রাব্বি আহমেদ,বরগুনা প্রতিনিধিঃ বরগুনায় স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তরের (এলজিইডি) কর্মকর্তা ও কর্মচারীর ‘ঘুষ’ নেয়ার একাধিক ভিডিও ফেসবুকে ছড়িয়ে পড়ার পর সেখানকার এক কর্মকর্তাকে চাকরিচ্যুত করা হয়েছে। বরখাস্ত করা হয়েছে দুজনকে। বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন বরগুনার এলজিইডির সিনিয়র সহকারী প্রৌকশলী হোসেন আলী মীর।

তিনি জানান, ঘুষের ঘটনায় বরগুনা এলজিইডির নির্বাহী প্রকৌশলীর কার্যালয়ের ফোরম্যান জিয়াউর রহমানকে চাকরিচ্যুত করা হয়েছে। বরখাস্ত করা হয়েছে এলজিইডির সদর উপজেলা প্রকৌশলীর কার্যালয়ের উপসহকারী প্রকৌশলী মিজানুর রহমান এবং এলজিইডির আমতলী উপজেলা প্রকৌশলীর কার্যালয়ের হিসাবরক্ষক হুমায়ুন কবিরকে। হোসেন আলী মীর বলেন, বরখাস্ত দুই কর্মকর্তার বিরুদ্ধে বিভাগীয় মামলা করা হয়েছে। এ মামলার রায় অনুযায়ী বরখাস্ত হওয়া কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হবে।

ভাইরাল ভিডিওগুলোর একটিতে দেখা গেছে এলজিইডি বরগুনার নির্বাহী প্রকৌশলীর কার্যালয়ের ফোরম্যান জিয়াউর রহমান একজনকে বলছেন ‘আগে ভাই মাল (টাকা) দিয়ে কথা বলেন।’ ওই ব্যক্তি এরপর গুনে গুনে জিয়াউর রহমানকে টাকা দেন। সে সময় পুকুর ও খাল খনন (আইপিসিপি) প্রকল্পের অধীনে ওই দপ্তরের কর্মকর্তাকে কত শতাংশ ঘুষ দিতে হয়, তা সংশ্লিষ্ট ঠিকাদারদের বুঝিয়ে বলতে শোনা যায় জিয়াউরকে।

তিনি বলেন, প্রকল্প পরিচালকের জন্য ২২ হাজার টাকা, নির্বাহী প্রকৌশলীর জন্য ৫০ হাজার টাকা এবং এসও নজরুল ইসলামের জন্য তিনি ১৩ হাজার টাকা কেটে রেখেছেন। এ ছাড়া, জ্যেষ্ঠ সহকারী প্রকৌশলী হোসেন আলী মীর এবং হিসাবরক্ষণ কর্মকর্তা মো. মহিউদ্দিনের জন্য নির্ধারিত টাকা তাদের হাতে দিয়ে আসতে ওই ব্যক্তিকে বলেন তিনি। এরপর ভাইরাল হয় আরেকটি ভিডিও।

তাতে দেখা যায় সদর উপজেলা প্রকৌশলী কার্যালয়ের উপসহকারী প্রকৌশলী মিজানুর রহমান একটি প্রকল্প এলাকা পরিদর্শনে গিয়ে ঠিকাদারদের কাছ থেকে টাকা নিচ্ছেন। বরগুনার আমতলী উপজেলা প্রকৌশলীর কার্যালয়ের ভাইরাল হওয়া আরেকটি ভিডিওতে দেখা যায়, হিসাবরক্ষক হুমায়ুন কবির অফিসকক্ষে ধূমপানরত অবস্থায় সংশ্লিষ্ট ঠিকাদারদের উদ্দেশে বলছেন, ‘টাকা দিতে হবে, টাকা না দিলে কোনো বিল দেয়া যাবে না। এ টাকা আমি একা খাই না।

আপনারা টাকা কম দিলে আমি কি আমার পকেটের টাকা দিয়ে স্যারদের দেব।’ ভিডিওগুলোর বিষয়ে জানতে চাইলে এলজিইডির বরগুনা কার্যালয়ের জিয়াউর রহমান বলেন, ‘আমি অসুস্থ। আমি ফরিদপুরে ডাক্তার দেখাতে এসেছি। আমি শিগগিরই অফিসে আসব।

যোগাযোগ করা হয় বরগুনা সদর উপজেলা প্রকৌশলীর কার্যালয়ের কর্মকর্তা মিজানুর রহমানের সঙ্গেও। তিনি বলেন, ‘আপনি কোন ভিডিওর কথা বলছেন, তা আমি অবগত নই। ভিডিওতে যে টাকা দেখানো হয়েছে, ওই টাকা আমার ঈদের বেতন এবং বোনাসের টাকা। ষড়যন্ত্র করে আমাকে ফাঁসানো হয়েছে।’ বরগুনা এলজিইডির কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে ঘুষ নেয়ার অভিযোগ নতুন নয়। সেখানে কাজ করা ঠিকাদারদের অভিযোগ, ঘুষ ছাড়া কোনো কাজই হয় না। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক ঠিকাদার বলেন, ‘আমরা ঠিকাদারেরা বাংলাদেশ সরকারের প্রত্যক্ষ উন্নয়নকর্মী। সরকারের সব উন্নয়নকাজ বাস্তবায়ন করে থাকি। দিনরাত অক্লান্ত পরিশ্রম করে, পকেটের টাকা খরচ করে সরকারের উন্নয়নকাজ বাস্তবায়ন করি।

অথচ সেই কাজ বাস্তবায়নের পর বিল তুলতে গিয়ে ঘাটে ঘাটে আমাদের কড়ায়-গণ্ডায় ঘুষের পার্সেন্টেজ গুনতে হয়।’ আরেক ঠিকাদার বলেন, ‘কাজ পেতে হলে ঘুষ দিতে হয়, ওয়ার্ক অর্ডার পেতে ঘুষ দিতে হয়, কাজ বাস্তবায়নের সময় তদারকি কর্মকর্তাকে ঘুষ দিতে হয়, এরপর বিল পাওয়ার আগে হিসাবরক্ষকসহ অফিস সহকারী, উপসহকারী প্রকৌশলী, সহকারী প্রকৌশলী, সিনিয়র সহকারী প্রকৌশলী, এমনকি প্রকল্প পরিচালকসহ ঘাটে ঘাটে লাখ লাখ টাকা ঘুষ দিতে হয়। ঠিকাদারি পেশা থেকে এখন সরে যাওয়া ছাড়া আর কোনো উপায় দেখছি না।’ জেলা নাগরিক অধিকার সংরক্ষণ কমিটির সাধারণ সম্পাদক মনির হোসেন কামাল বলেন, ‘ঘুষ-দুর্নীতির এমন চিত্র কোনোভাবেই কাম্য নয়।

সরকারি কর্মকর্তাদের ঘুষ-দুর্নীতির কারণেই আমাদের দেশের উন্নয়নের অগ্রযাত্রা ব্যাহত হচ্ছে। দুর্নীতি দমন কমিশনের উচিত এই কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করা।’ সচেতন নাগরিক কমিটি বরগুনা জেলা শাখার সভাপতি আইনজীবী আনিসুর রহমান বলেন, ‘স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তর সরকারের একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠান। সারা দেশের স্থানীয় উন্নয়নে এ প্রতিষ্ঠানটির ভূমিকা অগ্রণী। ‘এখানকার অসাধু কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের দৌরাত্ম্যে শুধু সরকারের উন্নয়ন কর্মকাণ্ড ব্যাহত হচ্ছে তা নয়, সরকারের ভাবমূর্তিও নষ্ট হচ্ছে।’