মরোক্কোর ভৌগলিক অবস্থান আটলান্টিক মহাসাগর তীরে যার উত্তরে ভূমধ্যসাগর ও আটলান্টিক মহাসাগর সংযোগকারী জিব্রাল্টার প্রণালী অবস্থিত। এছাড়াও দেশটির উত্তরে স্পেনের জলসীমা, পূর্বে আলজেরিয়া এবং দক্ষিণে পশ্চিম সাহারা অবস্থিত। ১৯৫৬ সালে মরক্কো ফরাসি উপনিবেশ থেকে স্বাধীনতা লাভ করে। সুলতান দ্বিতীয় হাসান সিংহাসনে বসেন ১৯৬১ সালে এবং ১৯৯৯ সাল পর্যন্ত শাসনকার্য চালান। ১৯৯৯ সালে বাদশা ষষ্ঠ মুহাম্মদ ক্ষমতায় আসীন হন। দেশটি মুসলিমদের শাসনে চলে আসে।
স্পেনের কান্না, মাওলানা তারিক জামিল সাব, বার্বার জাতি’র পরিচয়-গ্রন্থে লেখা হয়েছে, ‘উত্তর আফ্রিকায় ইসলামের দাওয়াত পৌছার পর বার্বাররা ইসলাম গ্রহণ করে। তারিক বিন যিয়াদের নেতৃত্বে তারা স্পেন বিজয়ে অংশ নেয়। তাদের অনেকেই উকবা বিন নাফে ও মুসা বিন নুসায়রের হাতে ইসলাম গ্রহণ করে। বার্বারদের পরবর্তী ইতিহাস আগলাবি, ফাতেমি, ইদরিসি, মুরাবিতুন, মুওয়াহহিদূন প্রভৃতি গােত্রের ইতিহাসের অন্তর্ভুক্ত। বার্বারগণ মূলত উত্তর আফ্রিকার অধিবাসী। এরা উপজাতি আদিবাসী।’
৭ম শতাব্দীর মাঝামাঝি উমাইয়া খিলাফতের সময় মাগরেব বিজয় সংঘটিত হয়েছিল। এই বিজয় মাগরেবে ইসলাম ও আরবি ভাষা উভয়ই নিয়ে আসে। তবে বৃহত্তর ইসলামী সাম্রাজ্যের অংশ হিসেবে মরক্কো প্রাথমিকভাবে ইফ্রিকিয়া প্রদেশ হিসেবে সংগঠিত হয় এবং সাম্রাজ্যের পক্ষ থেকে নির্ধারিত গভর্নর কর্তৃক শাসিত হয়। ইসলাম আগমনের ফলে আদিবাসী বার্বার উপজাতিরা ইসলাম গ্রহণ শুরু করে। মরোক্কান উপজাতিরা মুসলিম ধর্ম গ্রহণ করার পর, মুসলিম প্রশাসনকে ইসলামি আর্থিক কর বা যাকাত ও শ্রদ্ধা প্রদান করতো। আধুনিক মরক্কো অঞ্চলে প্রথম স্বাধীন মুসলিম রাষ্ট্র ছিল নেকোর রাজ্য। রাজ্যটি রিফ পার্বত্য অঞ্চলে প্রতিষ্ঠিত একটি আমিরাত। ৭৩৯ সালে বার্বার বিদ্রোহের প্রাদুর্ভাবের পর বার্বাররা আরও কয়েকটি স্বাধীন রাজ্য গঠন করে। ৯ম শতাব্দীতে ফেস নগরে প্রতিষ্ঠিত আল-কারাউইয়ীন বিশ্ববিদ্যালয়। এটি তৎকালীন একটি প্রধান আধ্যাত্মিক, সাহিত্যিক ও বুদ্ধিবৃত্তিক কেন্দ্র ছিল।
মধ্যযুগীয় ইতিহাস ঘেঁটে জানা যায়, আব্বাসীয় বাহিনী কর্তৃক পরিচালিত ইরাকে নিজ গোত্রের ওপর গণগত্যা থেকে পালিয়ে ইদ্রিস ইবনে আবদুল্লাহ মরক্কোতে পালিয়ে যান। তিনি আওরাবা বার্বার উপজাতিদের দূরবর্তী বাগদাদের আব্বাসীয় খলিফাদের প্রতি আনুগত্য ভঙ্গ করতে রাজি করান। ৭৮৮ সালে ইদ্রিসি রাজবংশ প্রতিষ্ঠা করেন। ইদ্রিসিরা ফেসকে তাদের রাজধানী হিসেবে প্রতিষ্ঠা করে এবং মরক্কোকে মুসলিম শিক্ষার কেন্দ্র ও একটি প্রধান আঞ্চলিক শক্তিতে পরিণত হয়। এরপর ৯২৭ সালে ফাতেমীয় খিলাফত তাদের মিকনাসা মিত্রদের মাধ্যমে ইদ্রিসিদের ক্ষমতাচ্যুত করে। কিন্তু মিকনাসারূ ৯৩২ সালে ফাতেমিদের সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করে এবং ৯৮০ সালে তাদের ক্ষমতা থেকে অপসারণ করা হয়।
১১ শতকের পর থেকে স্থানীয় বার্বার রাজবংশগুলোর উদ্ভব শুরু হয়। তখন মুরাবিতুন রাজবংশ ও মুওয়াহহিদিন রাজবংশ মরক্কো, মাগরিব, ইবেরীয় উপদ্বীপের আল-আন্দালুস ও পশ্চিম ভূমধ্যসাগরীয় অঞ্চলে আধিপত্য বিস্তার করতে থাকে। ১৩ শতকের পর থেকে দেশটিতে বনু হিলাল আরব উপজাতিরা ব্যাপক অভিবাসন গ্রহণ করে। মুরাবিতুন রাজবংশ ১০৪০ থেকে ১১৪৭ সাল পর্যন্ত মরক্কো শাসন করে। এরপর মুওয়াহহিদিনরা ১১২১ থেকে ১২৬৯ সাল পর্যন্ত শাসন পরিচালনা করে। মুওয়াহহিদিনদের পতনের পর মারিনি, হাফসিসহ বিভিন্ন রাজবংশ মরক্কো তথা মাগরেবের ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত ছিল। ১৫৪৯ সাল থেকে ১৬৫৯ সাল পর্যন্ত সাদী রাজবংশ দেশটি শাসন করে। ১৬৬৭ সাল থেকে সামনের বছরগুলোতে আলবীয়রা মরক্কোর শাসক রাজবংশের অধিপতি ছিল। ১৫ শতকে আটলান্টিক সমুদ্র বাণিজ্য নিয়ন্ত্রণ করার উদ্দেশ্যে পর্তুগিজরা মরোক্কোর কিছু উপকূলীয় অঞ্চল দখল করে নিলেও তা দেশের অভ্যন্তরকে ব্যাপকভাবে প্রভাবিত করেনি।
১৫৪৯ সাল এই অঞ্চলটি পুনরায় আরব রাজবংশের হাতে চলে যায়। তারা নিজেদের মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের বংশধর বলে দাবি করে। প্রথম সাদি রাজবংশ ১৫৪৯ থেকে ১৬৬৯ সাল পর্যন্ত শাসন করে এবং তাদের আলবীয় রাজবংশ ১৭ শতক থেকে ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হয়। তখন মরক্কো স্পেনীয় আগ্রাসনের মুখোমুখি হয় এবং উসমানীয় সাম্রাজের মিত্ররা তাদের পশ্চিম দিকে ঠেলে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করে। সাদি রাজবংশের অধীনে ১৫৭৮ সালে দেশটি আল কাসার কুইবিরের যুদ্ধে পর্তুগিজ আভিজ রাজবংশের অবসান ঘটায়। বিখ্যাত সাদি সুলতান আহমাদ আল-মনসুরের রাজত্বে সালতানাত প্রচুর নতুন সম্পদ ও প্রভাব-প্রতিপত্তি অর্জন করে এবং ১৫৯১ সালে পশ্চিম আফ্রিকায় একটি বড় অভিযান চালিয়ে সোংঘে রাজ্যে একটি বিপর্যয় ঘটায়। আহমদ মনসুরের ওফাতের পর দেশটি তার পুত্রদের মধ্যে ভাগ হয়ে যায়।
সাদি রাজবংশের পতনের সময় রাজনৈতিক বিভক্তি ছিল। নানা রকম সংঘাতের পর শেষ পর্যন্ত ১৬৬০-এর দশকের শেষের দিকে আলবীয় সুলতান আল-রশিদ গোটা মরক্কোকে পুনরায় একত্র করেন। তিনি ১৯৬৬ সালে ফেজ এবং ১৬৬৮ সালে মারাকেশ অধিগ্রহণ করেন। এরপর আলবীয়রা তাদের অবস্থান স্থিতিশীল করতে সফল হয়। রাজ্যটি এই অঞ্চলে পূর্ববর্তীদের তুলনায় ছোট হলেও তা বেশ ধনী ছিল। স্থানীয় উপজাতিদের বিরোধিতার দমন করে আলবীয় শাসক ইসমাইল ইবনে শরীফ একটি ঐক্যবদ্ধ রাষ্ট্র তৈরি করতে শুরু করেন। তার রিফিয়ান আর্মি ইংরেজদের থেকে ১৬৮৪ সালে টাঙ্গিয়া পুনরায় দখল করে নেয়। ১৬৮৯ সালে ইংরেজরা স্প্যানিশদের তাড়িয়ে দিয়ে এটি দখল করেছিল। ১৭৬৯ সালে পর্তুগিজরা মরক্কোতে তাদের শেষ অঞ্চলটি পরিত্যাগ করে চলে যায়।
মরক্কো ছিল প্রথম দেশ, যারা ১৭৭৭ সালে স্বাধীন হওয়া নতুন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে একটি স্বাধীন জাতি হিসেবে স্বীকৃতি দেয়। আমেরিকান বিপ্লবের শুরুতে আটলান্টিক মহাসাগরে মার্কিন ব্যবসায়িক জাহাজগুলো বার্বার জলদস্যুদের দ্বারা আক্রমণের শিকার হয়। ১৭৭৭ সালের ২০ ডিসেম্বর মরক্কোর সুলতান তৃতীয় মোহাম্মদ ঘোষণা করেন যে, মার্কিন বণিক জাহাজগুলো সালতানাতের সুরক্ষার অধীনে থাকবে এবং এইভাবে তারা নিরাপদ পথ উপভোগ করতে পারবে। মরোক্কা-মার্কিন বন্ধুত্বের চুক্তি ১৭৮৬ সালে স্বাক্ষরিত হয় এবং এটি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রাচীনতম নির্বিচ্ছিন্ন বন্ধুত্ব চুক্তি হিসেবে দাঁড়ায়।
তথ্যসূত্র: ওয়ারফেয়ার নেট
দৈনিক কলম কথা সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।