ইসরায়েলি বেসরকারি সংস্থা এনএসও গ্রুপের তৈরি পেগাসাস স্পাইওয়্যার দিয়ে কয়েক হাজার সরকারি কর্মী, সাংবাদিক, বড় রাজনীতিবিদের ফোনে আড়ি পাতা হয়েছে। এ তালিকায় আছে কয়েকটি দেশের রাষ্ট্রপ্রধানও। এখন পর্যন্ত ৫০ হাজারের বেশি ফোন নম্বরের একটি তালিকা ফাঁস হয়েছে। ধারণা করা হচ্ছে, ২০১৬ সাল থেকে এনএসওর গ্রাহকেরা এসব নম্বরে আড়ি পেতেছে। স্পাইওয়্যার ‘পেগাসাস’ কীভাবে স্মার্টফোনের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নেয় তা নিয়ে প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম গার্ডিয়ান। পেগাসাস নামে এই স্পাইওয়্যারটি সম্পর্কে ওয়াশিংটন পোস্ট, দ্যা গার্ডিয়ান, ল্য মোঁদ এবং আরও ১৪টি সংবাদমাধ্যমে বিস্তারিত প্রকাশিত হয়েছে। বিশ্লেষকরা মনে করেন, শুধু বাণিজ্যিক স্বার্থেই ইসরাইল স্পাইওয়্যার পেগাসাস তৈরি করেনি বরং এর পেছনে রয়েছে কোনো গোপন উদ্দেশ্য।

পেগাসাস স্পাইওয়্যার কী?
ইজরায়েলের সংস্থা এনএসও গ্রুপ তৈরি করে হ্যাকিং সফটওয়্যার পেগাসাস৷ অর্থের বিনিময়ে এই সফটওয়্যার বিভিন্ন দেশের সরকারকে ব্যবহারের লাইসেন্স দেয়৷ বিশেষজ্ঞরা একে সাইবার অস্ত্র বলে থাকে৷ ২০১৬ সালে প্রথম পেগাসাসের বিষয়ে জানা যায় যে, আরবের এক সমাজকর্মী ফোনে সন্দেহজনক মেসেজ পান৷ প্রথমে মনে করা হয়, আইফোন ব্যবহারকারীদের টার্গেট করছে পেগাসাস৷ কিন্তু এই ভুল ভাঙে পরের বছর৷ বিশেষজ্ঞরা জানান, অ্যানড্রোয়েড ফোনও হ্যাক করতে পারে পেগাসাস৷ ২০১৯ সালে এনএসও গ্রুপের বিরুদ্ধে মামলা করে ফেসবুক৷ তার পরই জানা যায়, পেগাসাস ব্যবহার করে হোয়াটসঅ্যাপের মাধ্যমে ভারতের বহু সাংবাদিক ও সমাজকর্মীর ফোনে আড়ি পাতা হয়েছে৷ দ্যা গার্ডিয়ান-এর এক বিস্তারিত রিপোর্ট থেকে জানা যাচ্ছে, পেগাসাস যদি কোনভাবে একবার আপনার ফোনের মধ্যে ঢুকে যেতে পারে, তাহলে আপনার অজান্তে ম্যালওয়্যারটি আপনার ফোনকে ২৪ ঘণ্টার এক নজরদারির যন্ত্রে পরিণত করার ক্ষমতা রাখে।

ইসরায়েলি একটি প্রতিষ্ঠান এনএসও এই সফটওয়্যারটি তৈরি করেছে যা বিভিন্ন দেশের সরকারের কাছে বিক্রি করা হয়েছে। এনএসও বলছে, সাধারণ মানুষের ফোনে আড়ি পাতার জন্য তাদের পেগাসাস কেউ ব্যবহার করেনি। বিজ্ঞানীরা বলছেন, এই আড়ি পাতার পুরো প্রক্রিয়াটিই ঘটে নিরবে এবং অবশ্যই ব্যবহারকারীর অজান্তে। এজন্য ফোনে যে মেসেজ পাঠানো হয়, নোটিফিকেশনে সেটি দেখাও যায় না। এর পর ম্যালওয়্যারটি নিজে নিজেই ফোনে ইন্সটল হয়ে যায়।

যেভাবে স্মার্টফোনের নিয়ন্ত্রণ নেয় ইসরায়েলি স্পাইওয়্যার ‘পেগাসাস’
স্পাইওয়্যার ‘পেগাসাস’ কীভাবে স্মার্টফোনের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নেয় তা নিয়ে প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম গার্ডিয়ান। তাতে বলা হয়, খুদে বার্তা ও কলের মাধ্যমে আইওএস ও অ্যান্ড্রয়েড অপারেটিং সিস্টেমের স্মার্টফোনের নিয়ন্ত্রণ নিতে পারে স্পাইওয়্যার। এর মাধ্যমে স্মার্টফোনে স্পাইওয়্যারটি স্বয়ংক্রিয়ভাবে ইনস্টল হয়ে যায়। এমনকি মোবাইল ফোন ব্যবহারকারী স্পাইওয়্যারের সেই কলটি রিসিভ না করলেও সফটওয়্যারটি স্বয়ংক্রিয়ভাবে ইনস্টল হয়ে যেতে পারে। এরপর আক্রমণকারী ফোনের পুরো সিস্টেম নিয়ন্ত্রণে নিয়ে নেয়। এটা এতটাই ভয়ঙ্কর যে, একবার স্পাইওয়্যারটি ইনস্টল হয়ে গেলে সহজেই যে কারও হোয়াটসঅ্যাপ ম্যাসেজিং ও কথা বলা, ভয়েস কল, পাসওয়ার্ড, কন্টাক্ট তালিকা, বিভিন্ন ইভেন্টের ক্যালেন্ডার, ফোনের মাইক্রোফোন এমনকি ক্যামেরার নিয়ন্ত্রণ ও তাদের হাতে চলে যায়। ভিক্টিমের মোবাইলের ব্যবহৃত ক্যামেরা দিয়েও যে কোনো সময় ছবি ও ভিডিও ধারণের ক্ষমতা রাখে স্পাইওয়্যারটি। এমনকি মোবাইল লোকেশন চালু করে স্পাইওয়্যার দেখতে পারবে ভিক্টিম এখন কোথায় আছেন। আতঙ্কের বিষয় হলো এই স্পাইওয়্যারটি এনক্রিপ্ট করা ফাইল পড়তে পারে।পেগাসাস স্পাইওয়্যারের মতো সবথেকে আধুনিক ফোন হ্যাকিং টুল সম্ভবত আর দ্বিতীয়টি নেই৷ নিঃশব্দে কাজ করে পেগাসাস৷ ব্যবহারকারী জানতেও পারেন না তাঁর ফোনে আড়ি পাতা হচ্ছে৷ তবে এই টুল ব্যবহার করে সবার ফোনে আড়ি পাতা সম্ভব নয়৷ কারণ, এই স্পাইওয়্যারটি কিনতেই লাখ লাখ টাকা খরচ হয়৷ সরকার বা বড় কোনও সংস্থা ছাড়া পেগাসাস কেনা সম্ভব নয়৷

অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের বার্লিন ভিত্তিক সিকিউরিটি ল্যাবের গবেষক ক্লডিও গুয়ারনিয়েরি বলেন, যার ফোন আক্রান্ত হল, তার পক্ষে সেটা বোঝা খুবই কঠিন। সাধারণত ফোন কেনার সময় থাকে এরকম কোনো সফটওয়্যার, যেমন আইমেসেজ, অথবা খুব জনপ্রিয় কোনো সফটওয়্যার যেমন হোয়াটসঅ্যাপ- এসব সফটওয়্যারের কোডিংয়ের ত্রুটি খুঁজে বের করে এনএসওর মত কোম্পানিগুলো। কারণ তাতে একসঙ্গে বহু ফোনে স্পাইওয়্যার ছড়ানোর সুযোগ মিলে যায়। এ ধরনের ক্ষেত্রে ফোনের মালিক স্পাইওয়্যারবাহী মেসেজে ক্লিক না করলেও তার ফোন ‘হ্যাকড’ হয়ে যায়।

পেগাসাস স্পাইওয়্যারের মতো সবথেকে আধুনিক ফোন হ্যাকিং টুল সম্ভবত আর দ্বিতীয়টি নেই৷ নিঃশব্দে কাজ করে পেগাসাস৷ ব্যবহারকারী জানতেও পারেন না তাঁর ফোনে আড়ি পাতা হচ্ছে৷ তবে এই টুল ব্যবহার করে সবার ফোনে আড়ি পাতা সম্ভব নয়৷ কারণ, এই স্পাইওয়্যারটি কিনতেই লাখ লাখ টাকা খরচ হয়৷ সরকার বা বড় কোনও সংস্থা ছাড়া পেগাসাস কেনা সম্ভব নয়৷

যেসব দেশে বেশি পেগাসাসের নজরদারী ঘটেছে
এই অবৈধ নজরদারির ঘটনা বেশিরভাগ ঘটেছে মূলত ১০টি দেশে: ভারত, আজারবাইজান, বাহরাইন, হাংগেরি, কাজাখস্তান, মেক্সিকো, রোয়ান্ডা, সৌদি আরব এবং সংযুক্ত আরব আমিরাত। ডেমোক্র্যাসি ইনডেক্স অনুযায়ী এসব দেশের মানবাধিকার ও গণতান্ত্রিক পরিস্থিতি উন্নত নয় এবং সবচেয়ে উন্নত যে দেশটি এখানে আছে সেটি হচ্ছে ইন্ডিয়া। তার র‌্যাংকিং ৫৩ আর সবচেয়ে খারাপ সৌদি আরবের, তার র‌্যাংকিং ১৫৬। যে ৫০ হাজার লোককে তালিকাভুক্ত করা হয়েছিল তাদের মধ্য থেকে এক হাজারকে ইতোমধ্যে আইডেন্টিফাই করা হয়েছে এবং তাদের অনেকের ফোন ফরেনসিক এক্সামিনেশনের জন্য দেওয়া হয়েছিল এবং সবক’টিতেই পেগাসাসের অস্তিত্ব প্রমাণ পাওয়া গেছে। গার্ডিয়ান লিখেছে, সেই সময়ের তুলনায় এনএসও তাদের এই নজরদারির যন্ত্রের অনেক উন্নয়ন ঘটিয়েছে। এখন ক্লিক না করলেও ওই ফোনের দখল নিতে পারে পেগাসাস। আবার সফটওয়্যারের ত্রুটি বা বাগ ব্যবহার করেও এ স্পাইওয়্যার ঢুকে পড়তে পারে ফোনে, যে ত্রুটির কথা হয়ত ফোন উৎপাদকরা জানেই না।

বিশ্বের প্রায় যে প্রায় ৫০টি দেশে ৫০ হাজারেরও বেশি মোবাইল ফোনে ইসরায়েলি প্রতিষ্ঠান এনএসও‘র তৈরি পেগাসাস নামের সফটওয়ারটি ঢুকিয়ে নজরদারির নজির এই অনুসন্ধানে পাওয়া গেছে তাতে বাংলাদেশের কোনো টেলিফোন নম্বর রয়েছে কিনা তা এখনও অস্পষ্ট।

প্যাগাসাসের পেছনে ইসরাইলের গোপন উদ্দেশ্য
পেগাসাস স্পাইওয়্যার পাওয়ার পরে জাতিসংঘে ভোটাভুটিতে মেক্সিকো ও পানামা তাদের অবস্থান বদলিয়ে ইসরাইলকে সমর্থন করেছে। আরব দেশগুলোর মধ্যে ইরানবিরোধী ইসরায়েলি তৎপরতায় সমর্থন তৈরি এবং এই চুক্তির মধ্য দিয়ে দীর্ঘদিনের বৈরী আরব দেশগুলোর সঙ্গে ইসরায়েলের সম্পর্ক স্বাভাবিক হয়েছে।

নিউইয়র্ক টাইমস গতকাল শনিবার প্রকাশিত প্রতিবেদনে জানায়, স্পাইওয়্যার পেগাসাস বিক্রির মাধ্যমে ইসরাইল একদিকে আর্থিক সুবিধা অর্জন করেছে। অন্যদিকে যেসব দেশ ইসরাইল বিরোধী ছিল তাদের সমর্থন আদায় করে নিয়েছে দেশটি। নিউইয়র্ক টাইমস বলছে, পেগাসাস স্পাইওয়্যার পাওয়ার পরে জাতিসংঘে ভোটাভুটিতে মেক্সিকো ও পানামা তাদের অবস্থান বদলেছে। আরব দেশগুলোর মধ্যে ইরানবিরোধী ইসরায়েলি তৎপরতায় সমর্থন তৈরি এবং এই চুক্তির মধ্য দিয়ে দীর্ঘদিনের বৈরী আরব দেশগুলোর সঙ্গে ইসরায়েলের সম্পর্ক স্বাভাবিক হয়েছে। আবার পোল্যান্ড, হাঙ্গেরি ও ভারতের সরকারের কাছেও এই অস্ত্র তুলে দেওয়া হয়েছে, যাদের বিরুদ্ধে নিজেদের জনগণের মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগ রয়েছে।

মাদক চোরাকারবারিদের দমনে হিমশিম খাচ্ছিল মেক্সিকো সরকার। তাদের ধরতে এনক্রিপটেড ব্ল্যাকবেরি মেসেজিং সেবা হ্যাক করার উপায় খুঁজছিল দেশটি। ইসরায়েলের এনএসওর কর্তাব্যক্তিরা মেক্সিকোর প্রেসিডেন্ট ফিলিপে ক্যালডেরনের সঙ্গে একটি বৈঠক করেন। এরপর নজরদারির এই অস্ত্র চলে যায় মেক্সিকো সরকারের হাতে। এর পরপরই জাতিসংঘে ফিলিস্তিনের পক্ষে উত্থাপিত বেশ কয়েকটি প্রস্তাবে ভোটদানে বিরত থাকার ঘোষণা দেয় মেক্সিকো।

২০১০ সালে ইসরায়েলি গোয়েন্দা সংস্থা মোসাদের এজেন্টরা দুবাইয়ের একটি হোটেলে হামাসের একজন জ্যেষ্ঠ নেতাকে বিষপ্রয়োগ করেন। এর জের ধরে আমিরাতের ক্রাউন প্রিন্স মোহাম্মদ বিন জায়েদ ইসরায়েলের সঙ্গে নিরাপত্তা সম্পর্ক ছিন্ন করার ঘোষণা দিয়েছিলেন। তবে সমঝোতা আলোচনার একপর্যায়ে ২০১৩ সালে তাঁকে পেগাসাস স্পাইওয়্যার কেনার প্রস্তাব দেওয়া হয়। তখন তিনি তাতে রাজি হয়ে যান। স্পাইওয়্যার বিক্রির মাধ্যমে কীভাবে কোম্পানির ব্যবসা ও রাষ্ট্রের লাভ হয়েছে, তা নিউইয়র্ক টাইমস–এর প্রতিবেদনে উঠে আসে।
তথ্যসূত্র:

  • নিউইয়র্ক টাইমস
  • বিবিসি নিউজ