ইসমাইল ইমন চট্টগ্রাম জেলা প্রতিনিধিঃ
চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ডে ৪ জুন,২০২২ ইং (শনিবার) রাতে বিএম কনটেইনার ডিপোতে স্মরণকালের ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটে। এরপর হয় দফায় দফায় বিস্ফোরণ। ২৪ ঘন্টা পরও আগুন নিয়ন্ত্রণে আনতে পারেনি ফায়ার সার্ভিস। পরে সেনাবাহিনীরও সহযোগিতা নেওয়া হয়। এতকিছুর পরও আগুনের লেলিহান শিখাকে দমানো যাচ্ছিল না। একপর্যায়ে চট্টগ্রাম ফায়ার সার্ভিসের উপ-পরিচালক আনিসুর রহমান জানিয়েছেন, ডিপোটির কনটেইনারে হাইড্রোজেন পার-অক্সাইড নামের রাসায়নিক পদার্থ ছিল। যার কারণেই এমন ভয়াবহ বিস্ফোরণ ঘটেছে। এই রাসায়নিক পদার্থের কারণে আগুন নিভাতে আমাদের যথেষ্ট বেগ পেতে হচ্ছে। তাই এই রাসায়নিক পদার্থটিকে নিয়ে অনেকের মনেই কৌতূহল তৈরি হয়েছে। তারা জানতে চান, কেন হাইড্রোজেন পার-অক্সাইড বিস্ফোরিত হলো? এই রাসায়নিকের আগুন কেন পানি দিয়ে নেভানো যায় না? আসুন জেনে নিই, হাইড্রোজেন পার অক্সাইডের আদ্যোপান্ত।
- সীতাকুণ্ডে বিস্ফোরণে নিহত বাঘারপাড়ার ইব্রাহীমের মরদেহ দাফন সম্পন্ন
- সীতাকুণ্ডের অগ্নিকাণ্ড: নিহতদের পরিচয় শনাক্তে ডিএনএ নমুনা সংগ্রহ শুরু
হাইড্রোজেন পার-অক্সাইড একটি রাসায়নিক যৌগ। বিশুদ্ধ অবস্থায় এটি বর্ণহীন তরল। এটি নিজে আগুনের জ্বালানী হিসেবে ব্যবহার না হলেও আগুনের তীব্রতাকে বাড়িয়ে দেয়। তাপের সংস্পর্শ পেলে এটি তাপীয় বিয়োজনে বিস্ফোরণ ঘটায়।
আমাদের নানা কাজেই এর ব্যবহার রয়েছে। খুবই হালকা ঘনত্বের হাইড্রোজেন পার-অক্সাইড আমাদের বাথরুম পরিষ্কার করা থেকে শুরু করে কাপড় থেকে দাগ দূর করা, আমাদের দাঁত সাদা করাসহ সবকিছুর জন্য ব্যবহার করা হয়। নানা কাজে এই রাসায়নিক ব্যবহার হয়ে থাকলেও সঠিকভাবে ব্যবহার না করলে এটি বিপজ্জনক হতে পারে। বিশেষ করে এর উচ্চ ঘনত্ব বিপজ্জনক। হাইড্রোজেন পার-অক্সাইড উচ্চ ঘনত্বে একটি আক্রমণাত্মক অক্সিডাইজার এবং এটি মানুষের ত্বক সহ অনেক উপাদানকে ক্ষয় করে। তাই নিরাপত্তাজনিত কারণে সব সময় এটার জলীয় দ্রবণ ব্যবহার করা হয়।
এক্ষেত্রে আমাদের জেনে রাখতে হবে, যেকোনো ধরনের আগুনের ৩টি উপাদান প্রয়োজন। যথা- তাপ, জ্বালানি ও অক্সিজেন। আগুন লাগার জন্য এবং জ্বলতে থাকা আগুন চালিয়ে যাওয়ার জন্য সঠিক পরিমাণে এই তিনটি জিনিসেরই প্রয়োজন। এই উপাদানগুলোর যেকোনো একটি সরানো হলে আগুন নিভে যাবে। মূলত এভাবেই আগুন নিয়ন্ত্রণ করা হয় এবং নিভানো হয়।
হাইড্রোজেন পার-অক্সাইড নিজে আগুন সৃষ্টি না করলেও এটি একটি অক্সিডাইজার হিসেবে কাজ করে। অক্সিডাইজার হলো একটি রাসায়নিক যা অক্সিজেন বা অন্যান্য উপাদান (ফ্লোরিন বা ক্লোরিন) যোগ করে। অর্থাৎ, অক্সিজেন ছাড়াই আগুন জ্বলতে পারে যদি একটি অক্সিডাইজার উপস্থিত থাকে। অক্সিডাইজারগুলো আগুনকে ব্যাপকভাবে তীব্র করতে পারে এবং এমনকি বিস্ফোরণ ঘটাতে পারে। এ কারণে হাইড্রোজেন পার-অক্সাইডের অক্সিজেন আগুনের তীব্রতা বাড়াতে পারে এবং পর্যাপ্ত জ্বালানি এবং তাপ থাকলে লগ্নকা সম্ভাবনা বেড়ে যায়।
হাইড্রোজেন পার-অক্সাইড একটি শীতল, শুষ্ক, বায়ুচলাচল এলাকায় এবং কোনো দাহ্য পদার্থ থেকে দূরে সংরক্ষণ করা উচিত। সীতাকুণ্ডের বিএম ডিপোতে সেটা করা হয়নি। রাসায়নিক পদার্থ সংরক্ষণের জন্য ডিপো বা গোডাউনে পৃথক একটি জোন করতে হয়। ওখানের মধ্যে আবার দাহ্য কেমিক্যেল গুলোকে অদাহ্য থেকে পৃথক করে রাখতে হয়। কারণ, দাহ্য পদার্থ অতি ঝুঁকিপূর্ণ। যদি নিয়মানুযায়ী এসব রাসায়নিক পদার্থ সংরক্ষণ করা হতো, তাহলে এত বড় দূর্ঘটনা ঘটত না। এসব তদারকির দায়িত্ব পরিবেশ অধিদপ্তরের। কিন্তু দূর্ঘটনার পর তাঁরা জানান, বিএম ডিপোতে যে রাসায়নিক পদার্থ সংরক্ষণ করা হয়, তাও নাকি তাদের জানা নেই। কতটাই দায়িত্বহীন আচরণ!
হাইড্রোজেন পার অক্সাইড স্টেইনলেস স্টীল বা কাঁচের মতো অ-প্রতিক্রিয়াশীল পদার্থের সমন্বয়ে গঠিত একটি পাত্রে সংরক্ষণ করা উচিত (কিছু প্লাস্টিক এবং অ্যালুমিনিয়ামসহ অন্যান্য উপকরণও উপযুক্ত হতে পারে)। কারণ, এটি আলোর সংস্পর্শে এলে দ্রুত ভেঙে যায়। এটি অস্বচ্ছ পাত্রে সংরক্ষণ করা উচিত এবং ফার্মাসিউটিক্যাল ফর্মুলেশনগুলি সাধারণত বাদামী বোতলে আসে যা আলোকে বাঁধা দেয়।
হাইড্রোজেন পার-অক্সাইডের কারণে জ্বলন্ত আগুন পানি দিয়ে নেভানো যায় না। বরং এতে আগুনের মাত্রা আরও বাড়ার সম্ভাবনা থাকে। রাসায়নিকের কারণে জ্বলন্ত আগুন নেভাতে হয় ফগ সিস্টেমে; পানি দিয়ে নয়। এতে ব্যবহার করা হয় ফোম কিংবা ড্রাই পাউডার জাতীয় অগ্নি নির্বাপণ উপাদান। পানির সাহায্যে এই আগুন নেভানো সম্ভব নয়। সীতাকুণ্ডের ডিপোতে হাইড্রোজেন পার-অক্সাইডের অবস্থান জানা না থাকায় প্রথমে পানি ব্যবহার করা হয়েছে। তাই আগুন নিয়ন্ত্রণে না এসে বরং তীব্রতা আরো বেড়েছে।
লেখক: সাংবাদিক ও মানবাধিকার কর্মী।
দৈনিক কলম কথা সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।