সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বিজ্ঞাপন দিয়ে গোপন রোগের চিকিৎসা, প্রেমিক প্রেমিকা বশীকরণের প্রলোভন দেখিয়ে কবিরাজ পরিচয়ে প্রতারণা করে প্রায় অর্ধশতাধিক লোকের নিকট হতে বিপুল পরিমাণ স্বর্ণালংকার ও টাকা আত্মসাৎ করার অপরাধে ১ জন ভন্ড কবিরাজকে গ্রেফতার করেছে র্যাব-৩।
১। বেশ কয়েকজন ভূক্তভোগী ভিকটিমের অভিযোগের ভিত্তিতে র্যাব-৩ এর একটি চৌকস আভিযানিক দল গোপন সংবাদের ভিত্তিতে ০২ নভেম্বর ২০২২ তারিখ সকালে মুন্সীগঞ্জ জেলার লৌহজং এলাকা থেকে ভন্ড কবিরাজ ওয়াস কুরুনী (২৪), পিতা-মৃত শাহিদুল ইসলাম, সাং-নতুন বাড়ি, ভিকতলা, দক্ষিন ইলিয়টগঞ্জ, কুমিল্লাকে ০১ পাগড়ী, ০২ টি গলার হার, ০৫ টি গলার চেইন, ০২ জোড়া কানের দুল, ০১ টি মাথার টিকলি, ০১ টি মাথার চুল, ০৫ টি সাপ, ০৪ টি বিভিন্ন মন্ত্র লেখা কাগজ, ০১ টি তাবিজের খোসা, ০২ টি বনাজি কাঠের লাঠি, ০২ টি হরিনের চামড়া, বিভিন্ন ধরনের বনাজি গাছ গাছালি, ০৪ টি সিংগা, ০২ টি বড় কড়ি, ০৫ টি ছোট কড়ি, ০৩ টি হাড়ের টুকরা, ০১ টি মরিয়ম ফুল এবং ০১ টি মোবাইলসহ গ্রেফতার করতে সক্ষম হয়।
২। জিজ্ঞাসাবাদে গ্রেফতারকৃত ওয়াস কুরুনী জানায় যে, তার কবিরাজ আলী আশরাফ, তান্ত্রিক কবিরাজ এবং হুমায়ুন আহমেদ নামে তিনটি বেনামী ফেসবুক একাউন্ট রয়েছে। উক্ত একাউন্টগুলোতে সে মানুষের দৈনন্দিন জীবন যাপনের চিরাচরিত সমস্যা যেমন, উঠতি বয়সের ছেলে মেয়েদের গোপন রোগের চিকিৎসা, দাম্পত্য জীবনের সমস্যা, বিয়ে না হওয়া, প্রেমে ব্যর্থতা, চাকুরী না পাওয়া, জমি-জমার ঝামেলা, কাউকে বশ করার প্রবণতা, বাণ মারার শক্তিশালী মন্ত্র, মামলায় জয়ী হওয়ার মন্ত্র, বিবাহের প্রস্তাব আসার তাবিজ, প্রেম সফল করার তাবিজ, বিয়ে বন্ধ করার তাবিজ, মানুষকে পাগল করার তাবিজ ইত্যাদি শিরোনামে বিভিন্ন পোষ্ট করে থাকে। তার ২০/২২ জন নির্বাচিত এজেন্ট রয়েছে। যাদের কাজ হল এসকল পোস্ট বারংবার শেয়ারের মাধ্যমে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে দেয়া এবং আগ্রহীদের প্রতারণার শিকার বানিয়ে তাদের কাছ থেকে ছলে-বলে-কৌশলে মোটা অংকের টাকা এবং হাদিয়া হিসেবে স্বর্ণলংকার হাতিয়ে নেয়া।
সে এবং তার চক্রটি মিলে ধৃত ওয়াস কুরুনী এর বিকাশ নম্বরে অর্থের লেনদেন করে থাকে এবং কুরিয়ার সার্ভিসের মাধ্যমে দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে ভিকটিমদের নিকট হতে স্বর্ণালংকার হাতিয়ে নেয়। এছাড়াও বিভিন্ন স্কুল, কলেজ এবং মাদ্রাসা পড়–য়া শিক্ষার্থীদের (১৫-২০ বছর বয়সী) টার্গেট করে তার নিয়োগকৃত মহিলা এজেন্টরা বিভিন্ন বালিকা বিদ্যালয় এবং মহিলা মাদ্রাসায় গিয়ে অপেক্ষমান অভিভাবকদের সাথে মিশে যায় এবং সেখান থেকে বিভিন্ন মেয়েদের টার্গেট করে। অভিভাবক পরিচয়ে তারা স্কুল পড়–য়া অল্পবয়সী মেয়েদের বিভিন্ন গোপন সমস্যা নিয়ে কথা বলে এবং সে সমস্যাগুলো কবিরাজী চিকিৎসা ও তাবিজ গ্রহণের মাধ্যমে স্থায়ী সমাধানের ব্যাপারে তাদেরকে প্রলুব্ধ করে। তাদের প্রলোভনে পড়ে ভিকটিমরা তাদের নিকট জমানো টাকা, অলংকার এবং পারিবারিক যেকোন মূল্যবান সম্পদের বিনিময়ে হলেও সমস্যা সমাধানের জন্য মরিয়া হয়ে উঠে। তাদেরকে প্রলুব্ধ করার পর তার সহযোগীরা কবিরাজ ওয়াস কুরুনীর মোবাইল নম্বর প্রদান করত। তখন সে তাদের সাথে ফোনে কথা বলে তাদের নিকট থেকে অর্থ এবং স্বর্ণালংকারসহ বিভিন্ন মূল্যবান সম্পদ হাতিয়ে নিত।
৩। গ্রেফতারকৃত ওয়াস কুরুনী আরও জানায় যে, টার্গেটকৃত নারী ও পুরুষ ভিকটিমদের সাথে সে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের বিভিন্ন এ্যাপসের মাধ্যমে চ্যাটিং ও ভয়েস কলের মাধ্যমে সম্পর্ক গড়ে তোলে এবং তাদেরকে সমস্যা সমাধানের আশ্বাস দেয়। প্রাথমিকভাবে সে জ্বীন চালানের মাধ্যমে ঔষধ প্রদান এবং গায়েবী চিকিৎসা শুরু করার জন্য দূর্লভ কিছু উপাদান যেমন, কচি কবুতরের রক্ত, ইদুরের মাংস, বানরের লোম, বাদুরের পা, গভীর রাতে শ্মশানঘাট হতে মাটির কলসিতে পানি সংগ্রহ করা সহ দুষ্প্রাপ্য জিনিস সংগ্রহ করতে বলত। তখন ভিকটিমরা জানায় এসব জিনিস তাদের পক্ষে সংগ্রহ করা সম্ভব নয়। তখন সে এসব জিনিস সংগ্রহ করার বদলে মোটা অংকের টাকা দাবী করত।
তখন ভিকটিমরা বাধ্য হয়ে তাকে বিকাশের মাধ্যমে টাকা প্রদান করত। তার চিকিৎসা দ্বারা কাজ না হওয়ার বিষয়ে রোগীরা অভিযোগ দিলে বা আরও ত্বরান্বিত চিকিৎসা চাইলে জ্বীনের মাধ্যমে দ্রæততম সময়ে সঠিক চিকিৎসা পাওয়ার জন্য জ্বীনকে উপহার দেয়ার কথা বলে সে ভিকটিমদের নিকট থেকে সুকৌশলে স্বর্ণালংকারসহ বিভিন্ন মূল্যবান সম্পদ কুরিয়ার সার্ভিসের মাধ্যমে তার নিকট পাঠাতে বলত। ভিকটিমদের বিশ্বাস অর্জনের জন্য সে কবিরাজীর বিভিন্ন ছবি এবং ভিডিও ধারণ করে ভিকটিমদের নিকট পাঠাত। তার নিকট হতে উদ্ধারকৃত মোবাইলে এরকম অসংখ্য ছবি এবং ভিডিও পাওয়া যায়। কেউ তার প্রতি অবিশ্বাস বা সন্দেহ প্রকাশ করলে দুষ্ট জ্বীন দ্বারা নিয়মিতভাবে তাদেরকে শারীরিক এবং মানসিকভাবে ক্ষতির সম্মূখীন হতে হবে বলে হুমকি দিত।
এভাবে সে ভিকটিমদের গায়েবি ভয় ভীতি দেখিয়ে ধাপে ধাপে তাদের নিকট হতে বিকাশের মাধ্যমে টাকা নিত। সে কখনও কোন ভিকটিমের সাথে দেখা করতে চাইত না। নারী ভিকটিমদের নিকট থেকে অধিক অর্থ আদায়ের জন্য সে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে অশ্লীল ভিডিও ছড়িয়ে দেওয়ার ভয় দেখাত। তখন ভিকটিমরা নিরুপায় হয়ে তার চাহিদা মত অর্থ প্রেরণ করতে বাধ্য হত। এভাবে প্রতারণার মাধ্যমে সে এবং তার পুরো চক্রটি মিলে বিগত ০৩ বছরে অর্ধশতাধিক লোকের নিকট থেকে বিপুল পরিমাণ অর্থ এবং স্বর্ণালংকার হাতিয়ে নিয়েছে। উক্ত স্বর্ণালংকার ও আত্মসাৎকৃত অর্থ দিয়ে সে লৌহজং এলাকায় জমি কিনে বাড়ি তৈরী করে। অর্থ এবং স্বর্ণালংকার গ্রহণের পর ভিকটিমদের ফোন নম্বর সে এবং তার এজেন্টরা মোবাইল থেকে বøক করে দেয়, যাতে করে ভিকটিমরা কোনভাবেই তাদের সাথে আর যোগাযোগ করতে না পারে। এরপর ভ‚ক্তভোগীরা তাদের প্রদানকৃত অর্থ এবং অলংকার ফেরত পাওয়ার জন্য বিভিন্ন মাধ্যমে তার সাথে যোগাযোগ করার চেষ্টা করেও ব্যর্থ হয়।
৪। ধৃত ওয়াস কুরুনী মাদ্রাসা হতে হেফজ খানা পর্যন্ত পড়ালেখা করেছে। সে ১৫-১৬ বছর বয়স থেকে কবিরাজি পেশা শুরু করে। প্রথমে সে যাত্রীবাহি বাসে তাবিজ বিক্রি ও বশিভ‚ত করনের বই বিক্রি করত। এরপর সে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বেনামী একাউন্ট পরিচালনা করে এবং বিভিন্ন এ্যাপস্ এর মাধ্যমে নিরীহ সহজ সরল সমস্যাগ্রস্ত বিভিন্ন বয়সের নারী পুরুষদের সাথে সম্পর্ক গড়ে তুলে প্রতারণা করে অর্থ ও স্বর্ণালংকার আত্মসাৎ করত। তার দৃশ্যমান কোন পেশা নেই। প্রতারণাই তার পেশা। সে ০৪ বছর পূর্বে মুন্সিগঞ্জ জেলার লৌহজং এলাকায় বিয়ে করে সেখানেই বসবাস করছে। তার প্রতারণার কাজে তার স্ত্রী তাকে সহায়তা করে থাকে।
৫। গ্রেফতারকৃত আসামীর বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা প্রক্রিয়াধীন।
দৈনিক কলম কথা সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।