ইরানে দুর্যোগপূর্ণ আবহাওয়ায় হেলিকপ্টার বিধ্বস্ত হয়ে প্রেসিডেন্ট ইব্রাহিম রাইসি, পররাষ্ট্রমন্ত্রী আমিরাব্দুল্লাহিয়ানসহ আরোহীদের সবাই নিহত হয়েছেন। রোববার ইরানের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলে হেলিকপ্টার দুর্ঘটনার কয়েক ঘণ্টা পর সোমবার সকালে নিহতদের মরদেহ পাওয়া গেছে বলে রাষ্ট্রীয় গণমাধ্যম জানিয়েছে। এ খবরে শোকে স্তব্ধ হয়ে পড়েছে ইরানের জনগণ। এ অবস্থায় দেশে পাঁচ দিনের জাতীয় শোক ঘোষণা করেছেন সর্বোচ্চ ধর্মীয় নেতা। খবর, বিবিসি, রয়টার্স, আলজাজিরার।

বিভিন্ন গণমাধ্যম সূত্রে জানা গেছে, দুর্গম পাহাড়ি এলাকায় চরম দুর্যোগপূর্ণ আবহাওয়ার মধ্যে প্রায় ১৫ ঘণ্টা অনুসন্ধানের পর স্থানীয় সময় সোমবার সকাল ৭টা নাগাদ ইরানের প্রেসিডেন্ট সাইয়্যেদ ইব্রাহিম রাইসিকে বহনকারী হেলিকপ্টারের ধ্বংসাবশেষের সন্ধান পাওয়া যায়। প্রাপ্ত ছবি ও ভিডিওতে দেখা গেছে, ঘন পাহাড়ি জঙ্গলে হেলিকপ্টারের ধ্বংসাবশেষ পড়ে রয়েছে। হেলিকপ্টারের লেজের একটি অংশ ছাড়া বাকি পুরো অংশ আগুনে ভস্মীভূত হয়েছে।

রোববার আজারবাইজানের সীমান্তবর্তী এলাকায় দুই দেশের অর্থায়নে নির্মিত একটি বাঁধ উদ্বোধন করতে গিয়েছিলেন প্রেসিডেন্ট রাইসি। সেখানে আজারবাইজানের প্রেসিডেন্ট ইলহাম আলিয়েভও ছিলেন। সেখান থেকে তিনটি হেলিকপ্টারের বহর নিয়ে ইরানের পূর্ব আজারবাইজান প্রদেশের রাজধানী তাবরিজে ফিরছিলেন রাইসি ও সঙ্গে থাকা অন্য কর্মকর্তারা। পথে পূর্ব আজারবাইজানের জোলফা এলাকার কাছে দুর্গম পাহাড়ে প্রেসিডেন্টকে বহনকারী হেলিকপ্টারটি বিধ্বস্ত হয়। অন্য দুটি হেলিকপ্টার নিরাপদে গন্তব্যে পৌঁছেছে।

হেলিকপ্টার দুর্ঘটনায় ইরানের প্রেসিডেন্ট ও পররাষ্ট্রমন্ত্রীসহ তাদের সফরসঙ্গীদের মৃত্যুর ঘটনায় শোক জানিয়েছেন সর্বোচ্চ নেতা আয়াতুল্লাহ সাইয়্যেদ আলী খামেনি। সোমবার এক শোকবার্তায় তিনি বলেন, অত্যন্ত দুঃখভারাক্রান্ত মনে জননন্দিত, যোগ্য ও পরিশ্রমী প্রেসিডেন্ট হুজ্জাতুল ইসলাম সাইয়্যেদ ইব্রাহিম রাইসি ও তার সফরসঙ্গীদের শাহাদাতের তিক্ত খবর পেয়েছি। এই দুঃখজনক ঘটনাটিও ঘটেছে যখন তিনি (রাইসি) সেবামূলক কাজে ব্যস্ত ছিলেন। এই সম্মানিত ও নিঃস্বার্থ ব্যক্তির নানা দায়িত্ব পালনের পুরো সময়টা সম্পূর্ণরূপে জনগণ ও ইসলামের সেবায় নিরলস প্রচেষ্টায় অতিবাহিত হয়েছে। প্রেসিডেন্ট থাকাকালে এবং প্রেসিডেন্ট হওয়ার আগেও তিনি একইরকম ছিলেন। প্রিয় রাইসি ক্লান্তি কী জিনিস তা যেন জানতেনই না।

সর্বোচ্চ নেতা আরও বলেন, এই ঘটনায় আমি পাঁচ দিনের সর্বজনীন শোক ঘোষণা করছি এবং ইরানের প্রিয় জনগণের প্রতি সমবেদনা জানাচ্ছি। এদিকে রাইসির মৃত্যুতে তিন দিনের শোক ঘোষণা করেছেন লেবাননের প্রধানমন্ত্রী নাজিব মিকাতি। এছাড়া ইরানের প্রেসিডেন্টের মৃত্যুতে একদিনের শোক ঘোষণা করেছে পাকিস্তান।

প্রথম জানাজা মঙ্গলবার: উদ্ধারের পর মৃতদেহগুলো তাবরিজ শহরে স্থানান্তর করা হচ্ছে। সেখানে ময়নাতদন্ত করা হবে। এরপর মঙ্গলবার তাবরিজে প্রথম জানাজা দেওয়া হবে বলে কর্মকর্তারা জানিয়েছেন। এরপর সবার মৃতদেহ রাজধানী তেহরানে স্থানান্তর করা হবে।

সেখানে রাষ্ট্রীয় গণ্যমান্য ব্যক্তিরা এবং জনগণ তাদের শ্রদ্ধা জানাবেন। তারপর ইরানের গুরুত্বপূর্ণ মাশহাদ শহরে সবাইকে দাফন করা হবে বলে কর্মকর্তারা ধারণা করছেন।

হেলিকপ্টারে আরও যারা ছিলেন: ওই হেলিকপ্টারে প্রেসিডেন্ট রাইসি ছাড়াও পররাষ্ট্রমন্ত্রী হোসেইন আমির-আব্দুল্লাহিয়ান, পূর্ব আজারবাইজান প্রদেশের গভর্নর মালেক রাহমাতি এবং ওই প্রদেশে ইরানের সর্বোচ্চ নেতার মুখপাত্র আয়াতুল্লাহ মোহাম্মদ আলী আলে-হাশেম ছিলেন। হেলিকপ্টারের মোট ৯ আরোহীর বাকি পাঁচ আরোহী হলেন- ব্রিগেডিয়ার জেনারেল সাইয়্যেদ মেহদি মুসাভি (প্রেসিডেন্টের দেহরক্ষী), আনসারুল মাহদি বাহিনীর এক সদস্য (পরিচয় জানা যায়নি), পাইলট কর্নেল সাইয়্যেদ তাহের মুস্তাফাভি, কো-পাইলট মোহসেন দারইয়ানুস, ক্রু মেজর বেহরুজ ঘাদিমি।

ইরানের রেড ক্রিসেন্ট জানিয়েছে, হেলিকপ্টার বিধ্বস্ত হয়ে নিহত প্রেসিডেন্ট ইব্রাহিম রাইসি ও তার সহযাত্রীদের মরদেহ উদ্ধার করা হয়েছে এবং উদ্ধার কার্যক্রম বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। রেড ক্রিসেন্ট প্রধান পির-হোসেন কোলিভান্দ রাষ্ট্রীয় টিভিকে জানান, ‘আমরা নিহতদের মরদেহ তাবরিজে স্থানান্তরের কাজ শুরু করেছি। উদ্ধার কার্যক্রম শেষ হয়েছে।’ কোলিভান্দ আরও জানান, গতকাল থেকে উদ্ধারকর্মীরা ঘটনাস্থলে থাকলেও বৈরী আবহাওয়া ও ঘন কুয়াশার কারণে উদ্ধার কার্যক্রম ব্যাহত হয়েছে।

এ উদ্ধার অভিযানে ২০০০-এর বেশি মানুষ যোগ দিয়েছিলেন বলে জানিয়েছে ইরানের রেড ক্রিসেন্ট সোসাইটি।

প্রেসিডেন্টকে বহনকারী হেলিকপ্টার: প্রেসিডেন্ট রাইসিকে বহনকারী হেলিকপ্টারটি ছিল বেল-২১২ মডেলের। এই মডেলটি ইউএইচ-১এন ‘টুইন হুয়েই’র বেসামরিক সংস্করণ। এ হেলিকপ্টার বিশ্বব্যাপী সরকারি-বেসরকারিভাবে বহুল ব্যবহৃত। ১৯৬০-এর দশকের শেষের দিকে মূল ইউএইচ-১ ইরোকুইসের আপগ্রেড হিসাবে কানাডিয়ান সামরিক বাহিনীর জন্য এটি তৈরি করে মার্কিন প্রতিষ্ঠান বেল হেলিকপ্টার। এর আপগ্রেড মডেলের ডিজাইনে একটির বদলে দুটি টার্বোশ্যাফ্ট ইঞ্জিন ব্যবহার করা হয়েছে। এর ফলে এর বহন ক্ষমতা বেড়েছে। মার্কিন সামরিক প্রশিক্ষণ নথি অনুসারে, নতুন মডেলের এই হেলিকপ্টার ১৯৭১ সালে তৈরি করা হয় এবং যুক্তরাষ্ট্র ও কানাডায় এর ব্যবহার শুরু হয়। পরিবহণ হেলিকপ্টার হিসাবে এই মডেল মানুষ বহন, এরিয়াল ফায়ার ফাইটিং গিয়ার মোতায়েন, কার্গো বহন ও অস্ত্র মাউন্ট করাসহ সব ধরনের পরিস্থিতির জন্য উপযোগী। এটি ক্রুসহ ১৫ জনকে বহন করতে পারে।

মন্ত্রিসভায় জরুরি বৈঠক: প্রেসিডেন্ট রাইসির অনাকাক্সিক্ষত মৃত্যুর পর জরুরি বৈঠকে বসেছে ইরানের মন্ত্রিপরিষদ। সোমবার এ বৈঠকে সভাপতিত্ব করেন ফার্স্ট ভাইস প্রেসিডেন্ট মোহাম্মদ মোখাবের। এক বিবৃতিতে মন্ত্রিসভা গভীর শোক প্রকাশ করে সর্বোচ্চ নেতা খামেনির কাছে বার্তা পাঠিয়েছে। এই বার্তায় মন্ত্রিসভা প্রেসিডেন্ট রাইসির পথ অনুসরণ করার প্রতিশ্রুতি ব্যক্ত করেছে এবং তার অসমাপ্ত কাজকে এগিয়ে নেওয়ার পূর্ণ আশ্বাস দিয়েছে। মন্ত্রিসভা ওই শোকবার্তায় বলেছে, সংকটময় সময়ে দেশের প্রশাসনিক কাজে বিন্দুমাত্র বিঘ্ন ঘটার সুযোগ তারা দেবে না।

এর আগে রোববার প্রেসিডেন্ট এবং পররাষ্ট্রমন্ত্রীসহ গুরুত্বপূর্ণ কর্মকর্তাদের বহনকারী হেলিকপ্টার দুর্ঘটনায় পড়ার পর সর্বোচ্চ নেতা বলেছিলেন, দেশের জনগণের মোটেও চিন্তিত বা উদ্বিগ্ন হওয়ার প্রয়োজন নেই; দেশের কাজে কোনো বিঘ্ন সৃষ্টি হবে না।