উপরের আস্তরণটা কালো রঙের। আকারে ছোট। দেখতে অনেকটা জামের মতো। কিন্তু অত্যন্ত সুস্বাদু ও মানসম্পন্ন। বলছি আজওয়া তুমুরের কথা। খেজুরকে আরবিতে বলা হয় তুমুর। এ খেজুর মদিনার উৎকৃষ্টতম খেজুর। খেজুরের মধ্যে সবচেয়ে দামী ও সর্বোত্তম খেজুর হলো আজওয়া খেজুর। সারাবিশ্বে প্রায় তিন হাজার ধরনের খেজুর পাওয়া যায়। তবে খেজুরের জন্য সবচেয়ে প্রসিদ্ধ দেশ হিসেবে দেখা হয় মুসলমানদের পূণ্যভূমি বলে পরিচিত সৌদি আরবকে। এই সৌদি আরবেই পাওয়া যায় বিখ্যাত আজওয়া খেজুর।

ইসলামিক স্কলারগণ হাদীসের মাধ্যমে দাবী করেন, আজওয়া খেজুর শরীরের রোগ প্রতিরোধের জন্য অনবদ্য ভুমিকা পালন করে। তেমনি চিকিৎসা বিজ্ঞানেও এটা প্রমাণিত হয়েছে। নিমিষেই শরীরের ক্লান্তিভাব দূর করা, ব্যাপকভাবে মস্তিস্কের কার্যক্ষমতা বৃদ্ধি, সকল ধরনের যৌন সমস্যা দুর করাসহ সকল ধরনের পুষ্টি সমৃদ্ধ হচ্ছে আজওয়া খেজুর। কেন এত গুণে গুণান্বিত এই আজওয়া খেজুর?

আজওয়ার উৎপত্তির গল্প
‘মাহাবা’ নামক এক দাস মদিনার এক খেজুর বাগানে কাজ করতো। ইসলাম গ্রহণের পর তিনি দাসমুক্তি পেতে চাইলে বড় শর্তের মুখোমুখি হতে হলো। দিতে হবে প্রায় ৬০০ দিরহাম এবং খুব অল্প দিনে খেজুর গাছ রোপণ করে তা থেকে সর্বোৎকৃষ্ট মানের খেজুর উৎপাদন করতে হবে। সমাধানের জন্য রাসূল (সাঃ) এর কাছে গেলে, তিনি নিজে বাগানে গেলেন এবং ইহুদি সেই বাগান মালিকের কাছে খেজুর বীজ নিয়ে দেখলেন, সব বীজ পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে, যেনো কোনো মতেই তা থেকে চারা উৎপাদন সম্ভব না হয়।

নবী (সাঃ) মাহাবা কে অর্থাৎ হযরত সালমান ফারসী (রঃ) (ইসলাম গ্রহণের পর মহানবী (সঃ) মাহাবার নাম দেন সালমান ফারসী) কে বললেন, নবীজী নিজে গর্ত করে খেজুর বীজ বপন করবেন এবং সালমান ফারসী (রঃ) যেনো কুয়া থেকে পানি সংগ্রহ করে তাতে পানি দেয় এবং পানি দেওয়ার পর পিছনে ফিরে তাকাতে একদম নিষেধ করলেন। যা বলা, তা ই কাজ। সবগুলো বপন শেষে পিছনে ফিরে তাকালে দেখেন সবগুলো চারা গজিয়ে গেছে এবং অল্প সময়ের মধ্যেই তা থেকে কালো রংয়ের প্রচুর খেজুর উৎপাদন হয়েছে। এই খেজুরের বীজগুলো ছিলো আগুনে পোড়া কয়লার মতো কালো। তাই এর স্বাদও অনেকটা পোড়া পোড়া গন্ধ। যার নাম আজওয়া।

চিকিৎসা বিজ্ঞানে আজওয়া
২০১৭ সালে প্রকাশিত একটি গবেষণাতে বিজ্ঞানীরা বলছেন, প্রেগনেন্সির শেষ দিকে খেজুর খেলে সন্তান জন্ম দেওয়া সুবিধের হয়। সন্তান জন্ম দেওয়ার পরে খেজুর খেলে পোস্ট পাট্রাম ডিপ্রেশন ঠেকাতে সাহায্য করে, দুধের পরিমাণ বাড়ায়, নিফাসকালীন রক্তপাত কমায়। বিজ্ঞানীরা এক্ষেত্রে আজওয়া খেজুরের কথা বলে থাকেন।

কারণ উপরের উপকারের পাশাপাশি আজওয়া অদেখা আপদ থেকে সন্তান এবং মাকে নিরাপত্তা দেয়। চিকিৎসা বিজ্ঞানের তথ্য মতে, আজওয়া খেজুরে আছে-‘আমিষ, শর্করা, প্রয়োজনীয় খাদ্য আঁশ ও স্বাস্থ্যসম্মত ফ্যাট। এছাড়া ভিটামিন এ, বি সিক্স, সি এবং কে দ্বারা ভরপুর। ভিটামিন ‘এ’-এর গুরুত্বপূর্ণ উপাদান ‘ক্যারোটিন’ও রয়েছে এতে। ক্যারোটিন চোখের সুস্থতার জন্য অত্যন্ত উপকারী। আরও রয়েছে স্বাস্থ্যকর উপাদান ফলেট, নিয়াসিন, থিয়ামিন ও রিবোফ্লেভিন।

শারীরিক সুস্থতায় আজওয়া

খেজুরের মধ্যে আজওয়া খেজুর অনেক উন্নত এবং দামি। আর এতে রয়েছে মানুষের সুস্বাস্থ্যের জন্য অনেক উপকারি উপাদান। গবেষকদের মতে, শুকনা খাবারের মধ্যে খেজুরেই সবচেয়ে বেশি পলিফেনল থাকে। বিপদজ্জনক অনেক রোগ থেকে রক্ষা করতে সহায়তা করে পলিফেনল। খেজুরের চেয়ে ভালো পটাশিয়াম উৎস আর হয় না। এটা সোডিয়ামেরও ভালো উৎস। কিডনি ও স্ট্রোক জটিলতা এড়াতে এর ব্যাপক প্রয়োজন রয়েছে। এ কারণে চিকিৎসকরা প্রতিদিন খেজুর খাওয়ার পরামর্শ দেন। আর সে খেজুর যদি হয় আজওয়া, তাহলে তো কথাই নেই।

আজওয়া খেজুর হৃদরোগের ঝুঁকি কমায়। স্বয়ং রাসূল (সাঃ) হৃদরোগে আক্রান্তের চিকিৎসায় এই খেজুর খেতে পরামর্শ দিয়েছেন। এতে আছে ডায়েটরই ফাইবার যা কোলেস্টোরল থেকে মুক্তি দেয়। ভিটামিন-এ সমৃদ্ধ এই ফল দৃষ্টিশক্তির জন্য গুরুত্বপূর্ণ। ডায়াবেটিস রোগীদের জন্যও সমান উপকারী আজওয়া। সৌদি আরবের কিং সৌদ বিশ্ববিদ্যালয়ের এক গবেষণার ফলাফল বলছে, আজওয়া খেজুরে যে চিনি রয়েছে সেটি মনোস্যাকারাইড হওয়ায় টাইপ-টু ডায়াবেটিস রোগীরা এই খেজুর খেলে উপকারই পাবেন। সৌদি আরবের বিভিন্ন খেজুর নিয়ে গবেষণা করতে গিয়ে আজওয়াকেই সবচেয়ে উপকারী বলছেন বিশ্ববিদ্যালয়টির গবেষকরা।

কেন বিখ্যাত এই খেজুর?
সৌদি আরবে প্রায় ৩৫ প্রজাতির খেজুর পাওয়া যায়। এর মধ্যে সবচেয়ে সমাদৃত খেজুরের জাতটি হলো আজওয়া। এই আজওয়ার প্যাকিংও বেশ আকর্ষণীয় এবং ওজনে বেশ হালকা। মক্কা ছাড়াও মদিনায় হারাম শরীফে আশেপাশে ও মসজিদে কুবার নিকটবর্তী স্থানে আজওয়া খেজুরের কিছু ফার্ম রয়েছে। ভরা মৌসুম ছাড়াও বছরের বাকি দিনগুলোতেও আজওয়ার দেখা মিলে সৌদির দোকানগুলোয়।

মূলত বিভিন্ন পদ্ধতিতে সংরক্ষণ করে রাখার ফলে আজওয়ার কখনো ঘাটতি দেখা যায় না স্থানীয় বাজারে। তবে সংরক্ষণ করে রাখায় এর স্বাদের কিছুটা হেরফের দেখা যায়। আকার, স্বাদ এবং অবস্থানভেদে সৌদির বিভিন্ন শহরে আজওয়ার দামেও আছে ভিন্নতা। হজ্জ যাত্রীদের কাছে বেশ জনপ্রিয় এই খেজুর। প্রতিবছর হজের মৌসুমে মদিনার বিমানবন্দর এলাকায় আজওয়ার পসরা সাজিয়ে বসেন ব্যবসায়ীরা। বিক্রিও হয় বেশ। সবকিছু মিলিয়ে আজওয়া অন্যান্য খেজুরের জাতের তুলনায় বেশ বিখ্যাতই বলা চলে।

কী বলা হয়েছে হাদিসে?
যে ব্যক্তি প্রত্যহ সকালে সাতটি আজওয়া খেজুর খাবে, সেদিন তাকে কোনো বিষ ও যাদু ক্ষতি করতে পারবে না। আজওয়া খেজুর হলো মদিনার উৎকৃষ্ট মানের খেজুর।
হযরত মোহাম্মদ (সাঃ) (সহীহ বুখারি ও মুসলিম)

বিভিন্ন সহীহ হাদিসের বর্ণনায় আজওয়ার গুরুত্বের কথা এসেছে। হযরত আয়েশা (রাঃ) থেকে বর্ণিত, রাসূল (সাঃ) বলেছেন, ‘নিশ্চয়ই আলিয়ার (মদিনার গ্রাম) আজওয়া খেজুরে রোগ নিরাময়কারী এবং প্রাতঃকালীন প্রতিষেধক।’ (সহীহ মুসলিম) খেজুরের উপকারিতায় বিভিন্ন হাদিসে রাসূল (সাঃ)-এর অনেক বাণী এসেছে। রাসূল (সাঃ) বলেন, ‘যে ব্যক্তি প্রত্যহ সকালে সাতটি আজওয়া খেজুর খাবে, সেদিন তাকে কোনো বিষ ও যাদু ক্ষতি করতে পারবে না। আজওয়া খেজুর হলো মদিনার উৎকৃষ্ট মানের খেজুর।’ (সহীহ বুখারি ও মুসলিম) হযরত সাদ (রাঃ) একবার হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে পড়েন। রাসূল (সাঃ) তাকে দেখতে যান এবং হৃদরোগের চিকিৎসার নসিহত পেশ করেন। সাদ (রাঃ) বলেন, ‘আমি অসুস্থ ছিলাম এবং রাসূল (সাঃ) আমাকে দেখতে এসেছিলেন।

তিনি আমার বুকের ওপর হাত রাখলেন। তখন আমি হৃদয়ে শীতলতা অনুভব করলাম। তিনি বলেন, তোমার হৃদরোগ হয়েছে। এরপর রাসূল (সাঃ) তাকে আজওয়া খেজুর খেতে দিয়ে বললেন, তুমি সাতদিন আজওয়া খেজুর খাবে তাহলে তুমি পরিপূর্ণ সুস্থ হয়ে যাবে।’ (আবু দাউদ) আবু হুরাইরা (রা.) থেকে বর্ণিত হাদিসে রাসূল (সাঃ) বলেছেন, ‘আজওয়া জান্নাতের, এতে বিষক্রিয়ার প্রতিষেধক রয়েছে…।’ (তিরমিজি) আজওয়া খেজুরের এত গুণের কারণে মধ্যপ্রাচ্যসহ মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশ গুলোয় বেশ বিখ্যাত হয়ে উঠেছে এই খেজুর।