ডেঙ্গুজ্বর হয় ডেঙ্গু ভাইরাস বহনকারী এডিস মশার কামড়ে। মে থেকে অক্টোবর মাস বিশেষ করে বর্ষাকালেই ডেঙ্গুর প্রাদুর্ভাব, শীতের আগমনের আগ পর্যন্ত চলমান থাকে। কিন্তু ২০২২ সালের শুরু থেকেই বেড়ে চলেছে ডেঙ্গুজ্বরের প্রকোপ, কারণ মাঝেমধ্যে হালকা বৃষ্টিতে জমে থাকা পানি ডেঙ্গুবাহিত এডিস মশার প্রধান প্রজনন ক্ষেত্র। ফলে মশার বংশ বৃদ্ধির সঙ্গে বাড়ছে ডেঙ্গু রোগীর সংখ্যা।

যেহেতু বর্তমান মৌসুমটা ডেঙ্গুজ্বরের আর মশার প্রকোপ ও তার বংশ বৃদ্ধি কমানো যায়নি, তাই ডেঙ্গুজ্বরও বেড়েই চলছে। ডেঙ্গু ভাইরাসের বাহক মশা এডিস ইজিপ্টাই ও এডিস এলবোপিকটাস। এ মশার মাধ্যমেই ডেঙ্গুজ্বর ছড়ায়। ডেঙ্গুজ্বরে আক্রান্ত কোনো ব্যক্তিকে আক্রান্ত হওয়ার চার থেকে ছয় দিনের মধ্যে সাধারণ এডিস মশা কামড়ালে সেই মশাটি ডেঙ্গু ভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে পড়বে।

এবার ভাইরাস বহনকারী এ মশাটি যাকে কামড়াবে, সেই ব্যক্তিটি ডেঙ্গুজ্বরে আক্রান্ত হবে। সাধারণত জীবাণু বহনকারী এডিস মশা কোনো মানুষকে কামড়ানোর চার থেকে ছয় দিনের মধ্যে সে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে থাকে। এভাবে ক্রমাগত মশার মাধ্যমে একজন থেকে অন্যজনে রোগটি ছড়াতে থাকে। এক সময় ডেঙ্গুজ্বরকে শহুরে রোগ মনে করা হতো।

কারণ গ্রামে এ রোগের কোনো প্রকোপ দেখা যায়নি। কিন্তু পরিস্থিতি আর সে পর্যায়ে নেই। সাধারণত শহরে ডেঙ্গু ছড়ায় এডিস ইজিপ্টসাই এবং গ্রামে এডিস এলবোপিকটাস মশার মাধ্যমে। তবে ইজিপ্টসাই গ্রামেও ছড়িয়ে পড়ছে। ফলে শহরে এমনকি গ্রামেও ডেঙ্গুজ্বর ছড়িয়ে পড়ছে।


তাই মশা নিয়ন্ত্রণে শহরের মতো গ্রামকে গুরুত্ব দিতে হবে। এডিস ইজিপ্টাই মশাটিকে বলা হয় গৃহপালিত মশা। সুন্দর সুন্দর ঘরবাড়িতে থাকতে এরা পছন্দ করে। ঘরে কোনো পাত্রে জমা পরিষ্কার পানিতে এরা ডিম পাড়ে এবং তা থেকে শত শত ডেঙ্গুবাহিত মশার বিস্তার লাভ ঘটে। এডিস ইজিপ্টাই শহরাঞ্চলে বেশি থাকে বলেই এর প্রকোপ শহরে বেশি। তবে এডিস এলবোপিকটাসকে বলা হয় টাইগার মশা, এরা সাধারণত গ্রামাঞ্চলে থাকে। এডিস ইজিপ্টসাই বাসাবাড়িতে থাকলেও এলবোপিকটাস থাকে বাঁশের চুঙ্গা, গর্ত, বিভিন্ন ধরনের গাছের বাকলে। এসব জায়গায় জমে থাকা পানিতে এরা ডিম পাড়ে এবং বংশ বিস্তার করে।

এডিস মশা কোথা থেকে কীভাবে এলো?
এডিস মশা প্রথমে ছিল আফ্রিকায়, সেখানে মশা বাস করত গাছের কোটরে, পাতার বোটা ও বাঁশের গোড়ার গর্তে। বৃষ্টি হলেই এসব জায়গায় জমে থাকা পানিতে মশা ডিম পাড়ে। প্রতিটি ডিম থেকে শত শত মশার জন্ম হতো এবং এভাবেই বংশ বৃদ্ধি ঘটত। বর্ষাকাল এবং অতিরিক্ত আর্দ্র পরিবেশ এডিস মশার বংশ বৃদ্ধির জন্য খুবই উপযোগী। বৃষ্টির পানি শুকিয়ে যাওয়ার পরও ডিমগুলো অনেক দিন পর্যন্ত বেঁচে থাকে। আবার বৃষ্টির পানি পেলেই ডিম থেকে এডিস মশার জন্ম হয়। ইউরোপীয় উপনিবেশ স্থাপনকারীরা পৃথিবীর অন্যান্য দেশে ভ্রমণ করলে এ মশাগুলো একসময় আফ্রিকা থেকে জাহাজের মাধ্যমে সমুদ্রপথে আমেরিকা ও এশিয়াসহ সারা বিশ্বে বিভিন্ন অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়ে। বর্তমান বিশ্বে বিভিন্ন রকমের যানবাহনের মাধ্যমে এক অঞ্চল বা এক দেশ থেকে মশা বিভিন্ন দেশে ছড়িয়ে পড়ছে। এ এডিস মশা বহুদিন ধরেই ‘পীত জ্বরের’ বাহক হিসেবে পরিচিত। মশাগুলো প্রাকৃতিক ও কৃত্রিম পাত্রে যেমন- ড্রাম, পড়ে থাকা টায়ার, চিপসের প্যাকেট, প্লাস্টিকের বোতল, মাটির পাত্র বা ভাঙা বোতল, ডাবের খোসা বা যে কোনো পরিত্যক্ত পাত্রে স্থির জমা পানিতে ডিম পাড়ে এবং শত শত ডেঙ্গুবাহিত মশা জন্মলাভ করে। এ মশাগুলো আবার সুন্দর সুন্দর বসতবাড়িতে প্রবেশ করে এবং ঘরে জমে থাকা পানিতে ডিম পাড়ে যেমন ফুলদানি, ফুলের টব, এয়ারকুলার, ফ্রিজ, অব্যবহৃত কমোড, ছাদে এবং নির্মাণাধীন ভবনে জমে থাকা পানি মশার বংশ বৃদ্ধির সহায়ক। জলবায়ু পরিবর্তন, ভাইরাসের বিবর্তন, অপরিকল্পিত ও অত্যধিক নগরায়ণ, অপর্যাপ্ত ও অস্বাস্থ্যকর বর্জ্য ও পানি ব্যবস্থাপনার কারণে মশার বিস্তার ঘটছে এবং ডেঙ্গুজ্বর বেড়েই চলেছে।

ডেঙ্গু বা ডেঙ্গি নামটি কোথা থেকে এলো?
ডেঙ্গু নামটি কোথা থেকে এসেছে তা পরিষ্কার নয়। ৪২০ খ্রিস্টাব্দে চীনাদের বর্ণনায় জানা যায়, এ ভাইরাস ‘উড়ন্ত কীট’-এর মাধ্যমে পরিবাহিত হয়। কিন্তু ধারণা করা হয়- আফ্রিকার সোয়াহিলি ভাষার প্রবাদ ‘কান্ডডিঙ্গা পেপো’ থেকে ‘ডেঙ্গু’ নামটি এসেছে। ওই শব্দের অর্থ- শয়তানের শক্তির কাছে আটকে যাওয়ার মতো ব্যথা। অনেকেই এর অর্থ করেন- দুষ্ট আত্মা দ্বারা বন্দী বানানো। কারও কারও ধারণা স্প্যানিশ ডেঙ্গু শব্দ থেকে এ রোগের নামকরণ করা হয়, যার অর্থ ‘হাড়ভাঙা জ্বর’। তাদের বিশ্বাস ছিল- ‘খারাপ আত্মার সংস্পর্শে হাড়গোড় ভাঙার ব্যথাঅলা’ এ জ্বর হয়। আবার কোনো কোনো স্প্যানিশ এটিকে বলে ‘ডিঙ্গা’, যার অর্থ ‘যত্নশীল বা সতর্ক থাকা’। নেদারল্যান্ডসে ডেঙ্গু নিয়ে এক গবেষকের মতে, সোয়াহিলি ভাষার ডিঙ্গা শব্দটি স্প্যানিশ শব্দ ডেঙ্গু থেকে আসতে পারে, যার মানে হলো ‘সতর্ক থাকা’। একজন ব্যক্তির হাড়ে ব্যথা থেকে সতর্ক থাকা ব্যাখ্যা করতে বুঝানো হয়, যা ডেঙ্গুজ্বরের সময় হয়ে থাকে। অনেকের ধারণা ওয়েস্ট ইন্ডিজের গোলাম বা দাসরা এ জ্বরে আক্রান্ত হয়ে অনেকটা ত্যাড়াব্যাঁকা হয়ে হাঁটতো, তখন তাদের হাঁটার ভঙ্গিমা ডান্ডি নৌকার মতো বলে ডাকা হতো ‘ডান্ডি ফিভার’, সেখান থেকে ডেঙ্গু নামটি এসেছে।

এ জ্বরকে শনাক্ত করা হয় ১৭৭৯ সালে। ১৭৭৯ সালের পরের বছর প্রায় একই সময়ে এশিয়া, আফ্রিকা, উত্তর আমেরিকায় ব্যাপকভাবে দেখা যায়। শরীরে ব্যথার কারণে তখন একে হাড়ভাঙা জ্বর বলেও ডাকা হতো। ১৮২৮ সালের পর ডেঙ্গুজ্বর শব্দটির ব্যবহার শুরু হয়।

কবে ডেঙ্গু ভাইরাস শনাক্ত করা হয়?
ডেঙ্গু ভাইরাস প্রথম শনাক্ত করা হয় দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় এশিয়া এবং প্রশান্ত মহাসাগরীয় উপকূল অঞ্চলে। ১৯৪৪ সালে ডক্টর আলবার্ট সাবিন ইউএস আর্মি কমিশনে ডেঙ্গু এবং সান্ডফ্লাইর ওপর কাজ করতে গিয়ে প্রথম ডেঙ্গু ভাইরাস শনাক্ত করেন। তিনি ডেঙ্গু-১ ও ডেঙ্গু-২ নামে দুটো সেরো টাইপ ভাইরাসকে শনাক্ত করেন। এরপর ১৯৫৬ সালে ডাক্তার হ্যাম ও তার সহকর্মী আরও দুটো নতুন ডেঙ্গু সেরো টাইপ ভাইরাসকে শনাক্ত করেন। যাদের নাম দেওয়া হয় ডেঙ্গু-৩ ও ডেঙ্গু-৪।

কবে প্রথম ডেঙ্গুজ্বর রোগটি শনাক্ত হয়?
ডেঙ্গু একটি প্রাচীন রোগ। এ রোগের প্রথম উল্লেখ পাওয়া গেছে চীনের চিকিৎসাসংক্রান্ত নথিপত্রে। সেখান থেকে জানা যায় ৯৯২ সালে চীনে যা পানিবিষ নামে বর্ণিত, এমন প্রথম মহামারির ঘটনার বিবরণ পাওয়া যায়, ডেঙ্গুজ্বরের উপসর্গের সঙ্গে তার মিল আছে। কোনো কোনো গবেষক অবশ্য দাবি করেন, চীনে জিন রাজতন্ত্রের সময়কার (২৬৫-৪২০ খ্রিস্টপূর্ব) নথিপত্রে এ রোগের উল্লেখ পাওয়া যায়। সেখানে অবশ্য একে উড়ন্ত পোকামাকড়ের কারণে বিষাক্ত পানির রোগ বলে বর্ণনা করা হয়েছে। তবে এ দাবি নিয়ে বিতর্ক রয়েছে। ১৬৩৫ সালে ফরাসি ওয়েস্ট ইন্ডিজ ও ১৬৬৯ সালে পানামাতে যে জ্বরের মহামারির বিবরণ পাওয়া যায় তা-ও ডেঙ্গুজ্বর বলেই ধারণা করা হয়। ডেঙ্গু মহামারির সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য প্রথম বিবরণ পাওয়া যায় ১৭৭৯ ও ১৭৮০ সালে, যখন মহামারির কবলে পড়েছিল এশিয়া, আফ্রিকা ও উত্তর আমেরিকা। ১৭৭৯ সালে ডেঙ্গুজ্বর মহামারির আকারে হয়েছিল বলে বিবরণ পাওয়া যায় কায়রো এবং বাটাভিয়ায়। ১৭৮০ সালে যুক্তরাষ্ট্রের ফিলাডেলফিয়ায় এ জ্বরের প্রাদুর্ভাব ছিল বলে জানা যায়। ডেঙ্গু হিমোরেজিক ফিভার মহামারি আকারে দেখা দেয় ১৯২২ সালে টেক্সাস ও লুশিয়ানায়। ডেঙ্গুর কারণে মারা যাওয়ার ঘটনা ঘটে ১৯২৮ সালে গ্রিসে এবং ১৯৯৭ সালে অস্ট্রেলিয়াতে। ১৯৮০ থেকে ১৯৮৭ সাল পর্যন্ত আমেরিকার অনেক অঞ্চলের দেশগুলোতে কয়েক লাখ লোক ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়েছিল বলে জানা যায়। কিউবাতে ১৯৮১ সালে ডেঙ্গু হিমোরেজিক ফিভার মহামারি আকারে দেখা দেয় এবং ১৯৮৯ সালে দেখা দেয় ভেনিজুয়েলাতে। দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় ব্যাপক আকারে ডেঙ্গুজ্বরের আক্রান্ত হয়েছে অনেক লোক। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়ও ডেঙ্গু বিভিন্ন দেশে মহামারি আকারে ছড়িয়ে পড়ে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বলছে, মহামারি আকারে প্রথম ডেঙ্গু শনাক্ত হয় ১৯৫০ সালের দিকে ফিলিপিন্স এবং থাইল্যান্ডে। আফ্রিকাতে প্রথম দেখা যায় ১৯৫২ সালে। পরবর্তীতে এশিয়ার বিভিন্ন দেশ যেমন- ভারত, শ্রীলঙ্কা, থাইল্যান্ড, মিয়ানমার এবং ইন্দোনেশিয়াতে এটি বিস্তার লাভ করে। ১৯৭০ সালে এটি শিশু মৃত্যুর এক প্রধান কারণ হয়ে ওঠে এবং আমেরিকা ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে এর প্রাদুর্ভাব দেখা দেয়। ১৯৮১ সালে মধ্য ও দক্ষিণ আমেরিকায় ডেঙ্গু হিমোরেজিক ফিভার ও ডেঙ্গু শক সিনড্রোম প্রথম পরিলক্ষিত হয়। মশা নিয়ে একটি গবেষণাগ্রন্থ থেকে জানা যায়, ১৯৭৯-৮০ সালে এশিয়া, আফ্রিকা ও উত্তর আমেরিকায় ডেঙ্গু মহামারিতে পতিত হয় তখন থেকেই বিষয়টি আলোচনায় আসে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার এক পরিসংখ্যান থেকে জানা যায় ১৯৯৮ সালের পর থেকে বিশ্বে প্রতিবছরই ৫১ মিলিয়ন লোক ডেঙ্গুজ্বরে আক্রান্ত হচ্ছে। ১৯৭০ সালের আগে মাত্র নয়টি দেশে ডেঙ্গুজ্বরের প্রাদুর্ভাব দেখা গিয়েছিল। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তথ্য অনুযায়ী, বর্তমানে বিশ্বের এশিয়া, আফ্রিকা, অস্ট্রেলিয়া ও উত্তর আমেরিকার ১০০টি দেশের প্রায় ২৫০ কোটি মানুষ ডেঙ্গুঝুঁকির মুখে পড়ে। এর মধ্যে মৃত্যু হচ্ছে সাড়ে ১২ হাজার মানুষের। পুরো দক্ষিণপূর্ব এশিয়া ও দক্ষিণ এশিয়ার অংশবিশেষে এ বছর ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়ছে ডেঙ্গুজ্বর। ইতিহাস থেকে জানা যায়, কোনো দেশে একবার ডেঙ্গুজ্বর দেখা দিলে সে দেশে দুই-তিন বছর অন্তর এটি দেখা দিতে থাকে।

বাংলাদেশে ডেঙ্গুজ্বর
বাংলাদেশে ডেঙ্গুজ্বরের প্রাদুর্ভাব অনেক আগে থেকে। প্রায় প্রতি বর্ষাতেই কমবেশি ডেঙ্গুজ্বর হয়ে থাকে। ১৯৬৪ সালে বাংলাদেশে সর্বপ্রথম ডেঙ্গুজ্বর পরিলক্ষিত হয়। তখন বাংলাদেশে ডেঙ্গু রোগীর রক্ত পরীক্ষা করার পর্যাপ্ত সুযোগ-সুবিধা না থাকায় জ্বরের প্রকৃত কারণ জানা সম্ভব হয়নি বলে একে বলা হয় ‘ঢাকা ফিভার’। কিন্তু গত শতাব্দীর শেষভাগে হঠাৎ ডেঙ্গুর প্রকোপ বেড়ে গেলে তা সবার নজরে আসে। এরপর ১৯৯৮ সালে কিছু কিছু রোগীর দেহে ডেঙ্গু ভাইরাস ধরা পড়ে। ১৯৯৯ সালের অক্টোবর থেকে ডিসেম্বর মাসে রাজধানীর অনেক রোগীর দেহে ডেঙ্গুর জীবাণু পাওয়া যায়, তবে ব্যাপক আকারে ডেঙ্গুর প্রকোপ দেখা দেয় ২০০০ সালে। এ দেশের চিকিৎসকদের কাছে অপরিচিত এ রোগের চিকিৎসা দিতে সে বছর হিমশিম অবস্থা হয়েছিল।

২০০০ সালে ৫ হাজার ৫০০ মানুষ আক্রান্ত হয় ডেঙ্গুতে এবং মারা যায় প্রায় ৯৩ জন। এরপর থেকে প্রতি বছরই ডেঙ্গুর প্রকোপ লক্ষ করা যাচ্ছে। পরের বছরগুলোতে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হলেও সংখ্যা অনেক কমে আসে। প্রকাশিত রিপোর্ট অনুসারে ২০০১ সালে আক্রান্তের সংখ্যা ছিল ২ হাজার ৪৩০, মারা যায় ৪৪ জন। ২০০২ সালে ৬ হাজার ২৩২, মৃত্যু হয় ৫৮ জনের। এরপর ২০০৭ সাল থেকে ২০১৪ পর্যন্ত ডেঙ্গুর প্রকোপ ছিল তুলনামূলকভাবে কম। ওই আট বছরে কখনোই ডেঙ্গু রোগীর সংখ্যা ২ হাজার ছাড়ায়নি। ২০১৫ সালে আক্রান্ত হয় ৩ হাজার ১৬২, মারা যায় ৬ জন, ২০১৬ সালে আক্রান্ত হয় ৬০৬, মারা যায় ১৪ জন, ২০১৭ সালে আক্রান্ত হয় ২ হাজার ৭৬৯ মারা যায় আটজন এবং ২০১৮ সালে আক্রান্ত হয় ১০ হাজার ১৪৮ জন, মারা যায় ২৬ জন। বাংলাদেশে ডেঙ্গুর ভয়াবহতা সবচেয়ে প্রকট আকার ধারণ করে ২০১৯ সালে। সেই বছর ১ লাখ ১ হাজার ৩৫৪ জন মানুষ ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয় এবং মারা যায় ১৭৯ জন। ২০২০ সালে করোনা মহামারির মধ্যেও প্রায় ১ হাজার ১৯৩ জন ডেঙ্গু আক্রান্ত হয় এবং মারা যায় তিনজন, ২০২১ সালে আক্রান্ত হয় প্রায় ২৮ হাজার ৪২৯ জন এবং মারা যায় ১০৫ জন। ২০২২ সালে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত আক্রান্ত ১৬ হাজার ৯২ এবং মারা যায় ৫৫ জন। বাংলাদেশে ডেঙ্গুজ্বরের সংক্রমণের ঝুঁকি দেশব্যাপী এবং বছরব্যাপী বিদ্যমান। বর্ষাকালে এবং বর্ষা-পরবর্তী সময়ে, এডিস মশার উপদ্রব বেশি থাকে। এ সময়ে ডেঙ্গুর ঝুঁকি সবচেয়ে বেশি। এ ছাড়া জলবায়ু পরিবর্তন, বৃষ্টিপাত এবং তাপমাত্রা বৃদ্ধি, দ্রুত অপরিকল্পিত নগরায়ণের ফলে পরিবেশের ভারসাম্যহীনতা তৈরি হচ্ছে, যার ফলস্বরূপ সাম্প্রতিক বছরগুলোতে ডেঙ্গু মহামারির ক্রমাগত উত্থান ঘটেছে।

ডেঙ্গু প্রতিরোধ ও নিয়ন্ত্রণঃ
ডেঙ্গুজ্বর প্রতিরোধে দুটি মূল বিষয়ের ওপর জোর দেওয়া উচিত। ১) এডিস মশার প্রজনন ক্ষেত্র ধ্বংস করা এবং মশাকে মেরে ফেলা, ২) মশার কামড় থেকে নিজেকে বাঁচানো। ডেঙ্গু প্রতিরোধে কার্যকর ব্যবস্থা গড়ে তোলা সময়ের দাবি। বাংলাদেশে ডেঙ্গু প্রতিরোধ ও নিয়ন্ত্রণ কোনো একক ব্যক্তি, সংগঠন বা মন্ত্রণালয়ের পক্ষে সম্ভব নয়। সবার সময়োপযোগী, কার্যকর পদক্ষেপ, সমন্বিত সচেতনতা, মশা নিধনে বিদ্যমান প্রকল্পগুলোকে আরও কার্যকর ও শক্তিশালী করার মাধ্যমে ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে রাখতে হবে। সরকার এবং জনগণের সমন্বিত উদ্যোগই পারে এ মহামারি থেকে আমাদের সুরক্ষিত রাখতে। পরিবেশের পরিচ্ছন্নতা, মশার জৈবিক নিয়ন্ত্রণ, মশক নিধন কীটনাশক প্রয়োগ এবং গণসচেতনতা সৃষ্টির মাধ্যমে পরিপূর্ণভাবে ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব। ডেঙ্গু মহামারি থেকে সুরক্ষিত থাকতে সবাইকে নিজ নিজ অবস্থান থেকে কাজ করতে হবে। নিজে সচেতন না থেকে শুধু সরকারের সমালোচনা ডেঙ্গু থেকে মুক্তি দিতে পারবে না। তাই সর্বাগ্রে প্রয়োজন সচেতনতা। এ বিষয়ে সামাজিকভাবে আমাদের সবাইকে এগিয়ে আসতে হবে।

সরকার-জনগণ উভয় পক্ষের দায়িত্বশীল আচরণ এবং পরিকল্পিত উদ্যোগই পারে ডেঙ্গুর প্রকোপ কমিয়ে এ সংকট থেকে আমাদের সুরক্ষিত রাখতে। তাই ডেঙ্গু নিয়ে আমাদের আরো সচেতন হতে হবে। মনে রাখতে হবে এসবক্ষেত্রে প্রতিকার নয় প্রতিরোধ সর্বদা উত্তম।

লেখকঃ ইমেরিটাস অধ্যাপক ও প্রধানমন্ত্রীর ব্যক্তিগত চিকিৎসক।