শিক্ষকতা ও সাংবাদিকতা দুটোই মহান পেশা। কিন্তু পেশা হিসেবে দুটোই আলাদা। একটি জাতির বা একটি রাষ্ট্রের কাছে সাংবাদিকতার চেয়েও অধিক মহান পেশা শিক্ষকতা। কোনো না কোনো শিক্ষকের কাছে শিক্ষা গ্রহণ করেই প্রত্যেক সাংবাদিককেই সাংবাদিকতায় আসতে হয়েছে।
অনুরুপভাবে সাংবাদিকতাকে রাষ্ট্রের ৪র্থ স্তম্ভ বলা হয়েছে। জাতির বিবেক একজন সাংবাদিককে নিরন্তর চর্চার মাধ্যমে সার্বক্ষণিক সময় দিতে হয়। সৃজনশীলতা ধরে রাখতে হলে আমার কাছে মনে হয় যেকোন চাকরিজীবীর ক্ষেত্রে সাংবাদিকতাটা মানায় না। কারণ সাংবাদিকতার কোন নির্ধারিত সময় নেই। তবে ব্যবসায়িক লোক হলে সমস্যা হয় না।
আজ সমাজটাকে কোথায় নিয়ে যাচ্ছেন শিক্ষক-সাংবাদিক? বর্তমানে দেশের বিভিন্ন প্রান্তে পরিলক্ষিত হচ্ছে শিক্ষকদের একটি অংশ সাংবাদিকতা করছেন যেটা নীতিমালা বহির্ভূত। শিক্ষার্থীদের মানুষ গড়ার মহান ব্রত ত্যাগ করে শিক্ষকতার পরিচয় বাদ দিয়ে সাংবাদিকতার পরিচয় দেওয়া কতটা সমুচিত জানিনা। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে সময় দিয়ে শিক্ষকের অবস্থান ঠিক রাখায় সমাজ,জাতি ও রাষ্ট্রের জন্য মঙ্গলকর। শিক্ষক প্রাতিষ্ঠানিক মাসিক বেতন-ভাতা পাচ্ছেনই তাছাড়া সামাজিক অবস্থানও সাংবাদিকের চেয়েও কম না। তাহলে কেন শিক্ষক সাংবাদিকতা করবেন? শিক্ষক তো নিজেই মানুষ গড়ার কারিগর, আজকে যিনি সাংবাদিক তিনিও তো শিক্ষা গ্রহণ করেছেন। সাংবাদিকতার পরিচয়কে মফস্বলে ‘শিক্ষক- সাংবাদিকরাই’ শিক্ষকতার চেয়ে বড় করে দেখিয়ে তাদের মহান পেশাকে ভুলে যাচ্ছেন। মননশীল চেতনার সার্বক্ষণিক সময় আত্মনিয়োগকারী অসংখ্য প্রকৃত সাংবাদিক আজ ‘শিক্ষক-সাংবাদিকতার কাছে পরাজিত হয়ে অন্তরদহনে জ্বলছে। দেশের শীর্ষ স্থানীয় মিডিয়ায় শিক্ষকদের পদচারণায় আত্মনিয়োগকারী প্রকৃত সাংবাদিকেরা অবস্থান তৈরি করতে পারছেন না বলেই সমাজের অসংগতি তৈরি হচ্ছে বলে মনে করছি। তবে সাংবাদিকদের ভিতরেও যে কিছু অসৎ ও হলুদ সাংবাদিক যে নেই,এটাও অস্বীকার করছি না।
যে যার জায়গায় ঠিক থাকলে মনে হয় একটু হলেও সমাজের জন্য কল্যাণ হবে। শিক্ষকের সন্মান সর্বমহলে বিরাজমান। সরকারি আইনে বলা হয়েছে বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের (স্কুল ও কলেজ) জনবল কাঠামো ও এমপিও নীতিমালা ২০২২ এর অনুচ্ছেদ ১১.১৭, বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান (মাদ্রাসা) জনবল কাঠামো ও এমপিও নীতিমালা ২০১৮ (২৩ নভেম্বর ২০২০ পর্যন্ত সংশোধিত) এর অনুচ্ছেদ ১১.১০(ক) এবং বেসরকারি কারিগরি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান জনবল কাঠামো ও এমপিও নীতিমালা ২০১৮ এর অনুচ্ছেদ ১৫.১ মোতাবেক এমপিওভুক্ত কোনো শিক্ষক কর্মচারী একই সঙ্গে একাধিক কোনো পদে/চাকরিতে বা আর্থিক লাভজনক কোনো পদে নিয়োজিত থাকতে পারবে না।
কিন্তু রাষ্ট্রীয় নিয়মনীতির তোয়াক্কা করেই শিক্ষকরা কর্মরত অবস্থায় সাংবাদিকতায় নাম লেখাচ্ছেন। এমতাবস্থায় জরিপ চালিয়ে যারা শিক্ষকতার পাশাপাশি সাংবাদিকতা করছেন তাদের থেকে কিছু মন্তব্য উঠে আসছে। যেমন- (ক) আমরা শিক্ষকরা অবসর সময়ে সাংবাদিকতা করি।
(খ) বস্তুনিষ্ঠ সংবাদ ও লেখার মান উন্নয়নে আমরাই উপযুক্ত।
(গ) বর্তমানে যে হারে অনভিজ্ঞ, অশিক্ষিত ও হলুদ সাংবাদিক বেড়েছে তাতে আমারা সাংবাদিকতায় না থাকলে সমাজে আরও সমস্যার সৃষ্টি হতো।
(ঘ) সামাজিকতা,সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন সভা-সমাবেশ ও অনুষ্ঠানে আমরা মানানসই।
(ঙ) শিক্ষকতার পাশাপাশি সাংবাদিকতাকে সর্ব মহলে বেশি মূল্যায়িত করে।
এছাড়াও আরও কিছু মন্তব্য করেছেন কতিপয় ‘শিক্ষক-সাংবাদিক’। যেগুলো লিখতে গিয়ে কলম থেমে গেছে।
যাইহোক উপরোক্ত মন্তব্যগুলো যথার্থ যুক্তিসঙ্গত। মন্তব্যগুলোর পরিপ্রেক্ষিতে বলছি যে, শিক্ষকেরা অবসর সময়ে সাংবাদিকতা করেন, কিন্তু কিভাবে? সাংবাদিকের কোন অবসর সময় নেই সপ্তাহে সাতদিন ২৪ ঘন্টায় সাংবাদিকের কাজ। তথ্য সংগ্রহের নির্দিষ্ট কোন সময় নেই, যেকোন মুহূর্তে যেকোনো জায়গায় তথ্য সংগ্রহে ছুটে যেতে হতে পারে। শিক্ষকের তো প্রাতিষ্ঠানিক একটা কর্মসময় আছে যেখানে থেকে শিক্ষার্থীদের পাঠদানে ফাঁকি দিয়ে ছাড়া সাংবাদিকতা অসম্ভবপ্রায়। আর পাঠদানে ফাঁকির কারণে শিক্ষার্থীদের শিক্ষাগ্রহণও সঠিকভাবে হচ্ছে না। শিক্ষার্থীরাও দেখছে শিক্ষক সাংবাদিকতার জন্য কি কি করছেন। বস্তুনিষ্ঠ সংবাদ ও লেখার মান উন্নয়নে শিক্ষক-সাংবাদিকেরাই সেরা, কারণ শিক্ষকরা শিক্ষিত এটাই স্বাভাবিক। বর্তমানে সামান্য লেখাপড়া জানা এমনকি একেবারে অশিক্ষিত সাংবাদিকও পাওয়া গেছে। কিন্তু এটা সাংবাদিক সমাজকে বুঝতে দিন। সমস্যাটা যখন সাংবাদিকদের বা সংবাদ সংশ্লিষ্ট কতৃপক্ষের তখন তাদেরই বোঝা উচিত কিভাবে সমাধান করতে হবে। ইতিমধ্যে বাংলাদেশ প্রেস কাউন্সিল চেয়ারম্যান বলছেন যে, বাংলাদেশ প্রেস কাউন্সিল সনদ ছাড়া সাংবাদিক পরিচয় দেওয়া যাবে না। এছাড়াও দেশব্যাপী সাংবাদিকদের ডাটাবেইজ তৈরির কার্যক্রমও চলমান এক্ষেত্রে কিছুটা হলেও সাংবাদিক সমাজের সন্মান নষ্টকারী অশিক্ষিত ও হলুদ সাংবাদিকের সংখ্যা কমবে। ব্যক্তিগত অভিমতে বলছি, সাংবাদিক ডাটাবেইজেও অসংখ্য ‘শিক্ষক-সাংবাদিকেরা নাম এন্ট্রি করিয়েছেন। যেখানে সরকারি আইনেই নেই শিক্ষক হয়ে সাংবাদিকতার নিয়ম, কতটা নিচে নেমেছেন মহান শিক্ষকতা পেশাকে আড়ালে রেখে সাংবাদিকতার ডাটাবেইজে নাম লেখাতে মরিয়া হয়ে উঠেছেন। সাংবাদিকদের মধ্যে অনভিজ্ঞ,অশিক্ষিত ও হলুদ সাংবাদিক যেমন সমস্যা তেমন সমস্যা শিক্ষকদের মধ্যেও যে নেই তা কিন্তু নয়। বিগত কয়েক বছরে অসংখ্য শিক্ষার্থী লাঞ্ছিত, ধর্ষিত হয়েছে শিক্ষক কতৃক। যা সমাজ ও রাষ্ট্রের জন্য অমঙ্গলকর ও লজ্জাজনক। এছাড়াও অনেক নেতিবাচক দিক আছে যেগুলো আলোচনা করা আমার পক্ষে সম্ভব নয়, আমিও কোনো না কোনো না শিক্ষকের শিক্ষা গ্রহন করেছি।
সব পেশাতেই ভালো মন্দ আছে, তবে যার যার অবস্থান ঠিক রেখে চললেই সমাজ ও রাষ্ট্রের ভারসাম্য ঠিক থাকে। শিক্ষার মান উন্নয়ন করে অনভিজ্ঞকে অভিজ্ঞ করার দায়ভার শিক্ষকের। কিছু হলুদ সাংবাদিকদের অজুহাত দিয়ে শিক্ষক- সাংবাদিক হয়ে দেশ ও দশের জন্য বিশেষ ভালো কিছু হচ্ছে বলে মনে হয়না। সামাজিকতা,সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন সভা-সমাবেশ ও অনুষ্ঠানে তো শিক্ষকরা এমনিতেই অধিক সন্মানীয়,আলাদাভাবে সাংবাদিক হয়ে দুটো সন্মান গ্রহণের বিশেষ প্রয়োজন হয়না। শিক্ষক থেকে সাংবাদিক না হয়ে একজন আত্মনিয়োগকারী সাংবাদিককে সন্মানটা ভোগ করতে দেওয়া উচিত। শিক্ষকতার পাশাপাশি সাংবাদিকতায় অধিক সন্মান পাচ্ছেন ঠিকই আবার সাংবাদিক সংগঠনগুলোতেও সর্বোচ্চ পদপদবী ধরে রাখতে মরিয়া হয়ে উঠেছেন কতিপয় শিক্ষক-সাংবাদিক। যারপরনাই নিজেকে সাংবাদিকতায় উৎসর্গ করা অনেক প্রকৃত সাংবাদিককে সমাজে ছোট হয়ে থাকতে হয়। কিছু অজুহাত দেখিয়ে শিক্ষক থেকে সাংবাদিক হয়ে দেশের শীর্ষ গণমাধ্যমগুলো নিজেদের নিয়ন্ত্রণে রেখে অসংখ্য সৎ,নির্ভীক ও অভিজ্ঞ সাংবাদিকদের বর্তমান সমাজে কোনঠাসা করে রেখেছেন আপনারাই। যোগ্যরা মূল্যায়ন পেলে অযোগ্যরা এমনিতেই হারিয়ে যাবে।
শিক্ষক তো এমনিতেই সন্মানীয়, বাড়তি সন্মানের কি দরকার আছে? সাংবাদিকতার কোন বয়স নেই, চাকুরী শেষে না হয় সাংবাদিকতা করলেন। অধিক লেখালেখির আগ্রহ হলে নিকটবর্তী একজন সাংবাদিককে নিজের লেখা দিলেন, সব সাংবাদিক তো আর খারাপ বা অনভিজ্ঞ না। অনভিজ্ঞ সাংবাদিকদের আপনারই পারতেন সংশোধনে আনতে কিন্তু সেটাও সম্ভব নয়, আপনারই সাংবাদিকতায় মিলেমিশে একাকার। মানুষ গড়ার কারিগর আপনি মানুষ গড়ুন,শিক্ষক সবার উর্ধে’ সমাজ ও রাষ্ট্রের এই মানসিকতাকে ধরে রাখার দায়িত্ব শিক্ষকদেরই। হে শিক্ষাগুরু পূজনীয় আপনি, না করিলেও সাংবাদিকতা।
সুমন চক্রবর্তী
প্রকাশক- কলম কথা
গণমাধ্যমকর্মী ও মুক্ত লেখক
দৈনিক কলম কথা সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।