বৈজ্ঞানিক নাম (Curcuma Longa) কে বলা হয় হলুদ। গাছের শিকড় থেকে পাওয়া এক ধরণের মশলা। বাংলাদেশ, ভারত ছাড়াও পৃথিবীর অনেক দেশেই এটি রান্নায় মশলা হিসেবে ব্যবহার করা হয়। হলুদের প্রাচীন উৎস হলো দক্ষিণ এশিয়া থেকেই। ২০–৩০ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রায় হলুদের জন্ম হয় এবং প্রচুর পরিমাণে বৃষ্টির দরকার হয়। বছরে একবার ই হলুদ উত্তোলন করা হয় এবং পরের বছর অই একই শিকড় থেকে নতুন হলুদের গাছ গজায়।

হলুদ হচ্ছে প্রাকৃতিক অ্যান্টিবায়েটিক। এক গ্লাস হালকা গরম দুধের সঙ্গে এক চা চামচ হলুদ গুঁড়া মিশিয়ে নিয়মিত পান করলে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ানোর পাশাপাশি আরও নানা উপকার পেতে পারি:
•       অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট সমৃদ্ধ বলে বিভিন্ন ইনফেকশন থেকে রক্ষা করে

•       বিশেষ করে শ্বাসতন্ত্রের ইনফেকশনের বিরুদ্ধেও কাজ করে এই গোল্ড মিল্ক

•       হলুদের প্রধান উপাদান কারকিউমিন ক্যান্সারের কোষ ধ্বংস করে এবং ক্যান্সার ছড়িয়ে পড়া রোধ করে

•       পলিফেনল এবং ক্যাচচিনের কারণে হলুদ হজমশক্তি বৃদ্ধি ও দ্রুত চর্বি গলাতে সাহায্য করে ও গ্যাস্টিকের সমস্যা দূর হয়

•       দুধ-হলুদ লিভারের জন্য ভালো। একটি গবেষণায় দেখা যায় যে, হলুদের পলিফিনল লিভারকে সুস্থ রাখে ও হেপাটাইটিসের চিকিৎসায় সহায়তা করে

•       সর্দি জ্বরের ওষুধ হিসেবে এই দুধ পান করা হয়

•       রক্তে শর্করার মাত্রা নিয়ন্ত্রণ করে, টাইপ -২ ডায়াবেটিস প্রতিরোধ করতে সাহায্য করে

•       হলুদ পুষ্টিকর এবং অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট সমৃদ্ধ যা শরীরে ও ত্বকে বয়সের ছাপ পড়তে দেয় না

•       গর্ভাবস্থায় দিনে এক গ্লাস হলুদ গুঁড়া মেশানো দুধ পান করা ভালো

•       এছাড়াও গায়ের রং উজ্জ্বল করে

•       হলুদে উপস্থিত অ্যারোমেটিক টারমেরোন মস্তিষ্কের কর্মক্ষমতা বাড়ায়।

এছাড়া ত্বকের যত্নেও হলুদের জুড়ি নেই। মধু, কাঁচা হলুদ, দুধ ও তিলের তেল চুলায় অল্প আঁচে নাড়তে থাকুন। আঠালো হয়ে এলে নামিয়ে ঠাণ্ডা করে ফ্রিজে রেখে দিন। বাইরে থেকে ফিরে প্রতিদিন এই প্যাক ব্যবহার করতে পারেন। শীতে উজ্জ্বল, কোমল ও দাগহীন ত্বক পেয়ে যাবেন খুব সহজে।

হলুদে প্রচুর পরিমাণ ফাইবার, পটাশিয়াম, ভিটামিন বি-৬, ম্যাগনেশিয়াম ও ভিটামিন-সি থাকে ও কারকিউমিন নামক রাসায়নিক থাকে যা বিভিন্ন রোগের হাত থেকে আমাদের বাঁচায়। সকালে ঘুম থেকে উঠে কাঁচা হলুদ খেলে যে ত্বকের ঔজ্জ্বল্য বাড়ে, খাবার ঠিকমতো হজম হয়, এসব কথা তো আমরা বহুদিন ধরেই জেনে আসছি। আসুন, আজ জেনে নেওয়া যাক কাঁচা হলুদের অসংখ্য এমন কিছু গুণের কথা, যার বেশীরভাগটাই আপনার কাছে হয়ত অজানা।

১. কাঁচা হলুদ খাদ্য পরিপাকে

কাঁচা হলুদের মধ্যে গ্যাস্ট্রো-প্রটেক্টিভ কিছু গুণ থাকে যা খাবার পরিপাকে সাহায্য করে। ফলে হজমের গোলমাল, গ্যাসের সমস্যার ক্ষেত্রে কাঁচা হলুদ খুবই উপকার দেয়।

২. কাঁচা হলুদ খাদ্য সংক্রমণ থেকে বাঁচতে

হলুদে থাকা কারকিউমিনের অ্যান্টি-ইনফ্লেমেটরি ও অ্যান্টি-অক্সিড্যান্ট উপাদান থাকায় তা বিভিন্ন ব্যাকটেরিয়ার আক্রমণ থেকে খাদ্যনালীকে বাঁচায়। আমরা রোজ যে খাবার খাই, তার মধ্যে অনেকসময়ই নানা জীবাণু থেকে যেতে পারে। খাবারে কাঁচা হলুদ বা হলুদ গুঁড়ো ব্যবহার করলে তা খাদ্যনালীকে ক্ষতিকারক জীবাণুর সংক্রমণ থেকে বাঁচায় ও খাদ্যনালীর প্রদাহের সম্ভাবনা কমায়।

৩. কাঁচা হলুদ হাড় জোড়া লাগাতে

বহু প্রাচীনকাল থেকেই কাঁচা হলুদকে হাড়ের নানারকম রোগের ক্ষেত্রে ব্যবহার করা হয়। হাত বা পা মচকে গেলে চুন-হলুদ লাগানোর কথা তো আমরা সবাইই জানি। এছাড়া কাঁচা হলুদ বেটে ভাঙ্গা হাড়ের জায়গায় লাগালে তা উপকার দেয়। দুধে কাঁচা হলুদ দিয়ে খেলেও তা এক্ষেত্রে উপকার দেয়। হলুদের অ্যান্টি-ইনফ্লেমেটরি গুণ ব্যথা, প্রদাহকে কমায় এবং হাড়ের টিস্যুগুলিকে রক্ষা করে ও ভাঙ্গা হাড় জোড়া লাগতে সাহায্য করে।

৪. কাঁচা হলুদ হাড়ের ক্ষয় রোধে

কাঁচা হলুদে থাকা কারকিউমিন হাড়ের ক্ষয় ও হাড়ের গঠনের মধ্যে সামঞ্জস্য বজায় রাখে ও হাড়কে সুস্থ ও মজবুত রাখে। মেনোপজের সময় মহিলাদের যে হাড়ের ক্ষয় হয়, তা থেকেও কাঁচা হলুদ আমাদের বাঁচায়।

৫. কাঁচা হলুদ ট্রমাটিক ডিসঅর্ডার কমাতে

ট্রমাটিক ডিসঅর্ডারের ক্ষেত্রে যেসমস্ত খারাপ, ভীতিজনক স্মৃতি থাকে, হলুদে থাকা কারকিউমিন তা কমাতে সাহায্য করে। এছাড়া কাঁচা হলুদের অ্যান্টি-ইনফ্লেমেটরি গুণ স্ট্রেস বা চাপ, উদ্বেগ থেকে আমাদের মুক্তি দেয়।

৬. কাঁচা হলুদ ডায়াবেটিসে

হলুদ ও হলুদে থাকা কারকিউমিন অ্যান্টি-ডায়াবেটিক এজেন্ট হিসেবে কাজ করে ও রক্তে শর্করার মাত্রা কমাতে সাহায্য করে। এছাড়া কাঁচা হলুদ ইনসুলিন হরমোনের ক্রিয়াকে নিয়ন্ত্রণ করে রক্তে শর্করার মাত্রা নিয়ন্ত্রণে রাখে ও অগ্ন্যাশয়কে সুস্থ রাখে।

৭. কাঁচা হলুদ ত্বকের বয়স কমাতে

কাঁচা হলুদ বহু প্রাচীনকাল থেকেই ত্বকের ঔজ্জ্বল্য রক্ষা করতে ও ত্বকের বয়স কমায়। তাই বিভিন্ন ক্রিমের প্রয়োজনীয় উপাদান হিসেবে হলুদ ব্যবহার করা হয়। ত্বকের বিভিন্ন দাগ, রিঙ্কল ও সান ট্যান থেকে ত্বককে রক্ষা করার জন্য কাঁচা হলুদের পেস্ট ঘরেই তৈরি করে মুখে লাগানো যেতে পারে। হলুদে থাকা কারকিউমিনের অ্যান্টি-অক্সিড্যান্ট গুণ ত্বককে বয়সের ছাপ থেকে বাঁচায়।

৮. কাঁচা হলুদ ক্যান্সার দূর করতে

কাঁচা হলুদে থাকা কারকিউমিন ক্যান্সার দূর করতে সহায়তা করে। কারকিউমিন ক্যান্সার কোষের বৃদ্ধি বন্ধ করে তাদের মৃত্যু ঘটায়। ফলে ক্যান্সারের সম্ভাবনা হ্রাস পায়। বিভিন্ন স্টাডি থেকে জানা গেছে প্রায় ৫৬ রকম ক্যান্সারের সম্ভাবনা কাঁচা হলুদ রোজ নিয়মিত খেলে কমে।

৯. কাঁচা হলুদ আরথ্রাইটিসের হাত থেকে বাঁচতে

হলুদে থাকা কারকিউমিন নানাভাবে আরথ্রাইটিসের হাত থেকে আমাদের বাঁচায়। কাঁচা হলুদ অ্যান্টি-ইনফ্লেমেটরি এজেন্ট হিসেবে কাজ করে ও তা হাড়ের কোষকে রক্ষা করে। ফলে যারা রিউম্যাটয়েড আরথ্রাইটিসে ভোগেন, দেখা গেছে সাধারণ ফিজিওথেরাপির থেকে তাঁরা যদি নিয়ম করে কাঁচা হলুদ খান, তাহলে তা ব্যথা কমায় ও হাড়ের জয়েন্টের মুভমেন্টে অনেক সাহায্য করে।

১০. কাঁচা হলুদ মনমরা ভাব কাটাতে

কাঁচা হলুদের অ্যান্টি-অক্সিড্যান্ট গুণ আমাদের বিষণ্ণ মনমরা ভাব, বদমেজাজ, ডিপ্রেশন কাটিয়ে মনকে চনমনে করে তুলতে সাহায্য করে।

১১. কাঁচা হলুদ স্ট্রোকের পরে

নিয়ম করে কাঁচা হলুদ খাওয়া আমাদের স্ট্রোকের সম্ভাবনাকে এক ধাক্কায় অনেকটা কমিয়ে দিতে পারে। এছাড়া কাঁচা হলুদের অ্যান্টি-অক্সিড্যান্ট ও অ্যান্টি-ইনফ্লেমেটরি গুণ স্ট্রোকের পরবর্তী চিকিৎসাতেও অনেক উপকার দেয়। কাঁচা হলুদ হার্টকেও বিভিন্ন ক্ষতির হাত থেকে রক্ষা করে। এছাড়া অপারেশনের পরে যে হার্ট অ্যাটাকের সম্ভাবনা থাকে, তাকেও কাঁচা হলুদ কমাতে সাহায্য করে।

১২. কাঁচা হলুদ চুলের জন্য

কাঁচা হলুদ খুশকির সমস্যা, চুল পড়ার সমস্যা, ইত্যাদির থেকেও আমাদের মুক্তি দেয়।

রান্নায় হলুদ সাধারণত গুঁড়ো মশলা আকারেই ব্যবহার করা হলেও কাঁচা হলুদও নানা কাজে ব্যবহৃত হয়। আর কাঁচা হলুদের উপকারিতাও মারাত্মক। কাঁচা হলুদের অ্যান্টি-ব্যাকটেরিয়াল, অ্যান্টি-ভাইরাল, অ্যান্টি-অক্সিড্যান্ট, অ্যান্টি-ইনফ্লেমেটরি ইত্যাদি নানা গুণ থাকায় হলুদ বিভিন্ন রোগের চিকিৎসায়, বিশেষত আয়ুর্বেদিক ওষুধপত্র তৈরিতে কাজে লাগে। ১ আউন্স বা প্রায় ২৮ গ্রাম হলুদ আমাদের শরীরে দৈনিক যে ম্যাঙ্গানীজ প্রয়োজন হয়, তার প্রায় ২৬ শতাংশই যোগান দেয়। এছাড়া রোজকার চাহিদার প্রায় ১৬ শতাংশ লোহা বা আয়রনের যোগানও ওই মাত্র ২৮ গ্রাম হলুদ থেকেই আসে।