রোজায় ডায়াবেটিক রোগীদের বিশেষ সতর্কতা অবলম্বন করতে হয়। খাবার খাওয়া ও জীবন যাপনে পরিবর্তন আনতে হয়। দীর্ঘ সময় না খেয়ে থাকার কারণে সুগার ফল করতে পারে। আবার ইফতারের পর অতিরিক্ত খেয়ে ফেললে নানা জটিলতা দেখা দিতে পারে।
রমজানে সঠিক খাবার ব্যবস্থা নিয়ে বিস্তারিত জানিয়েছেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের সহযোগী অধ্যাপক হরমোন ও ডায়াবেটিস বিশেষজ্ঞ ডা. শাহজাদা সেলিম।
ডায়াবেটিক রোগীর রোজা রাখার সময় সবচেয়ে বেশি সতর্ক থাকতে হবে খাদ্য ব্যবস্থাপনায়।
* সেহরির খাবার সেহরির শেষ সময়ের অল্প কিছুক্ষণ আগে খাওয়া উচিত।
* ইফতারের সময় অধিক পরিমাণে মিষ্টি ও চর্বি জাতীয় খাবার গ্রহণ না করা ভালো।
* ডায়াবেটিক রোগীদের পর্যাপ্ত পরিমাণে পানি ও পুষ্টিকর খাবার খেতে হবে যেন তারা পানিশূন্যতায় না ভোগেন। খেজুর খেলে একটা খেতে পারেন। ফলমূল, শাকসবজি, ডাল ও টক দই তালিকাভুক্ত করতে পারলে ভালো। ডাবের পানি পান করতে পারেন। যদি কোনো পানীয় পান করেন তবে চিনিমুক্ত পানি বেছে নেওয়াই উত্তম। যদি মিষ্টি পানীয় পছন্দ করেন, তবে সুইটনার যেমন- ক্যানডেরাল, জিরো ক্যাল বা সুইটেক্স ইত্যাদি ব্যবহার করতে পারেন (তবে এগুলোও বর্জন করাটা বেশি স্বাস্থ্যকর হবে)। ভাজা পোড়া খাবার যেমন- পেঁয়াজু, বেগুনি, পুরি, পরোটা কাবাব অল্প পরিমাণে খেতে পারেন।
* খাদ্যের ক্যালরি ঠিক রেখে খাওয়ার পরিমাণ এবং ধরন ঠিক করতে হবে। সঠিক সময়ে সঠিক পরিমাণ খাওয়া প্রয়োজন।
যে পরিমাণ ক্যালরিযুক্ত খাবার আগে খেতেন রমজানে ক্যালরির পরিমাণ ঠিক রেখে খাবার সময় এবং ধরন বদলাতে হবে। প্রয়োজন হলে নিউট্রিশনিস্টের সঙ্গে যোগাযোগ করে খাবার তালিকা ঠিক করে নিতে হবে। লক্ষ্য রাখতে হবে ওষুধের সঙ্গে খাবারের যেন সামঞ্জস্য থাকে। ইফতারের সময় অতি ভোজন এবং শেষ রাতে অল্প আহার পরিহার করতে হবে, বরং উল্টোটা হতে পারে।
ডায়াবেটিক রোগীর রোজার সময় খাবারের তালিকা
ইফতার
বুট ভুনা ১/২ কাপ (২৫ গ্রাম কাঁচা বুট)
পেঁয়াজু ২টা বড় মাপের (২৫ গ্রাম ডাল)
বেগুনি ২টা মাঝারি (১০ গ্রাম বেসন)
মুড়ি ২ কাপ (২৫ গ্রাম)
মিষ্টি ফল যে কোনো একটি
(শশা, ক্ষীরা, আমড়া, কাজি পেয়ারা, ডাবের পানি, লেবুর পানি, (চিনি ছাড়া) ও অন্যান্য টক ফল ইচ্ছামত খাওয়া যাবে।)
সন্ধ্যা রাত
আটার
রুটি ৬০ গ্রাম (২টা ছোট পাতলা) বা ভাত ১.৫ কাপ
মাছ বা মাংস ২ টুকরা
ডাল ১ কাপ মাঝারি ঘন
দুধ (যদি হজমে সমস্যা না হয়) ১ কাপ (সর ছাড়া)
সবজি ইচ্ছামতো (আলু বাদে)
সেহরি
ভাত ২ কাপ (২৪০ গ্রাম)
মাছ বা মাংস ২ টুকরা
ডাল ১ কাপ মাঝারি ঘন
দুধ (যদি হজমে সমস্যা না হয়) ১ কাপ (সর ছাড়া)
সবজি ইচ্ছামতো (আলু বাদে)
রোজায় ডায়াবেটিস রোগীর ওষুধের সমন্বয়
যারা দিনে ১ বার ডায়াবেটিসের ওষুধ (যেসব ওষুধ ইনসুলিনের পরিমাণ বাড়ায়) খান, তারা ইফতারের শুরুতে (রোজা ভাঙার সময়) সেটি খাবেন, তবে ডোজ একটু কমিয়ে নিতে হতে পারে।
যারা দিনে একাধিকবার ডায়াবেটিসের ওষুধ খান তারা সকালের মাত্রাটি ইফতারের শুরুতে এবং রাতের মাত্রাটির অর্ধেক পরিমাণে সেহরির আধা ঘণ্টা আগে খেতে পারেন।
যেসব রোগী ইনসুলিন গ্রহণ করেন, তাদের রমজানের আগেই ইনসুলিনের ধরন ও মাত্রা ঠিক করে নেওয়া জরুরি। সাধারণত রমজানের সময় দীর্ঘ মেয়াদি ইনসুলিন নেওয়াটা ভালো। দীর্ঘ মেয়াদি এবং কম ঝুঁকিপূর্ণ ইনসুলিন যা দিনে এক বার নিতে হয়, এ গুলোতে হাইপোগ্লাইসেমিয়ার আশঙ্কা অনেকটা কম। যারা রোজার আগে সকালের ও রাতের খাবার আগে-২ বার ইনসুলিন (প্রি-মিক্সড) নিতেন, তারা সকালের ডোজটি সমপরিমাণেই ইফতারের আগে নেবেন, আর রাতের ডোজটির অর্ধেক ইফতারের আগে নেবেন।
রোজায় ডায়াবেটিসের ওষুধ ব্যবহারে পরিবর্তন
মুখে খাওয়ার ওষুধ বা ট্যাবলেট
রোজার আগে
* দিনে ১ বার খেতে হয় এমন; যেমন- গ্লিমেপেরাইড, গ্লাইক্লাজাইড। দিনে ২ বার খেতে হয় এমন; যেমন-গ্লিবেনক্লেমইড, গ্লিক্লাজাইড ইত্যাদি।
* মেটফরমিন ৫০০ মি. গ্রাম দিনে ৩ বার গ্রহণ করেন।
* ইনক্রিটিনিন যা দিনে ১ বার সেবন করেন।
* গ্লিটাজন বা গ্লিনাইড যেমন- রিপাগ্লিনাইড, নেটিগ্লিনাইড অথবা গ্লিপটিন।
রোজা চলাকালীন
* ইফতারের শুরুতে (রোজার ভাঙার সময়) ওষুধটি একটু কম করে খেতে পারেন। সকালের মাত্রাটি ইফতারের শুরুতে এবং রাতের মাত্রাটি অর্ধেক পরিমাণে সেহরির ২০-৩০ মিনিট আগে খেতে পারেন।
* ইফতারের পর মেটফরমিন ১০০০ মি. গ্রাম এবং সেহরির পর ভরা পেটে ৫০০ মি. গ্রাম খেতে পারেন
* ওষুধটি একই মাত্রায় রাতের যে কোনো সময়ে খেতে পারেন।
* ইফতারের শুরুতে, সন্ধ্যা রাতের খাবারের আগে অথবা সেহরির আগে সেবন করা যেতে পারে।
ইনসুলিনের সমন্বয়
রোজার আগে
* প্রি-মিক্সড ইনসুলিন : দিনে দু’বার নেওয়ার ইসুলিন। যেমন- সকালে নাস্তার ২০/৩০ মিনিট আগে ৩০ ইউনিট এবং রাতের খাবারের ২০/৩০ মিনিট আগে ২০ ইউনিট।
* ব্যাসাল (Basal) ইনসুলিন অর্থ্যাৎ ইনসুলিন গ্লারজিন, ইনসুলিন ডেটেমিরবা ইনসুলিন ডেগ্লোডেগ, যা দিনে ১বার নিতে হয় [অথবা ইনসুলিন ডেটেমির যা দিনে ১ বা ২ বার নিতে হয়]।
* স্পিন্ট-মিক্সড ইনসুলিন অর্থ্যাৎ প্রয়োজন অনুযায়ী বোলাস ও ব্যাসাল মিলিয়ে নেওয়া ইনসুলিন। যেমন-সকালের খাবারের ২০/৩০ মিনিট আগে বোলাস ১০ ইউনিট+ব্যাসাল ১০ ইউনিট এবং রাতে খাবারের আগে বোলাস ১০ ইউনিট+ব্যাসাল ১০ ইউনিট। অথবা সকালে খাবারের আগে ১০ ইউনিট বোলাস, দুপুরের খাবারের আগে ১০ ইউনিট বোলাস এবং রাতের খাবারের আগে বোলাস ১০ ইফনিট+ব্যাসাল ১০ ইউনিট।
রোজা চলাকালীন
* ইফতারের আগে সকালের ডোজ অর্থাৎ ৩০ ইউনিট এবং সেহরির ২০/৩০ মিনিট আগে রাতের খাবারের ডোজের অর্ধেক অর্থাৎ ১০ ইউনিট নিতে হবে। ইতাফর করে নামাজে যাবেন।
* একই সময় ২০ শতাংশ থেকে ৩০ শতাংশ কমিয়ে প্রথম তারাবির রাত থেকেই নিতে হবে। গ্লারজিন খাবারের আগে ও নেওয়া যায় পরেও নেওয়া যায়। তবে ২৪ ঘণ্টা পরপর নিতে হবে।
* ইফতারের আগে বোলাস ১০ ইউনিট + ব্যাসাল ১০ ইউনিট এবং সেহরির আগে অর্ধেক ডোজ অর্থ্যাৎ বোলাস ৫ ইফনিট+ব্যাসাল ৫ ইউনিট তিনে পারেন। ইফতারের আগে বোলাস ২০ ইউনিট এবং সেহরির আগে অর্ধেক ডোজ অর্থ্যাৎ বোলাস ৫ ইফনিট+ব্যাসাল ৫ ইউনিট নিতে পারেন।
দৈনিক কলম কথা সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।