আফ্রিকার চে গেভারা’ খ্যাত সাঙ্কারা ১৯৮৭ সালের ১৫ অক্টোবর এক অভ্যুত্থান চলাকালে সেনাসদস্যদের গুলিতে নিহত হন। ফাইল ছবি: রয়টার্স আফ্রিকা মহাদেশকে স্তম্ভিত করে দেওয়া হত্যাকাণ্ডটির প্রায় ৩৪ বছর পর বুরকিনা ফাসোর একসময়কার তুমুল জনপ্রিয় প্রেসিডেন্ট টমাস সাঙ্কারা খুনের মামলায় ১৪ জনের বিচার শুরু হয়েছে। সোমবার রাজধানী ওয়েগাদুগুতে এর আনুষ্ঠানিক শুনানি শুরু হয় বলে এক প্রতিবেদনে জানিয়েছে সিএনএন। ‘আফ্রিকার চে গেভারা’ খ্যাত সাঙ্কারা ১৯৮৭ সালের ১৫ অক্টোবর এক অভ্যুত্থান চলাকালে সেনাসদস্যদের গুলিতে নিহত হন। ওই ঘটনার পর তার ঘনিষ্ঠ বন্ধু ব্লেইজ কমপাওরে ক্ষমতায় বসেন। তারও বছর চারেক আগে সাঙ্কারা-কমপাওরে জুটিই দেশটির ক্ষমতা নিয়েছিলেন, যার ফলশ্রুতিতে সাঙ্কারা প্রেসিডেন্ট হয়েছিলেন। সাঙ্কারা হত্যায় যে ১৪ জনের বিরুদ্ধে অভিযোগ আনা হয়েছে, তার মধ্যে কমপাওরে’ও আছেন; ২০১৪ সালে ব্যাপক গণবিক্ষোভের পর পদত্যাগে বাধ্য হয়ে তিনি দেশ ছেড়ে পার্শ্ববর্তী আইভরি কোস্টে আশ্রয় নেন, এখনও তিনি সেখানেই আছেন বলে এক প্রতিবেদনে জানিয়েছে বিবিসি। কমপাওরে অবশ্য বরাবরই সাঙ্কারা হত্যায় জড়িত থাকার অভিযোগ অস্বীকার করেছেন, তিনি বিচারও বয়কট করেছেন। “আমি দীর্ঘ সময় ধরে এ (বিচারের) জন্য অপেক্ষা করছি। আমি সত্য জানতে চাই, জানতে চাই কে তাকে মেরেছে,” বলেছেন সাঙ্কারার স্ত্রী মারিয়াম। আফ্রিকার ‘নায়ক’, ‘আইকন’ পশ্চিম আফ্রিকাজুড়ে অসংখ্য ট্যাক্সিতে মিলবে সাঙ্কারার ছবি সম্বলিত স্টিকার; মহাদেশটির আরেক প্রান্তে দক্ষিণ আফ্রিকার র্যাডিকাল বিরোধীদলীয় নেতা জুলিয়াস মালেমার কাছেও তিনি ‘অনুপ্রেরণাদাতাদের একজন’। “আমাদের কাছে সাঙ্কারা একজন দেশপ্রেমিক। তিনি তার জনগণকে ভালোবাসতেন, দেশকে ভালোবাসতেন, আফ্রিকাকে ভালোবাসতেন। আমাদের জন্য তিনি তার জীবন দিয়েছেন,” বলেছেন টমাস সাঙ্কারা মেমোরিয়াল কমিটির সাধারণ সম্পাদক লুক দামিবা। সাঙ্কারার শাসনামলেই দেশের নাম ‘আপার ভোল্টা’ থেকে বদলে ‘বুরকিনা ফাসো’ রাখা হয়েছিল, যার অর্থ `ন্যায়পরায়ন মানুষের ভূখণ্ড’।
নিজেও খুব সাধারণ জীবনযাপন করতে সাঙ্কারা। নিজের বেতন কমিয়েছিলেন, কমিয়েছিলেন সরকারি সব কর্মকর্তার বেতনও। সরকারি কর্মকর্তাদের জন্য এয়ারলাইন্সের প্রথম শ্রেণির টিকেটও নিষিদ্ধ করেছিলেন তিনি। তার অগ্রাধিকার তালিকায় ছিল শিক্ষা। তার চার বছরের শাসনে বুরকিনা ফাসোর স্বাক্ষরতার হার ১৩ শতাংশ থেকে বেড়ে ৭৩ শতাংশে দাঁড়িয়েছিল। তিনি দেশজুড়ে ব্যাপক টিকাদান কর্মসূচিও চালিয়েছিলেন। ‘মার্কসীয় দর্শনের’ অনুসারী সাঙ্কারা জমি পুনর্বন্টন করেছিলেন, জোতদারদের কাছ থেকে জমি নিয়ে সেগুলো দিয়েছিলেন দরিদ্র কৃষককে। তার এ পদক্ষেপের ফলে দেশটির তুলার উৎপাদন অনেক বেড়ে গিয়েছিল। তিনি সমগ্র আফ্রিকাকে এক হয়ে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) ও বিশ্ব ব্যাংকের মতো তার দৃষ্টিতে ‘নয়া-উপনিবেশবাদের’ বিরুদ্ধে দাঁড়াতে বলেছিলেন। “যে তোমাকে খাওয়ায়, সেই তোমাকে নিয়ন্ত্রণ করে,”বলতেন তিনি। সাঙ্কারা ‘সাম্রাজ্যবাদবিরোধী পররাষ্ট্রনীতি’চালু করেছিলেন, যা পশ্চিম আফ্রিকার ওপর ফ্রান্সের প্রভাবকে চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিয়েছিল। একসময় উপনিবেশ ছিল, বুরকিনা ফাসোর মতো পশ্চিম আফ্রিকার এমন অনেক দেশের ওপর ফ্রান্সের প্রভাব তখনও ব্যাপক। সাঙ্কারার বিধবা স্ত্রী মারিয়াম তার স্বামীকে হত্যায় ফ্রান্সই ‘মাস্টারমাইন্ড’ ছিল বলে অভিযোগ করে আসছেন। “তিনি এখনও আমার প্রেসিডেন্ট। জনগণের জন্য তিনি যা করেছিলেন, তা আমাদের মতো তরুণদের তার মতো কিছু করতে অনুপ্রেরণা দেয়,” বিবিসিকে এমনটাই বলেছেন রাজধানী ওয়েগাদুগুর টমাস সাঙ্কারা বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন শিক্ষার্থী।
২০১৯ সালে রাজধানীর টমাস সাঙ্কারা মেমোরিয়াল পার্কে মাত্র ৩৭ বছর বয়সে মারা যাওয়া সাঙ্কারার একটি ছয় মিটার লম্বা ব্রোঞ্জের মূর্তি উন্মোচিত হয়; মূর্তিটির প্রথম সংস্করণ নিয়ে আপত্তি ওঠার পর গতবছর সেটির সংস্কারও করা হয়েছে। দামিবা বলেছেন, পার্কটিকে আরও বড় করারও পরিকল্পনা আছে তাদের, যেখানে থাকবে ৮৭ মিটার লম্বা একটি টাওয়ার, যেখান থেকে ওয়েগাদুগুর পুরোটা দেখা যাবে। থাকবে সাঙ্কারার সমাধিসৌধ, সিনেমা হল ও মিডিয়া লাইব্রেরি। এসবের মাধ্যমে ভবিষ্যৎ প্রজন্মের কাছে সাঙ্কারার বিপ্লবী চিন্তাচেতনা পৌঁছে দেওয়ার প্রত্যাশা টমাস সাঙ্কারা মেমোরিয়াল কমিটির। সাঙ্কারার কট্টর বামপন্থি নীতির কঠোর সমালোচক ছিল বিভিন্ন মানবাধিকার সংগঠন, তারা তার শাসনামলকে ‘কঠোর দমনপীড়নের সময়’ হিসেবেও অভিহিত করেছে। ১৯৮৬ সালে অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের এক প্রতিবেদনে সাঙ্কারার আমলে রাজনৈতিক প্রতিপক্ষদের বিচার ছাড়াই আটকে রাখা ও তাদের ওপর ব্যাপক নির্যাতন চালানোর অভিযোগ আনা হয়। “আমার মনে হয় তিনি বহুত্ববাদী গণতন্ত্রের ধারণা মেনে নেওয়ার ক্ষেত্রে অনেকটাই পিছিয়ে ছিলেন, যারাই তার বিরোধিতা করত, তিনি তাদের সঙ্গে কথা বলতেন না, শুনতেনও না,” বলেছেন সাঙ্কারার সরকারের তথ্যমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করা থিওফাইল বালিমা। বুরকিনা ফাসোর সাবেক প্রেসিডেন্ট জঁ-ব্যাপ্তিস্ত ওয়েদ্রাওগো ২০২০ সালে আফ্রিকা রিপোর্ট ওয়েবসাইটকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে সাঙ্কারার মধ্যে ‘সন্দেহ করার প্রবণতা এবং রাজনৈতিক ম্যাকিয়াভেলিয়ানিজমের সংমিশ্রণ ছিল’ বলে মন্তব্য করেছিলেন। ওয়েদ্রাওগোকে সাঙ্কারাই ক্ষমতাচ্যুত করেছিলেন। বিচারে এত সময় লাগছে কেন?
“আমরা দীর্ঘদিন ধরে অপেক্ষা করছি, ব্লেইজ কমপাওরের শাসনের ২৭ বছর অপেক্ষা করেছি। তার (কমপাওরে) আমলে বিচারের সম্ভাবনার কথা এমনকী স্বপ্নেও ভাবতে পারতাম না আমরা,” বলেছেন সাঙ্কারার ভাই পল। সাঙ্কারা হত্যাকাণ্ডের ১০ বছর পর, ১৯৯৭ সালে তার স্ত্রী মারিয়াম স্বামীর খুন নিয়ে ফৌজদারি অভিযোগ দায়ের করেন; কিন্তু এ নিয়ে তদন্ত হবে কিনা, সে বিষয়ে সিদ্ধান্ত দিতে সুপ্রিম কোর্ট দেড় দশক কাটিয়ে দেয়। ২০১৪ সালে কমপাওরে ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর মামলায় খানিকটা অগ্রগতি দেখা যায়। পরের বছর সাঙ্কারার বলে মনে হওয়া একজনের দেহাবশেষ কবর থেকে তোলা হয়, তবে সেই দেহাবশেষ আদতেই সাঙ্কারার কিনা, ডিএনএ বিশ্লেষণ করেও তা নিশ্চিত হওয়া যায়নি। ২০১৬ সালে বুরকিনা ফাসো কর্তৃপক্ষ আনুষ্ঠানিকভাবে ফ্রান্স সরকারের কাছে সাঙ্কারা হত্যাকাণ্ডের সামরিক নথি প্রকাশের অনুরোধ জানায়। পরে ফ্রান্সের আর্কাইভে থাকা এ সংক্রান্ত নথিগুলো ‘ডি ক্লাসিফায়েড’ (গোপন না রাখার ঘোষণা দেওয়া) এবং তিন ধাপে বুরকিনা ফাসোর কাছে হস্তান্তর করা হয়। শেষ ধাপের নথিগুলো দেওয়া হয় চলতি বছরের এপ্রিলে। কাদের বিচার হচ্ছে? কমপাওরে’র সাবেক চিফ অব স্টাফ জেনারেল গিলবার্ট দিয়েনদেরে ও আরও ১১ জনকে সামরিক ট্রাইব্যুনালে বিচারের মুখোমুখি হতে হচ্ছে। তাদের বিরুদ্ধে ‘রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তার ওপর হামলা’, ‘হত্যাকাণ্ডে জড়িত থাকা’ ও ‘মৃতদেহ গায়েব করার’ অভিযোগ আনা হয়েছে। ২০১৫ সালে ব্যর্থ এক অভ্যুত্থানে জড়িত থাকা দিয়েনদেরে ২০ বছরের সাজা নিয়ে এখন কারাগারেই আছেন। অভিযুক্তদের মধ্যে সাঙ্কারার মৃত্যুসনদে স্বাক্ষর করা চিকিৎসক দিয়েব্রে জঁ ক্রিস্তোফও আছেন; মৃত্যুসনদে তিনি লিখেছিলেন, সাঙ্কারার স্বাভাবিক মৃত্যু হয়েছিল। তার বিরুদ্ধে সরকারি নথিতে মিথ্যা বলার অভিযোগ আনা হয়েছে। কমপাওরে ছাড়াও বিচারে অনুপস্থিত থাকছেন একজন, তার সাবেক নিরাপত্তা প্রধান হায়াসিনথে কাফান্দো। তার জন্য আন্তর্জাতিক গ্রেপ্তারি পরোয়ানাও জারি আছে।
কাফান্দোর বিরুদ্ধে অভিযোগ, তিনিই ওই দলটির নেতৃত্ব দিয়েছিলেন, যারা সাঙ্কারা এবং অন্য ১২ জনের হত্যায় জড়িত। ভয়, আশঙ্কা অনেকের আশঙ্কা, সাঙ্কারা হত্যাকাণ্ডের বিচার আল-কায়েদা ও ইসলামিক স্টেটের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট জিহাদি গোষ্ঠীগুলোর হামলার কারণে অস্থির হয়ে থাকা বুরকিনা ফাসোকে আরও অস্থিতিশীলতার দিকে ঠেলে দিতে পারে। পশ্চিম আফ্রিকার দেশটিতে কমপাওরের প্রভাব এখনও ফিকে হয়নি, যে কারণে তার অনুগত সেনারা ঝামেলা পাকাতে পারে বলে অনেক বিশ্লেষক আশঙ্কাও করছেন। তবে এখন পর্যন্ত এ ধরনের সামান্য আলামতও দেখা যায়নি বলে প্রকাশিত প্রতিবেদনে বলা হয়েছে। বুরকিনা ফাসোর প্রেসিডেন্ট রক মার্ক কাবোরের আশা, এই বিচার উত্তেজনা প্রশমিত করবে এবং জাতিকে আরও ঐক্যবদ্ধ করবে। “আমার মনে হয় না, এই বিচার অস্থিতিশীলতা বাড়িয়ে দেবে। ন্যায়বিচার ছাড়া বিভিন্ন পক্ষের মধ্যে সমঝোতা বিরল,” ২০২০ সালের এপ্রিলে এক ফরাসি ম্যাগাজিনকে এমনটাই বলেছেন ইন্টারন্যাশনাল ক্রাইসিস গ্রুপের (আইসিজি) সাহেল বিশেষজ্ঞ ম্যাথিউ পেলেরিন।
দৈনিক কলম কথা সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।