প্রবাদপ্রতিম গণিতজ্ঞ অয়লারের পৌনে দুশতকের পুরোনো তত্ত্বকে ভুল প্রমাণ করে দিয়েছিলেন রাজচন্দ্র বসু ।।

লেখক – স্বপন সেন
সংগৃহীতঃ( বাংলা আমার প্রাণ)

দিনটা ছিল ১৯৫৯ সালের ২৬ এপ্রিল। দুদিন আগেই এক বিখ্যাত গবেষণার ফলাফল পেশ হয়েছে আমেরিকান ম্যাথমেটিক্যাল সোসাইটির সম্মেলনে। সেই গবেষণার ওজন এমনই যে, পরদিন নিউ ইয়র্ক টাইমসের সায়েন্স এডিটর নিজেই গিয়েছিলেন ওই বিজ্ঞানীর ইন্টারভিউ নিতে। ওই রবিবার সেই সাক্ষাৎকারটি ছাপা হয়েছিল পত্রিকার প্রথম পাতায় সঙ্গে তাঁর ছবি এবং গবেষণার বর্ণনা।
ভদ্রলোক উঠেছিলেন শহরের এক ছোট্ট হোটেলে। সকালে তিনি হোটেলের বিল মেটাতে গিয়েছেন। তাঁর দিকে তাকিয়ে ক্যাশিয়ার জিজ্ঞাসা করলেন, নিউ ইয়র্ক টাইমসের এই ছবিটা কি তোমার? উনি মৃদু হেসে ঘাড় নাড়লেন। ক্যাশিয়ার তখন বললেন, তুমি নিশ্চয় বড় রকমের কিছু একটা করেছো, কারণ নিউ ইয়র্ক টাইমসের প্রথম পাতা মিলিয়ন ডলার দিয়ে কেনা যায় না!

হ্যাঁ, ছয় দশক আগে সত্যি বড় রকমের একটা অঘটন ঘটিয়েছিলেন বাঙালি গবেষক রাজচন্দ্র বসু, সহ গবেষক ছিলেন ই টি পার্কার এবং শঙ্কর শ্রীখন্দ। প্রবাদপ্রতিম সুইস গণিতজ্ঞ অয়লারের পৌনে দুশতকের পুরোনো একটি ধারণা এবং তত্ত্বকে ভুল প্রমাণ করে দিয়েছিলেন তিনি।

আঠারো শতকের ডাকসাইটে অঙ্কবিদ লিওনার্ড অয়লার মারা য়ান ১৭৮৩ সালে। তার ঠিক আগের বছর ১৭৮২-তে অয়লার একটি গাণিতিক অনুমান করেন, যা পরিচিত কনজেকচার নামে। একে একরকম ধাঁধাই বলা চলে। ১৯৫৯ সালে এই বিজ্ঞানীরা ভুল প্রমাণ করেন অয়লারকে। ফলশ্রুতিতে বসু সহ তিন বিজ্ঞানীর নামই হয়ে গেল অয়লারস স্পয়লার্স। তাঁদের এই গবেষণা খুলে দেয় রাশি বিজ্ঞানের এক নতুন শাখা। তবে গণিতের জগতে তিনি অমর হয়ে থাকবেন বোস-মেসনার অ্যালজেব্রা ও ডিজাইন থিয়োরির জন্য। জ্যামিতিক উপপাদ্যতে প্রচলিত BCH কোড তারই নামের আদ্যক্ষর দিয়ে পরিচিত।

 

১৯০১ সালে ১৯ই জুন মধ্যপ্রদেশের হোসাঙ্গাবাদে জন্মগ্রহণ করেন প্রবাদপ্রতিম এই গণিতজ্ঞ। বাবা প্রতাপ চন্দ্র ছিলেন সেনাবাহিনীর ডাক্তার। ছোটবেলা কেটেছে রোহতকে। দিল্লির হিন্দু কলেজ থেকে স্নাতক হবার বছরেই বাবা মারা যান। খরচ চালানোর জন্য শিক্ষকতা শুরু করেন সেন্ট স্টিফেন স্কুলে। স্কলারশিপ পেতে একবছর পর ফলিত গণিত নিয়ে M.Sc ক্লাসে ভর্তি হন। ১৯২৮ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপক শ্যামাদাস মুখার্জির অধীনে রিসার্চ এসোসিয়েটস হয়ে যোগ দেন। অর্থাভাবে মাঝপথে বন্ধ হয়ে যায় তার গবেষণা, শুরু করেন জ্যামিতির ওপর বই লেখা। শিক্ষা মহলে খ্যাতি পায় তার লেখা বই।

ভাগ্য সহায় হয় ১৯৩২ সালে যখন আচার্য প্রশান্ত মহালনবীশ তার নবনির্মিত ইন্ডিয়ান স্ট্যাটিস্টিক্যাল ইনস্টিটিউটে রাজচন্দ্রকে আংশিক সময়ের অধ্যাপক নিয়োগ করেন। ১৯৪৭ সাল, দেশ স্বাধীন হবার সাথে সাথে অধ্যাপক মশাইয়ের সামনে খুলে গেল আন্তর্জাতিক সব শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের দরজা। আমন্ত্রিত অধ্যাপক হিসেবে সেবছর গ্রীষ্মে গেলেন মার্কিন মুলুকে ভার্জিনিয়া পলিটেকনিকে। পরের দু’বছর আমন্ত্রণ পেলেন নর্থ ক্যারোলিনা বিশ্ববিদ্যালয়ের চ্যাপেল হিল কলেজ এবং ক্যালিফোর্নিয়ার বার্কলে থেকে। ১৯৪৯ সালের মার্চ মাসে পূর্ণ সময়ের অধ্যাপক রূপে নিয়োগ পান নর্থ ক্যারোলিনার চ্যাপেল হিলে। পাকাপাকিভাবে পেয়ে যান মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিকত্ব।

৩১শে অক্টোবর ১৯৮৭, ঘুমের মধ্যেই না ফেরার দেশে চলে যান আম বাঙালির কাছে অচেনা আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন এই বঙ্গসন্তান…..!