হওয়ার কথা ছিল প্রকৃতির সাথে মানুষের শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান। তার বদলে এখন শুধুই প্রকৃতির সাথে মানুষের যুদ্ধ। তারই ফলশ্রুতিতে, আগামী শতকের গোড়ার দিকে সমুদ্রস্তর বেড়ে উঠে ডুবতে চলেছে মুম্বাই, চেন্নাই সহ ভারতের অনেকগুলো উপকূলবর্তী শহর।

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ন্যাশনাল এরোনটিক্স অ্যান্ড স্পেস অ্যাসোসিয়েশন, যা গোটা দুনিয়ায় ‘নাসা’ নামেই বিখ্যাত, তার এক সাম্প্রতিকতম রিপোর্টে উঠে এসেছে এক ভয়ঙ্কর তথ্য। একুশ শতক শেষ করে নিশ্চিন্তে বাইশ শতকের দিকে পা বাড়ানোর আর জো নেই মানুষের– ২১০০ সালের মধ্যেই ২.৭ ফুট জলতল বেড়ে গিয়ে সমুদ্রের নিকটবর্তী বহু শহর চিরতরে জলের নীচে তলিয়ে যাবে।

নাসা-র এই ভবিষ্যদ্বাণীর ভিত্তি হলো ‘দ্য ইন্টারগভর্নমেন্টাল প্যানেল অন ক্লাইমেট চেঞ্জ’ বা আইপিসিসি-র একটি রিপোর্ট। এই রিপোর্টে পাওয়া তথ্য অনুযায়ী, নাসা গোটা পৃথিবীর সমুদ্রস্তরের সম্ভাব্য পরিবর্তন নিয়ে গবেষণা করেছে এবং তাতেই উঠে এসেছে ভয়াবহ এক আগামী দিনের কথা, যা ‘জাজমেন্ট ডে’-এর মতোই শোনাচ্ছে।

১৯৮৮ সাল থেকে, প্রতি পাঁচ থেকে সাত বছরে আইপিসিসি একটা করে রিপোর্ট পেশ করে, যে রিপোর্টে সারা পৃথিবীর জলবায়ুর গতিপ্রকৃতি ও পরিবর্তন নিয়ে সমীক্ষা ও পর্যালোচনা থাকে। মেরু অঞ্চলের বরফের চাদর গলে যাওয়া, গ্রিন হাউস গ্যাসের নির্গমন, তাপমাত্রার পরিবর্তন ও সমুদ্রতলের বৃদ্ধি– এই রকম পরস্পরের সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত নানা বিষয় নিয়ে বিস্তারিত ও তথ্যভিত্তিক আলোচনাকে তুলে আনাটাই আইপিসিসি-র মূল লক্ষ্য। সম্প্রতি, তাদের ষষ্ঠ রিপোর্টটি প্রকাশিত হয়েছে এবং তা সামনে আসতেই এটুকু দিনের আলোর মতো পরিষ্কার হয়ে গিয়েছে যে অদূর ভবিষ্যতে মানবসভ্যতার এক ভয়ানক দুর্দিন আসতে চলেছে।

কৃত্রিম উপগ্রহ ও ভূপৃষ্ঠে বসানো নানা আধুনিক যন্ত্রের সাহায্যে তথ্য সংগ্রহ করে এবং সেই তথ্যকে কম্পিউটারের সাহায্যে বিশ্লেষণ করে যে ‘সি লেভেল প্রোজেকশন’ করা হয়েছে, তাতে স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে যে ভারতের বেশিরভাগ সমুদ্রবন্দর ও সমুদ্র তীরবর্তী শহর আগামী আশি বছরের মধ্যে জলের নীচে তলিয়ে যাবে। মুম্বই, চেন্নাই, পারাদ্বীপ, কান্দলা, ওখা, ভাবনগর, বিশাখাপত্তনম, মার্মাগাও, ম্যাঙ্গালোর, কোচি, তুতিকোরিন– এমনকি কলকাতার খিদিরপুর অঞ্চলটাও জলের নীচে চলে যাওয়ার কথা উল্লেখ করা হয়েছে ওই রিপোর্টে।

সাধারণ মানুষ সহজে ব্যবহার করতে পারবে, এমন এক ‘সি লেভেল প্রোজেকশন টুল’ ইতিমধ্যেই বানিয়ে ফেলেছে নাসা। কী ঘটতে চলেছে তা আগে থেকে দেখে-বুঝে নিয়ে মানুষ যাতে বিকল্প জীবনযাপনের পরিকল্পনা করে রাখতে পারে– সে জন্যই এই টেকনোলজি।

জলবায়ু বিজ্ঞানের উপর প্রকাশিত একটা ইউনাইটেড নেশনস-এর প্রতিবেদনেও বলা হয়েছে যে ‘ফসিলস ফুয়েল’-এর ওপর সার্বিক নির্ভরশীলতার কারণে পৃথিবীর তাপমাত্রা লাগামছাড়া ভাবে বাড়ছে। গত দু’হাজার বছরে এ রকম তাপমাত্রা বৃদ্ধি কখনও হয়নি। এর ফলে, গোটা পৃথিবীতে ইদানিংকালে খরা, দাবানল ও জলোচ্ছ্বাসের প্রকোপও রেকর্ড পরিমাণ বেড়েছে। পরিস্থিতিকে আরো ভয়াবহ করে তুলেছে ব্যাপক হারে বনজঙ্গল সাফ করে বসতি বা কলকারখানা বানানো এবং প্লাস্টিকের যথেচ্ছ ব্যবহার।

১৮৫০ থেকে ১৯০০– এই পঞ্চাশ বছরে ভূপৃষ্ঠের গড় তাপমাত্রা বেড়েছে ১.১ ডিগ্রি সেলসিয়াস। আজ থেকে ১২৫০০০ আগে তুষারযুগের সময়ে শেষ এমনটা হয়েছিল। এ রকম আরও বহু তথ্য চোখের সামনে উঠে আসছে– যা বারবার চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিচ্ছে যে সতর্ক না হলে, সৌরজগতের সুন্দরতম এই গ্রহে মানুষ আর বেশি দিন টিকবে না।

কবি লিখেছিলেন, ‘দাও ফিরে সে অরণ্য, লও এ নগর’। সভ্যতার দর্পচূর্ণ করে প্রকৃতি কি আবার আমাদের সেই অরণ্য জীবনেই ফেরত নিয়ে যাবে? ইঙ্গিত কিন্তু সে দিকেই!