট্রেন্ড ভিত্তিক মিডেল ইস্টার্ন স্টাডিজে এমএ ডিগ্রি লাভ করেন।

ইমরান ও জেমিমার দুই পুত্র সন্তান; সুলাইমান ইসা এবং কাসিম। ২০০৪ এর ২২ জুন এই দম্পতি তাদের দীর্ঘ নয় বছরের দাম্পত্য জীবনের অবসান ঘটান।

কয়েক মাস ভক্তদের জল্পনা-কল্পনার খোরাক যোগিয়ে ২০১৫ সালের জানুয়ারিতে ইমরান খান বিয়ে করেন ব্রিটিশ পাকিস্তানি সাংবাদিক এবং টেলিভিশন উপস্থাপক রেহাম খানকে। তার বাবা নায়ার রামজান একজন চিকিৎসক ছিলেন এবং তার মা সাঈদা নায়ার। বানি গালায় ইমরানের বাসভবনে একটি সাধারণ অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে সম্পন্ন হয়েছিল বিয়েটি। নয় মাস পরে ২০১৫ সালের অক্টোবরে তাদের বিবাহ বিচ্ছেদ ঘটে।

ইমরান খানের তৃতীয় স্ত্রী চল্লিশোর্ধ বুশরা বিবি এবং তাদের বিয়ে হয় ২০১৮ সালের ১৮ ফেব্রুয়ারি লাহোরে ইমরানের নিজস্ব বাসভবনে। ইমরানের সঙ্গে বিয়ের পূর্বে বুশরা সুফিবাদের সাথে সংযুক্ত ছিলেন। এমনকি ইমরানের আধ্যাত্মিক পরামর্শদাতা বা মুর্শিদ ছিলেন বুশরা। বুশরার প্রথম স্বামীর নাম খাওয়ার মানেকা এবং সেই ঘরে তার দুই ছেলে এবং তিন মেয়ে আছে। খাওয়ার মানেকা ছিলেন একজন ঊর্ধ্বতন কাস্টমস কর্মকর্তা এবং বেনজির ভুট্টোর মন্ত্রিসভার সাবেক কেন্দ্রীয় মন্ত্রী গোলাম মুহাম্মদ মানেকার ছেলে।

খেলা থেকে অবসর নেয়ার পর ইমরান খান বিভিন্ন ব্রিটিশ এবং এশিয়ান সংবাদপত্রের জন্য ক্রিকেটের বিষয়ে লেখালেখি করেছেন। অধিকাংশ সময়ই তার লেখার মূল বিষয় ছিল পাকিস্তান জাতীয় দল। তার ফিচারগুলো ভারতের আউটলুক ম্যাগাজিন, গার্ডিয়ান, দি ইন্ডিপেন্ডেন্ট এবং টেলিগ্রাফে প্রকাশিত হয়েছে। তাকে মাঝেমধ্যে বিবিসি উর্দু এবং স্টার টিভি নেটওয়ার্কসহ এশিয়ান এবং ব্রিটিশ স্পোর্টস নেটওয়ার্কগুলোতে ক্রিকেট ধারাভাষ্যকার হিসাবে উপস্থিত হতে দেখা যায়। ২০০৪ সালে ভারতীয় ক্রিকেট দল দীর্ঘ ১৪ বছর পর পাকিস্তান সফর করে। এ সময় তিনি টেন স্পোর্টসের বিশেষ লাইভ শো স্ট্রেইট ড্রাইভে একজন ধারাভাষ্যকার ছিলেন। তিনি ১৯৯৯-এর বিশ্বকাপের সময় বিবিসির জন্য প্রদানকৃত ম্যাচ সামারি সহ ১৯৯২ সাল থেকে প্রতিটি ক্রিকেট বিশ্বকাপের বিশ্লেষণ প্রদান করেছেন।

২০০৫ সালের ২৩ নভেম্বর ইমরান খান ব্যারনেস লকউডে স্থলাভিষিক্ত হয়ে ব্র্যাডফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের চ্যান্সেলর হিসেবে নিযুক্ত হন। ২০১০ সাল থেকে টানা চার বছর স্নাতক কনভোকেশনগুলোতে তিনি অনুপস্থিত ছিলেন। এই কারণে ২০১৪ সালের ২৬ ফেব্রুয়ারি ইউনিভার্সিটি অফ ব্র্যাডফোর্ড ইউনিয়ন তাকে পদ থেকে অপসারণের জন্য একটি প্রস্তাব উত্থাপন করে। কিন্তু ইমরান তার ক্রমবর্ধমান রাজনৈতিক প্রতিশ্রুতি উল্লেখ করে নিজে থেকেই ২০১৪ সালের ৩০ নভেম্বর পদত্যাগের ঘোষণা দেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইস-চ্যান্সেলর ব্রায়ান ক্যান্টরের মতে ইমরান খান বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের জন্য একজন চমৎকার রোল মডেল ছিলেন।

১৯৯০-এর দশকে ইমরান খান খেলাধুলার জন্য ইউনিসেফের বিশেষ প্রতিনিধি হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। এ সময় তিনি বাংলাদেশ, পাকিস্তান, শ্রীলঙ্কা এবং থাইল্যান্ডে স্বাস্থ্য ও টিকাদান কর্মসূচির প্রচার করেন। লন্ডনে থাকাকালীন তিনি কাজ করেন ক্রিকেট দাতব্য সংস্থা লর্ডস ট্যাভার্নার্সের সাথে। ১৯৯১ সালে তিনি তার মা মিসেস শওকত খানমের নামে শওকত খানম মেমোরিয়াল ট্রাস্ট নামে একটি দাতব্য সংস্থা প্রতিষ্ঠা করেন। ট্রাস্টের প্রথম প্রচেষ্টা হিসাবে তিনি প্রতিষ্ঠা করেন পাকিস্তানের প্রথম এবং একমাত্র ক্যান্সার হাসপাতাল। এটি নির্মিত হয়েছিল সারা বিশ্ব থেকে সংগৃহীত অনুদান এবং ২৫ মিলিয়ন মার্কিন ডলারেরও বেশি তহবিল ব্যবহার করে।

২০০৮ সালের ২৭ এপ্রিল ইমরান মিয়ানওয়ালি জেলায় নামাল কলেজ নামে একটি কারিগরি কলেজ প্রতিষ্ঠা করেন। এটি মিয়ানওয়ালি ডেভেলপমেন্ট ট্রাস্ট (এমডিটি) দ্বারা নির্মিত হয়েছিল এবং এটি ছিল ব্র্যাডফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি সহযোগী কলেজ। তার গড়া ইমরান খান ফাউন্ডেশন সমগ্র পাকিস্তানের অভাবী লোকদের সহায়তা করতো। এটি পাকিস্তানের বন্যা দুর্গতদের সাহায্য করেছিল। ‘লাইটিং এ মিলিয়ন লাইভস’ প্রকল্পের অধীনে ডেরা গাজি খান, মিয়ানওয়ালি এবং ডেরা ইসমাইল খানের গ্রামগুলোকে আলোকিত করতে বক্স ফাউন্ডেশন অংশীদারিত্ব করেছিলো ইমরান খান ফাউন্ডেশনের সাথে। ক্যাম্পেইনটি নির্বাচিত অফ-গ্রিড গ্রামে বেশ কয়েকটি সোলার চার্জিং স্টেশন স্থাপন করবে। এটি গ্রামবাসীদের সরবরাহ করবে সোলার লণ্ঠন, যা দ্বারা নিয়মিতভাবে সৌর-চার্জিং স্টেশনগুলোতে চার্জ করা যাবে।

ক্রিকেট এবং রাজনীতির বাইরে ইমরান খান-এর ব্যক্তি জীবনে সমূহ চড়াই-উৎড়াই থাকলেও ক্রিকেট প্রজন্মের জন্য তিনি একজন অনুসরণীয় আদর্শ। বৈবাহিক জীবনের প্রাক্কালে বিভিন্ন সম্পর্কে জড়িয়ে নেতিবাচক ভাবমূর্তির সম্মূখীন হয়েছেন এই ক্রিকেট কিংবদন্তি। কিন্তু এ সবকিছুকে যেন ম্লান করে দেয় তার বিশ্ব রেকর্ডগুলো। অধিনায়ক হিসেবে টেস্টে সর্বোচ্চ উইকেট, সেরা বোলিং স্ট্রাইক রেট, টেস্টে সেরা বোলিং গড়, টেস্টের এক ইনিংসে সেরা বোলিং ফিগার এবং সবচেয়ে বেশি পাঁচ উইকেট শিকারে জয় করা টেস্ট ইনিংস এখনো তার দখলে।