জি-২০ সম্মেলনে সর্বসম্মত যৌথ ঘোষণা নিয়ে সংশয় ছিল। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ নিয়ে শীর্ষ অর্থনীতির দেশগুলোর বিভক্তি এই সংশয় সৃষ্টি করেছিল। শেষ পর্যন্ত আয়োজক ভারত শনিবার সম্মেলনের প্রথম দিনেই যৌথ ঘোষণা গৃহীত হওয়ার কথা জানায়।
মনে করা হচ্ছে, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের ভোগান্তির কথা থাকলেও রাশিয়ার নিন্দা না করায়ই তা সম্ভব হয়েছে। কোনো সমস্যা ছাড়া যৌথ ঘোষণা গৃহীত হওয়ার বিষয়টিকে তুলে ধরা হচ্ছে আয়োজক ভারতের তাৎপর্যপূর্ণ কূটনৈতিক সাফল্য হিসেবে।
ঘোষণাপত্রপ্রথমবারের মতো জি২০ জোটের সভাপতি হওয়ার পর থেকে উন্নত বিশ্বের সঙ্গে উন্নয়নশীল ও দরিদ্র দেশগুলোর সম্পর্ক তৈরির জন্য কাজ করছিল ভারত। তুলনামূলকভাবে অনুন্নত দক্ষিণ বিশ্বের (গ্লোবাল সাউথ) জন্য নিজেকে নেতৃত্বের স্থানে তুলে ধরতে তৎপর ছিল দেশটি।
সেই ধারাবাহিকতায় মোদি শনিবার আফ্রিকান ইউনিয়নকে (এইউ) জি২০ জোটের স্থায়ী সদস্য পদ গ্রহণের আমন্ত্রণ জানান। এইউয়ের অন্তর্ভুক্তিকেও এবারের সম্মেলনের ঐতিহাসিক অর্জন হিসেবে দেখা হচ্ছে।
রোববার সম্মেলনে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি জানান, জি২০ জোট যৌথ ঘোষণার ব্যাপারে সম্মত হয়েছে এবং তা গৃহীতও হয়েছে। তিনি বলেন, “আমাদের কঠোর পরিশ্রম এবং সবার সমর্থনের মধ্য দিয়ে ‘নয়াদিল্লি জি২০ লিডার্স সামিট ডিক্লারেশন’ গৃহীত হয়েছে। ”
গত বছর ইন্দোনেশিয়ার বালিতে অনুষ্ঠিত জি২০ সম্মেলনে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধকে কেন্দ্র করে বিভক্তি সৃষ্টি হয়েছিল জোটভুক্ত দেশগুলোর মধ্যে। একদিকে রাশিয়া ও চীন এবং অন্যদিকে যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বে পশ্চিমা বিশ্ব ও তাদের মিত্রদের অবস্থান জোটের বিভক্তিকে গভীর করে তুলেছিল।
রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ ঘিরে বিশ্বমঞ্চে এবারও সেই মতবিরোধ বহাল। তবে নয়াদিল্লি সম্মেলনের সাফল্য হচ্ছে, এই মতপার্থক্যের ব্যাপারে এমন একটি জায়গায় পৌঁছানো সম্ভব হয়েছে, যেখানে কোনো পক্ষই নাখোশ নয়।
ভারতের সাবেক আমলা অমিতাভ কান্ত সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম এক্সে বলেছেন, ‘শনিবারের আলোচনা প্রমাণ করেছে, এই বছর জোটের ইতিহাসে অন্যতম উচ্চাভিলাষী ছিল। আগের সভাপতি দেশগুলোর তুলনায় আমরা অনেক বেশি অর্থবহ কাজ করেছি। ’
এবারের সম্মেলনের আগে থেকেই বলা হচ্ছিল, বালি সম্মেলনের মতো এবারও বড় ইস্যু হয়ে দাঁড়াতে যাচ্ছে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ। বালিতে জোট নেতাদের যৌথ ঘোষণায় বলা হয়েছিল, জোটের বেশির ভাগ দেশ ইউক্রেনে আগ্রাসনের জন্য রাশিয়ার সমালোচনা করে এবং ইউক্রেনীয় ভূখণ্ড থেকে রুশ দখলদারির অবসান চায়।
এবার রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন এবং চীনের প্রেসিডেন্ট শি চিনপিংয়ের অনুপস্থিতিতে অনুষ্ঠিত নয়াদিল্লি সম্মেলনের ঘোষণায় বলা হয়, ‘বিশ্বব্যাপী খাদ্য ও জ্বালানি নিরাপত্তার ক্ষেত্রে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের প্রভাব মানুষের মধ্যে ভোগান্তি ও নেতিবাচকতা তৈরি করেছে। ’
রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ প্রসঙ্গে ঘোষণায় আরও বলা হয়, ভূখণ্ডগত অখণ্ডতা ও সার্বভৌমত্বকে অবজ্ঞা করে কিংবা কোনো দেশের রাজনৈতিক স্বাধীনতাকে আমলে না নিয়ে হুমকি বা শক্তি প্রয়োগ করে ভূখণ্ড দখল থেকে দেশগুলোর দূরে থাকা উচিত। এ ছাড়া কৃষ্ণ সাগরের শস্যচুক্তিতে রাশিয়াকে অংশগ্রহণের আহ্বান জানানো হয়।
ঘোষণায় আরও বলা হয়, ভূমি দখলের জন্য পরমাণু অস্ত্রের ব্যবহার অগ্রহণযোগ্য। সার্বভৌমত্ব ও ভৌগোলিক অখণ্ডতা সংক্রান্ত নীতিসহ জাতিসংঘ সনদের মূলনীতির ওপর ভিত্তি করে শান্তি নিশ্চিত করতে হবে।
বালি ঘোষণায় জোটের বেশির ভাগ দেশের রাশিয়ার সমালোচনার কথা বলা হলেও নয়াদিল্লির ঘোষণায় সেই ধরনের কোনো বার্তা নেই। এ নিয়ে এরই মধ্যে প্রশ্ন উঠেছে। এ বিষয়ে ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী সুব্রামানিয়াম (এস) জয়শঙ্কর বলেন, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ বিষয়ের অনুচ্ছেদটি এখনকার প্রেক্ষাপটের ভিত্তিতে তৈরি করা।
বালির ঘোষণার তুলনায় নয়াদিল্লির ভাষা দুর্বল—এমন অভিযোগের জবাবে জয়শঙ্কর বলেন, ‘আমি শুধু বলতে চাই, বালি বালিই এবং নয়াদিল্লি নয়াদিল্লিই। বালি চলে গেছে এক বছর আগে। এখনকার পরিস্থিতি ভিন্ন। এরপর অনেক ঘটনা ঘটেছে। ’
ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী দাবি করেন, যৌথ ঘোষণার ভূ-রাজনীতিসংক্রান্ত আটটি অনুচ্ছেদের সাতটিই রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ নিয়ে। সার্বিকভাবে ঘোষণা নিয়ে জয়শঙ্কর বলেন, ‘যৌথ ঘোষণায় দৃঢ়, ভারসাম্যপূর্ণ ও অন্তর্ভুক্তিমূলক প্রবৃদ্ধির ওপর জোর দেওয়া হয়েছে। ’
যৌথ ঘোষণায় খাদ্য, সার, জ্বালানিসহ নানা বিষয় উঠে এসেছে। এতে জলবায়ু পরিবর্তন ও সন্ত্রাসবাদ মোকাবেলায়ও গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। তবে যৌথ ঘোষণাই গতকাল ছিল সম্মেলনের সবচেয়ে বড় আলোচনার বিষয়। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ যাবতীয় মনোযোগ কেড়ে নেয়।
দৈনিক কলম কথা সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।