বাংলাদেশি কূটনীতিকদের কেলেঙ্কারির যেন শেষ হচ্ছে না। গৃহকর্মী নির্যাতন, নারী কেলেঙ্কারি থেকে এখন মাদক কেলেঙ্কারিতে জড়িয়ে গেছে বাংলাদেশি কূটনীতিকদের নাম। কয়েকজন বিদেশের মাটিতে গ্রেফতার হয়ে সম্মান খুইয়েছেন বাংলাদেশের।

বছরের পর বছর ধরেই এমন কেলেঙ্কারির খবর আসছে। কিছু ক্ষেত্রে ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে, কিছু ক্ষেত্রে পার পেয়ে গেছেন অভিযুক্তরা। তবে প্রতিটি ক্ষেত্রেই ভাবমূর্তি নষ্ট হয়েছে বাংলাদেশের।

সর্বশেষ চলতি মাসে ইন্দোনেশিয়ায় বাসভবনে মাদক রেখে আটক হয়ে দেশের সুনাম ভূলুণ্ঠিত করা কাজী আনারকলি ২০তম ব্যাচের পররাষ্ট্র ক্যাডারের কর্মকর্তা। নানাভাবে মন্ত্রণালয়ের দোর্দণ্ড প্রভাবশালী হয়ে ওঠেন এই নারী কূটনীতিক। বেশ কিছু নারী কেলেঙ্কারির তদন্ত কমিটিতেও ছিলেন তিনি। ফরেন সার্ভিসে নিজের সার্কেল গড়ে তুলে প্রভাব খাটাতেন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত ইন্দোনেশিয়ার আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হাতে ধরা পড়ে ধূলিসাৎ করেছেন দেশের ভাবমূর্তি। বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রীর

ইন্দোনেশিয়া সফরের আগে আগে নিজ বাসভবনে নাইজেরিয়ান এক নাগরিকের সঙ্গে মাদকসহ আটক হন কাজী আনারকলি। খবরে বলা হয়েছে, সেই নাইজেরিয়ান নাগরিকের সঙ্গে লিভ টুগেদারে ছিলেন তিনি। আগের কর্মস্থল যুক্তরাষ্ট্রের লস অ্যাঞ্জেলেস থেকেই এই নাইজেরিয়ানকে নিজের সঙ্গে রাখেন বাংলাদেশি এই নারী কূটনীতিক।

পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ কে আবদুল মোমেন বলেছেন, কাজী আনারকলি মাদকাসক্ত, রিহ্যাবে রেখে তাঁকে চিকিৎসা দেওয়া প্রয়োজন। ২০১৭ সালে কাজী আনারকলি লস অ্যাঞ্জেলেসে ডেপুটি কনসাল জেনারেল থেকে দ্রুততম সময়ে ইন্দোনেশিয়ার রাজধানী জাকার্তায় যেতে বাধ্য হয়েছিলেন।

কারণ সে সময় যুক্তরাষ্ট্রের ওয়াশিংটন ও নিউইয়র্কে পরপর দুই বাংলাদেশি কূটনীতিক গৃহকর্মী নির্যাতনের দায়ে গ্রেফতার হয়েছিলেন। কাজী আনারকলির গৃহকর্মী সাব্বিরও তখন সাত-আট মাস ধরে নিখোঁজ। গৃহকর্মী সাব্বির মামলা করলেই কাজী আনারকলি গ্রেফতার হতে পারেন এ অসম্মান থেকে বাঁচাতেই তাঁকে দ্রুত সেখান থেকে সরিয়ে নেওয়া হয়।

বাংলাদেশের কূটনীতিকদের আরেকটি বড় পদস্খলন হয়েছে নারী কেলেঙ্কারিতে। সর্বশেষ চলতি বছর সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ‘অশ্লীল চ্যাটিং’ ও একটি ভিডিও ছড়িয়ে পড়ার পর কলকাতায় বাংলাদেশ ডেপুটি হাইকমিশনের প্রথম সচিব (রাজনৈতিক) মো. সানিউল কাদেরকে প্রত্যাহার করে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়।

নারী কেলেঙ্কারির অভিযোগে ২০১৪ সালে ইতালির বাণিজ্যিক শহর মিলানে বাংলাদেশের কনসাল জেনারেল পদে নিযুক্ত থাকা অবস্থায় মো. তাওহীদুল ইসলামকে দেশে ফিরতে হয়। তাঁর বিরুদ্ধে মিশনেরই এক নারী সহকর্মী যৌন হয়রানির অভিযোগ এনেছিলেন। এ অভিযোগের তদন্ত কমিটিতে ছিলেন কাজী আনারকলি। এর আগের বছর অসদাচরণের জন্য সাবেক রাষ্ট্রদূত পর্যায়ের সিনিয়র কর্মকর্তাকে বাধ্যতামূলক অবসরেও পাঠানো হয়েছে। অবশ্য রাজনৈতিক বিবেচনায় নিয়োগপ্রাপ্ত এশিয়ার একটি দেশে বাংলাদেশের এক অধ্যাপক রাষ্ট্রদূতের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থাই নেওয়া হয়নি।

সাবেক রাষ্ট্রদূত ও পররাষ্ট্র সচিব ওয়ালিউর রহমান বলেন, ‘কূটনীতিকরা যেসব কেলেঙ্কারিতে জড়াচ্ছেন এটা উদ্বেগের বিষয়। কিন্তু তার থেকেও উদ্বেগের বিষয় বাংলাদেশি কূটনীতিককে তাঁর বাসা থেকে গ্রেফতার করে নিয়ে যাওয়া। এটা কঠোরভাবে ভিয়েনা কনভেনশনের লঙ্ঘন। বাংলাদেশি কূটনীতিকদের ক্ষেত্রে কেন বারবার এমন হচ্ছে তা নিয়ে আমাদের ভাবতে হবে।

কোনো আইনের লঙ্ঘন হলে বাংলাদেশকে জানাতে হবে, তা না করে কোনো কূটনীতিককে অন্য দেশের আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী বাসার বাইরে নিয়ে যাচ্ছে, এটা মেনে নেওয়া যায় না। আগে যুক্তরাষ্ট্রকে এ বিষয়ে বাংলাদেশের বক্তব্য জানানো হয়েছে। এখন বাংলাদেশের উচিত কঠোরভাবে ইন্দোনেশিয়াকেও এটা মনে করিয়ে দেওয়া। সেই সঙ্গে ইন্দোনেশিয়ায় ঢাকা থেকে তদন্ত দল পাঠিয়ে সঠিকভাবে তদন্ত করে সে হিসেবে ব্যবস্থা নেওয়া প্রয়োজন।’