কোনও দল, মত বা রংয়ের প্রসঙ্গ তুললেন না। তবে সময়ের ইঙ্গিত করে বুঝিয়ে দিলেন বর্তমানে যে পরিস্থিতি ভারতে চলছে, তা বেশি দিন চলবে না। আর এ প্রসঙ্গেই ভেদাভেদ, ঘৃণা, বিরুদ্ধে তাঁর অনমনীয় মনোভাবের বার্তা দিলেন নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ অমর্ত্য সেন। রোববার কলকাতায় তাঁর নামাঙ্কিত রিসার্চ সেন্টারে এক আলাপচারিতায় অমর্ত্য বলেন, ‘ভারতে কখনও এমন অবস্থা বেশি দিন চলেনি।’
তাঁর সংযোজন, ‘মতের মিল না হলে মানুষকে মারধর করা হচ্ছে। অন্যের বক্তব্য শুনতে আপত্তি করা হচ্ছে। মানুষকে মর্যাদা দেওয়ার ক্ষমতা কমেছে।’ এই পরিস্থিতিতে তাঁর সমাধানবার্তা- ‘একসঙ্গে কাজ করার ঝোঁক বাড়াতে হবে। পার্থক্যকে বর্জন করতে হবে। আমাদের মধ্যে দূরত্ব কমানো দরকার।’ পরে সাংবাদিকদের প্রশ্নের উত্তরে নাগরিত্ব আইন প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘এরা যে সবরকম ভাবে বিভাজন চায়, সেটাতে আমি আর অবাক হই না।’ নরেন্দ্র মোদী সরকারের বিরুদ্ধে বিভাজন ও অসহিষ্ণুতার অভিযোগ তুলে ‘ভারত জোড়ো যাত্রা’য় নেমেছেন কংগ্রেস নেতা রাহুল গান্ধী। লোকসভা ভোট যত এগিয়ে আসছে, ততই কেন্দ্রের বিরুদ্ধে এই ইস্যুকে ধারালো করার চেষ্টা করছে বিরোধীরা। এই পরিস্থিতিতে অমর্ত্যর বক্তব্য তাৎপর্যপূর্ণ বলে মনে করছে রাজনৈতিক মহল।
মাতামহ ক্ষিতিমোহন সেনের যুক্তসাধনার তত্ত্বের উপরে স্কুল, কলেজের ছাত্রছাত্রী, শিক্ষক, গবেষকের সঙ্গে আলোচনায় বসেছিলেন অমর্ত্য। আয়োজন করেছিল প্রতীচী ট্রাস্ট। সেখানে সপ্তম শ্রেণির ছাত্রী রূপকথা সরকার নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদকে প্রশ্ন করে, ‘যুক্তসাধনার উপকারিতা কী? কী ভাবে আমরা এক হয়ে কাজ করতে পারি?’ সেই প্রশ্নের উত্তর দিতে গিয়েই অমর্ত্য নিজের মনোভাব প্রকাশ করেছেন। আবার এক শিক্ষক প্রশ্ন করেন, ‘দেশের বৈচিত্র আমরা কী ভাবে ধরে রাখতে পারি?’ এ প্রসঙ্গে অবশ্য প্রচলিত মতবাদের খানিকটা ভিন্ন ছবি তুলে ধরেছেন অমর্ত্য।
তাঁর পাল্টা প্রশ্ন, ‘বৈচিত্র কি সব সময়ে ভালো?’ তাঁর ব্যাখ্যা, ‘ইদানীং ভারতকে নানা ধরনের বৈচিত্র গ্রাস করেছে, যা আগে হয়নি।’ উদাহরণ হিসেবে জানিয়ে দেন, যে ভাবে একাংশের হাতে প্রচুর অর্থ আর অন্যদল অভুক্ত, সেই বৈচিত্র তিনি পছন্দ করেন না। তাই অমর্ত্য মনে করেন, ‘বৈচিত্রের প্রশংসা এবং সমস্যা, দুটো দিকই দেখার দরকার আছে।’ এ প্রসঙ্গে তিনি স্বাধীনতা সংগ্রামের সময়ে মহাত্মা গান্ধীর কথা তুলে আনেন- ‘গান্ধী নিজেও স্বাধীনতা সংগ্রামের প্রস্তুতি-পর্বে বলেছিলেন আমাদের মধ্যে পৃথকীকরণ কমাতে হবে। আরও ঐক্যবদ্ধ হতে হবে।’ অর্মত্য মনে করেন, ‘অন্যকে সম্মান জানানোর ক্ষমতা আমাদের কমছে। আর সেটাই আমাদের পিছিয়ে থাকার অন্যতম কারণ।’
নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদের বক্তব্য নিয়ে শুরু হয়েছে রাজনৈতিক চাপানউতোর। তৃণমূলের রাজ্যসভার সচেতক সুখেন্দুশেখর রায়ের ব্যাখ্যা, আসলে অমর্ত্য সেন দেশজুড়ে চলা ‘বিভাজনের বৈচিত্র’-এরই সমালোচনা করতে চেয়েছেন। তাঁর ব্যাখ্যা, ধর্ম, জাতি, লিঙ্গ, ভাষার নিরিখে যে ভাবে বিজেপি পুরো দেশকে বিভাজিত করেছে, সেই পরিস্থিতির বদল চেয়েছেন তিনি। তাঁর কথায়, ‘শুধু ভারত নয়, সারা পৃথিবীতেই কর্তৃত্ববাদী শাসন বেশি দিন চলেনি। ভারতেও যে চলবে না, সেটাই তিনি বোঝাতে চেয়েছেন। আমরা তাঁর এই বক্তব্যকে স্বাগত জানাই।’
যদিও বিজেপির সর্বভারতীয় সহ-সভাপতি দিলীপ ঘোষের কটাক্ষ, ‘উনি তো অর্থনীতিবিদ! অর্থনীতি নিয়ে কিছু বলেছেন কি?’ তাঁর সংযোজন, ‘ভারত নিয়ে অমর্ত্য সেনকে ভাবতে হবে না। সারা পৃথিবীতে ভারত এখন শক্তিশালী। কিন্তু পশ্চিমবঙ্গের অবস্থা বেশি দিন এমন চলবে না। এখানে পরিবর্তন হবেই, সেটা অমর্ত্যবাবু যেন জেনে রাখেন।’ সুখেন্দুশেখরের অবশ্য পাল্টা কটাক্ষ, ‘অমর্ত্য সেন শুধু বাংলা বা ভারতের নন, তাঁর কথায় সারা পৃথিবীর জ্ঞানচর্চার সাধনা হয়। তাই তাঁর সম্পর্কে বলার আগে পেটে কালি-অক্ষরের চিহ্ন কিছুটা হলেও থাকতে হয়।’
সিপিমএমের রাজ্য সম্পাদক মহম্মদ সেলিমের বক্তব্য, ‘একজন প্রকৃত চিন্তাবিদ হিসেবেই তিনি তাঁর উপলব্ধির কথা জানিয়েছেন।’ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর থেকে অমর্ত্য সেনের ভারত যে ট্র্যাডিশন বহন করে, যেখানে সংখ্যাগরিষ্ঠতা নয়, বহুত্ববাদের কথা বলা হয়, ঐক্যের কথা বলা হয়- প্রখ্যাত এই অর্থনীতিবিদ সেই চিরন্তন ভাবনাকেই ব্যক্ত করেছেন বলে মনে করেন সেলিম।
দৈনিক কলম কথা সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।