মহান ‘স্বাধীনতা দিবস’ ১৬ ডিসেম্বর কি এবং কেন ? কেনই বা আমরা এ
দিনটি ব্যাপক উৎসাহ-উদ্দীপনা ও ভাবগাম্ভীর্যের সাথে পালন করে থাকি। রক্ত¯œাত ডিসেম্বর মাস,
স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশের মাথা উুঁচু করে দাঁড়াবার দিন। ১৬ ডিসেম্বর (মহান বিজয়
দিবস) বাংলাদেশ এবং বাঙালী জাতির এক গৌরবময় অধ্যায়। বাংলাদেশের বিশেষ দিন হিসাবে
রাষ্ট্রীয়ভাবে দেশের সর্বত্র দিনটি পালিত হয়। ১৯৭২ সালের ২২ শে জানুয়ারীর এক প্রজ্ঞাপনে দিনটিকে
বাংলাদেশের জাতীয় দিবস হিসেবে ঘোষনা করা হয় এবং এই দিনে সারা দেশে সরকারীভাবে ছুটি
ঘোষণা করা হয়। বাংলাদেশের একটি জনগোষ্ঠি, স্বাধীন সার্বভৌমত্ব, একটি নির্দিষ্ট ভূখন্ড, একটি
মানচিত্র এবং একটি পতাকার স্বীকৃতি নিয়ে পৃথিবীর মানচিত্রে ¯’ান পায় একটি দেশ, বাংলাদেশ।
হাজারো মা বোনের ইজ্জত,লাখো শহীদের রক্তে রঞ্জিত, দেশ প্রেমিক নিরীহ জনতার রক্তের বিনিময়ে অর্জিত
এই দেশ। এই দেশের স্বাধীনতা। ১৯৭১ সালের ৭ ই মার্চ বাঙালী জাতির অবিসংবাদিত নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ
মুজিবুর রহমানের ঐতিহাসিক ভাষণ ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম’ ‘এবারের সংগ্রাম
আমাদের স্বাধীনতার সংগ্রাম’ এবং পাকিস্তানী শাসক গোষ্ঠির বিরুদ্ধে ‘অসহযোগ’ আন্দোলনের
মত কাল প্রবাহে ঘটে যাওয়া অনেক ঘটনা প্রবাহের মধ্য দিয়ে স্বাধীনতার লক্ষ্যে ঐক্যবদ্ধ হয়ে ওঠে বাঙালি
জাতি। বঙ্গবন্ধুর ডাকে সাড়া দেয়া বীর বাঙালীদেরকে ঠেকাতে ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ (কালোরাত্রি)
পাকিস্তানী পাক হানাদার বাহিনী নির্বিচারে বাঙালী জাতির উপর নির্যাতন ও গণহত্যা শুরু করে। ২৬
মার্চ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বাংলাদেশের স্বাধীনতার ডাক দেন। বঙ্গবন্ধুর ডাকে সাড়া দিয়ে
বাঙালী জাতি দীর্ঘ ৯ মাস রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ ও সংগ্রামের পর ১৬ ডিসেম্বর পাক হানাদার বাহিনী
আত্মসমর্পনের মধ্য দিয়ে বিশ্বের মানচিত্রে ‘বাংলাদেশ’ নামে একটি নতুন রাষ্ট্রের আত্মপ্রকাশ ঘটে।
১৬ ডিসেম্বরের আগে পশ্চিমা শাসক গোষ্টির হাতে অবরুদ্ধ হওয়ার আগে ঘটে যাওয়া ঘটনা
প্রবাহ। যা বিশ্বের দরবারে এক ঘৃণ্যজনক ও কলংকময় অধ্যায়ের জন্ম দেয়। ভারত উপমহাদেশ থেকে
ঔপনিবেশিক শাসনের অবসান ঘটার পর পশ্চিম-পাকিস্তান এবং পূবর্-পাকিস্তানের জনগণের মধ্যে
রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক,সামাজিক, প্রশাসনিক , ভাষাগত দিক নিয়ে বিরোধ দেখা দেয়। ১৯২৫ সালে
চিত্তরঞ্জন দাসের মৃত্যু ,১৯২৬ সালে কোলকাতার হিন্দু মুসলিমের দাঙ্গার কারনে মাওলানা আকরাম খাঁ,
তমিজ্ধসঢ়;দ্দীন খাঁন প্রমুখ মুসলিম নেতাদের কংগ্রেস ত্যাগ। ১৯২৯ সালে প্রাদেশিক আইন পরিষদে
‘নিখিল বঙ্গ প্রজা সমিতি’ নামে একটি দল গঠনের সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। ১৯৩৫ সালে ময়মনসিংহে
প্রজা সমিতির সম্মেলনে এ কে ফজলুল হক ‘নিখিল বঙ্গ প্রজা সমিতির’সভাপতি নির্বাচিত হন।
পরবর্তী বছরে সমিতির নামকরণ করা হয় ‘কৃষক প্রজা পার্টি’। যা ছিল প্রদেশ পর্যায়ে গঠিত
বাংলার রাজনৈতিক সংগঠন। ১৯৩৭ সালের মার্চ মাসে এক নির্বাচনে কৃষক প্রজা পার্টি ও মুসলিম
লীগের মধ্যে তীব্র প্রতিদ্ব›িদ্বতা হয়। কোন দলই সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করতে না পারায় মুসলিম লীগ ফজলুল
হকের নেতৃত্বে সরকার গঠনের প্রস্তাব দেয়। ফজলুল হক মূখ্যমন্ত্রী নিযুক্ত হন এবং শিক্ষামন্ত্রীর দায়িত্ব
নেন। কাজ কর্মে জিন্নাহর সাথে ফজলুল হকের মতবিরোধ দেখা দেয়। ১৯৪১ সালে ‘ফজলুল হক’ মুসলিম
লীগ থেকে পদত্যাগ করেন। তার পক্ষে বাংলার জনগণের সংখ্যাগরিষ্ঠতা থাকায় তিনি নূতন মন্ত্রী পরিষদ গঠন
করেন। ফলে বাংলার রাজনীতিতে এক নূতন ধারার সূচনা হয়। ফজলুর হকের এই মন্ত্রী সভা ১৯৪১ সাল থেকে
৯৪৩ সাল পর্যন্ত ক্ষমতাসীন ছিল। ১৯৪৩ সালে বাংলায় ভয়াবহ দূর্ভিক্ষ প্রতিরোধের জন্য সামর্থ না থাকায়
ফজলুল হক পদত্যাগ করেন। ১৯৪৩ সালের ১৩ ই এপ্রিল দেশব্যাপী দূর্ভিক্ষের পটভূমিতে খাজা নাজিমুদ্দীন
মন্ত্রীসভা গঠন করেন। ১৯৪৫ সালে খাজা নাজিমদ্দীনের মন্ত্রী সভার পতন ঘটে। ১৯৪৬ সালে নির্বাচন ও
নেতৃত্বে ও লড়াইয়ে মুসলিম লীগ ২ ভাগে বিভক্ত হয়ে পড়ে। শেষ অবধি নির্বাচনে সোহরাওয়ার্দী
মুসলিম লীগের নেতা নির্বাচিত হন। ১৯৪৬ সালের ২৪ এপ্রিল বাংলা ও ভারতের রাজনৈতিক ক্রান্তিলগ্নে
সোহরাওয়ার্দী একটি মন্ত্রীসভা গঠন করেন। ১৯৪৭ সালে হিন্দু-মুসলিম সম্পর্কে এক রক্তক্ষয়ী দাঙ্গায় রূপ
নেয়। এর মোকাবেলায় বৃটিশ সরকার ভারতীয়দের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তরের ঘোষনা দেয়। পরি¯ি’তির
মোকাবেলায় সোহরাওয়ার্দী ‘যুক্ত বাংলার’ প্রস্তাব তোলেন। শরৎচন্দ্র বসু প্রস্তাব সমর্থন করেন।
প্রস্তাবটি উপমহাদেশের ইতিহাসে ‘বসু-সোহরাওয়ার্দী ’ প্রস্তাব নামে খ্যাত। ১৯৪৭ সালে ২৭
এপ্রিল দিল্লীতৈ এক সংবাদ সম্মেলনে শহীদ সোহরাওয়ার্দী তার বক্তব্যে স্বাধীন-সার্বভৌম অখন্ড রাষ্ট্র
গঠনের প্রস্তাব দেন। মুসলিম লীগ নেতা আবুল হাশিম বৃহত্তর বাংলা রাষ্ট্রের একটি রূপরেখা প্রণয়ন করেন।
১৯৪৭ সালের ২০ মে কোলকাতার কংগ্রেস নেতা শরৎচন্দ্র বসুর বাসগৃহে অখন্ড বাংলার পক্ষে এক চুক্তি
স্বাক্ষরিত হয়। এই ‘অখন্ড বাংলা’ প্রস্তাব নিয়ে কংগ্রেস ও মুসলিম লীগের নেতাদের মধ্যে তীব্র
প্রতিক্রীয়া দেখা দেয়। অবশ্য প্রথম দিকে মুসলিম লীগের গোড়াপত্তনশীল নেতারা ‘বৃহত্তর স্বাধীন বাংলা
রাষ্ট্রের’ পক্ষে ছিলেন। পরে তারা অখন্ড বাংলাকে পাকিস্তানের অংশ বানানোর দাবী করেন। আকরাম খাঁ ১৬ মে
নয়াদিল্লীতে জিন্নাহর সাথে বৈঠক করেন। বৈঠকের পর তারা সাংবাদিকদের জানান তারা মুসলিম লীগ
সমর্থন করে না। সাংবাদিকরা ‘যুক্ত বাংলার’ বিরুদ্ধে প্রচার প্রচারণা চালাতে থাকে। পশ্চিম বাংলা
কেন্দ্রিক বাঙালী ,অবাঙালী,ব্যবসায়ী ,বণিক, পূজিঁপতি শ্রেণী এর বিরদ্ধে কঠোর অব¯’ান গ্রহণ
করেন। ঢাকার হিন্দু সম্প্রাদয়ের বুদ্ধিজীবি সম্প্রদায়ও এর বিরুদ্ধে স্বো”ছার হয়ে ওঠে। জুন মাসের ৩
তারিখে লর্ড মাউন্ট ব্যাটেন ভারত বিভক্তির ঘোষনায় বাংলা ও পাকিস্তান ত্যাগের পরিকল্পনা করেন। জুন
মাসের ২০ তারিখে বিধান সভায় সংখ্যগরিষ্ঠ সদস্য বাংলা ভাগের পক্ষে রায় দিলে ‘বাংলা বিভাগ’ হওয়া
অনিবার্য্য হয়ে পড়ে। ১৯৪৭ সালে ভারত স্বাধীনতা আইনে পাঞ্জাব ও বাংলা ভাগের কথা বলা হয়। ১৯৪৭ সালের
আইনে ভারত ও বাংলা ভাগ হয়। ১৪ আগষ্ট পাকি¯’ান নামের আর একটি মুসলিম রাষ্ট্র। ১৫ আগষ্ট জন্ম হয়
আরেকটি রাষ্ট যার নাম দেয়া হয় ভারত। পূর্ব বাংলা পাকি¯’নের অংশে পরিণত হয়। পরে যা ‘পূর্ব
পাকি¯’ান’ নামে পরিচিতি লাভ করে। পশ্চিম বাংলা যুক্ত হয় ভারতের সাথে। ১৯৪৭ সালের আগষ্ট মাসে
পাকি¯’ান প্রতিষ্ঠার পর থেকেই পশ্চিম পাকি¯’ানের শাসক গোষ্ঠি বাঙালীর অধিকার হরণের চেষ্টায় লিপ্ত
হয়। পূর্ব পাকি¯’ানের মোট জনগোষ্ঠির ৫৪ ভাগ মানুষের মুখের ভাষা ‘বাংলা’ হওয়া সত্বেও সংখ্যালঘিষ্ঠ
৩.২৭% জনগোষ্ঠির ভাষা উর্দুকে রাষ্ট্র ভাষা হিসাবে চাপিয়ে দেয়ার চেষ্টা চালায়। শাসকগোষ্ঠি ১৯৪৮
সালে উর্দু- কে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে ঘোষনা করে। এই অন্যায় ও বৈষম্যের কারণে সুত্রপাত হয় ভাষা আন্দোলনের।
১৯৫২ সালে এই আন্দোলন চুড়ান্ত আকারে রূপ নেয়। ভাষার জন্য শহীদ হন সফিক,রফিক,বরকত ,জব্বার,শফিউর
সহ অনেকে। ১৯৪৮ সালের ১৯ মার্চ তৎকালীন পাকি¯’ানের গর্ভনর জেনারেল মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ
ঢাকায় আসন। ২১ মার্চ তৎকালনি রেডকোর্স ময়দানে উর্দুকেই একমাত্র রাষ্ট্রভাষা ঘোষনা করেন। ২৪
মার্চ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাবর্তন অনুষ্ঠানে তিনি একই ভাষন দেন। ১৯৪৮ সালে নভেম্বর মাসের
১৮তারিখে প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলী খাঁন ঢাকার এক বক্তৃতাকালে আবারো উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা হিসাবে
ঘোষনা দেন। তার প্রতিবাদে ছাত্র জনতা ‘না না, বলে প্রতিবাদ করে। ১৯৪৯ সালের মার্চ মাসে ‘পূর্ব
বাংলা ভাষা কমিটি, গঠন করা হয়।১৯৫০ সালের ১১ মার্চ আব্দুল মতিনকে আহŸায়ক করে ‘ঢাকা
বিশ্ববিদ্যালয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম কমিটি, গঠন করা হয়। ১৯৫২ সালের ২৬ শে জানুয়ারী প্রধানমন্ত্রী
খাজা নাজিমুদ্দীন পল্টন ময়দানে উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা ঘোষনা দেন। যোগ হয় ভাষা আন্দোলনের নূতন মাত্রা। ৩০
শে জানুয়ারী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ সভা ও ছাত্র ধর্মঘটের আহŸান করেন। ৩১
জানুয়ারী আওয়ামী মুসলিম লীগ সভাপতি ‘মাওলানা আব্দুল হামিদ খাঁন ভাষানীর’ সভাপতিত্বে ‘
সর্বদলীয় কেন্দ্রীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ’ গঠিত হয়। সভার সিদ্ধান্ত মোতাবেক ২১ শে ফেব্রæয়ারী
দেশব্যপী হরতাল,জনসভা ও মিছিল সমাবেশের ডাক দেয়া হয়। হঠাৎ করে পাকি¯’নের মুখ্যমন্ত্রী নূরুল
আমীন ঢাকা শহরে ১৪৪ ধারা জারী করেন। সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের নেতা-কর্মী, ঢাকা শহরের
স্কুল কলেজের হাজার হাজার ছাত্র-ছাত্রী সহ আপামর জনসাধারণ ১৪৪ ধারা তোয়াক্কা না করে ২১শে
ফেব্রæয়ারী সকাল ১১ টার সময় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘আমবটতলা’ চত্বরে অব¯’ান করলে ছাত্রদের সভা জন
সমুদ্রে পরিণত হয়। ছাত্র-ছাত্রীরা ‘রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই’ শ্লোগান দিয়ে খন্ড খন্ড ভাবে মিছিল করতে
থাকে। পুলিশ তাদের ছত্রভঙ্গ করতে মিছিলে লাঠিচার্জ ও কাঁদানে গ্যাস নিক্ষেপ করে। বিক্ষুদ্ধ ছাত্ররা
গণপরিষদেও সামনে অগ্রসর হতে থাকলে পুলিশ ছাত্র মিছিলের উপর গুলি চালায়। গুলিতে রফিকউদ্দীন
আহম্মেদ,আবুল বরকত, আব্দুল জব্বর ঘটনা¯’লে শহীদ হন। আব্দুস সালাম ঐদিন গুলিবিদ্ধ হয়ে ৭ এপ্রিল
শহীদ হন। বর্বরোচিত হত্যাকান্ডের প্রতিবাদে ২২ ফেব্রæয়ারী গণ-বিক্ষোভের পাশাপাশি শোক মিছিল
বের করে। মিছিলে পুলিশ ও মিলিটারী লাঠি , গুলি ও বেনোয়েট ব্যবহার করে। ঐ দিন শফিউর রহমান সহ
আরো বেশ কজন শহীদ হন। শহীদদের শহীদ হওয়া ¯’ানে ২৩ ফেব্রæয়ারী একটি স্মৃতিস্তম্ভ / শহীদ মিনার
তৈরী করা হয়। বাংলা ও উর্দু ভাষা নিয়ে বিতর্কের এক পর্যায়ে ১৯৫৬ সালের সংবিধানে ‘বাংলাভাষাকে’
রাষ্ট্রভাষা হিসাবে স্বীকৃতি দেয়া হয়। বাংলা ভাষাকে স্বীকৃতি দানের পর পাকি¯’ানীরা শাসন ব্যব¯’ায়
আমলাতান্ত্রিক ও স্বৈরাতান্ত্রিক প্রবনতার রূপ নেয়। ১৯৫৬ সালের ২৩ মার্চ জেনারেল ইস্কান্দার মীর্জা
পাকি¯’ানী প্রজাতন্ত্রের ১ম প্রেসিডেন্ট মনোনীত হন। ১০৫৮ সালে ৭ ই অক্টোবর ইস্কান্দার মীর্জা
মালিক ফিরোজ খানের সংসদীয় সরকার উৎখাত করে দেশে সামরিক শাসন জারী করেন। ২৭ অক্টাবর জেনারেল
আইয়ুব খাঁন ইস্কান্দার মীর্জাকে অপসরণ করে নিজেকে প্রেসিডেন্ট হিসাবে ঘোষনা দেন। জেনারেল
আইয়ুব খাঁন ১৯৫৮ সালে ক্ষমতা কুক্ষিগত করার পর পাকি¯’ানের শাসন ও রাজনৈতিক কাঠামোর ব্যাপক
পরিবর্তন করেন। ১৯৫৯ সালে মৌলিক গণতন্ত্র প্রবর্তনের আদেশ জারী করেন। পূর্ব পাকি¯’ানের জনগণ
রাজনৈতিক , প্রশাসনিক , সামরিক, অর্থনেতিক, শিক্ষা,সামাজিক , সাংস্কৃতিক বৈষম্য সহ সকল
দিক থেকেই বঞ্চিত হয়। ১৯৬২ সালের ৩০ জানুয়ারী হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীকে দেশবিরোধী
ষঢ়যন্ত্রের অভিযোগে গ্রেপ্তার করা হয়। পাকি¯’ানী ঔপনিবেশিক শাসন ও শোষন থেকে মুক্ত থাকার জন্য
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৬৬ সালে ৬ দফা কর্মসূচী ঘোষনা করেন। ২১ শে ফেব্রæয়ারী বঙ্গবন্ধুর
নামে ‘ আমাদের বাঁচার দাবী’ ৬ দফা কর্মসূচী শীর্ষক একটি পুস্তিকা প্রকাশ পায়। ১৯৬৬ সালে
(১৮-২০ মার্চ) আওয়ামীলীগের ওয়ার্কিং কমিটিতে ৬ দফা গৃহীত হওয়ায় ৬ দফার পক্ষে ব্যাপক জনমত গড়ে
ওঠে। জেনারেল আইয়ুব সরকার দিশেহারা হয়ে ১৯৬৬ সালের ৯ মে বঙ্গবন্ধু শেখ মজিবুর রহমানকে গ্রেপ্তার
করে। তার প্রতিবাদে ৭ জুন দেশব্যপী হরতাল পালিত হয়। হরতালের সময় পুলিশ মিছিলে গুলি চালালে গুলিতে
অনেকে নিহত হয়। এ ঘটনার প্রতিবাদে ৮ ই জুন প্রাদেশিক পরিষদে বিরোধী দল ওয়াক আউট করেন।
১৯৬৮ সালে বঙ্গবন্ধুকে আগরতলা মামলায় অভিযুক্ত করে ট্রাইব্যুনালে বিচার শুরু করে। ১৯৬৯ সালে গণ-
অভ্যুত্থানের মুখে সরকার বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে মুক্তি দিতে বাধ্য হয়। ১৯৬৯ সালের ২ রা জুলাই
ইয়াহিয়া খাঁনের ঘোষনা অনুযায়ী পাকি¯’ানের সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতি আব্দুস সাত্তারের
নেতৃত্বে একটি নির্বাচন কমিশন গঠন করা হয়। ১৯৭০ সালের জাতীয় পরিষদ নিবাচনে আওয়ামীলীগ
১৬২ টি আসনের মধ্যে ১৬০ টিতে জয়লাভ করে। সংরক্ষিত মহিলা আসন সহ আওয়ামীলীগ মোট ১৬৭ টি
আসন লাভ করে জাতীয় সংসদে একক সংখ্যা গরিষ্ঠতা লাভ করে। আবার পূর্ব পাকি¯’ানে প্রাদেশিক
পরিষদের সংরক্ষিত মহিলা আসন সহ ৩১০ টি আসনের মধ্যে আওয়ামীলীগ ২৯৮ টিতে জয়লাভ করে একক
সংখ্যগরিষ্ঠতা লাভ করে। জাতীয় ও প্রাদিশিক পরিষদে আওয়ামীলীগ নিরঙ্কুস সংখ্যা গরিষ্ঠতা অর্জন করলেও
৩রা মার্চ অনুষ্ঠিতব্য জাতীয় পরিষদের অধিবেশন জুলফিকার আলী ভূট্রোর প্ররোচনায় ১লা মার্চ ¯’গিত
ঘোষনা করেন। ঘোষনার প্রতিবাদে পূর্ব পাকি¯’ানের ছাত্র-শ্রমিক, সরকারী-বেসরকারী কর্মকর্তা-
কর্মচারী, তথা আম জনতা বিক্ষোভে ফেটে পড়ে। ১৯৭০ সালের নির্বাচনে সামরিক সরকার নির্বাচিত
প্রতিনিধিদের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর না করায় পাকি¯’ানের রাজনৈতিক অঙ্গনে এক চরম অসন্তোষ ও
অ¯ি’রতা দেখা দেয়। বঙ্গবন্ধুর ৭ ই মার্চের ভাষণের দিক নির্দেশনা অনুযায়ী ১৯৭১ সালের রেডকোর্স
ময়দানের সমাবেশে লক্ষ লক্ষ জনতার ঢল নামে। দেশের স্কুল কলেজ মাদ্রাসা ,অফিস আদালত, কল করখানা সব বন্ধ
হয়ে যায়। শুরু হয় অসহযোগ আন্দোলন। ১০ মার্চ সরকার এক সামরিক অধ্যাদেশ জারীর মাধ্যমে সকল
মর্ককর্তা-কর্মচারীদেরকে কর্ম¯’লে যোগদান করার নির্দেশ দেন। পূর্ব পাকিস্তানের জনগণ
অসহযোগ আন্দোলন বহাল রাখে। ১৩ মার্চ পুনরায় সামরিক আইন জারী করা হয়। ১৪ মার্চ পশ্চিম
পাকিস্তানের নেতা জুলফিকার আলী ভূট্রো পর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের হাতে ক্ষমতা
ছেড়ে দেয়ার ফর্মুলা পেশ করেন। যা ছিল অবানাতর ও অবাস্তব প্রস্তাব। বঙ্গবন্ধু ঐ দিনই ১৫ দফা ভিত্তিক
দাবীনামা জারী করেন। অব¯’ার গভীরতা উপলব্ধি করে ইয়াহিয়া খান ১৫ ই মার্চ ঢাকা সফরে আসেন। ১৬
মার্চ ইয়াহিয়া -মুজিব আলোচনা শুরু হয় । ২২ মার্চ হঠাৎ জুলফিকার আলী ভূট্রো ঢাকায় আসেন
এবং আলোচনায় অংশ নেয়। ২৩ মার্চ পাকিস্তানের প্রজাতন্ত্র দিবসে ২৩ মার্চ পূর্ব পাকিস্তানের ঘরে
ঘরে পাকিস্তানের পতাকার বদলে স্বধীন বাংলার পতাকা উত্তোলন করা হয়। ২৪ মার্চ আওয়ামী লীগ সংকট
সমাধানের চেষ্টা করেন । আলোচনা অসমাপ্ত রেখেই ২৫ মার্চ ইয়াহিয়া খান গোপনে ঢাকা ত্যাগ করেন।
১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ মধ্যরাতে পাকিস্তান বাহিনী পূর্ব-পাকিস্তানের নিরস্ত্র ,নিরীহ, স্বাধীনতাকামী
জনগণের উপর হামলা করে নির্বিচারে হত্যাযজ্ঞ চালায়। ২৬ মার্চ প্রথম প্রহারে ‘বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর
রহমান’ বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করেন। ২৬ মার্চ থেকে ১৬ ডিসেম্বর পর্যন্ত পাকিস্তান সামরিক
বাহিনী সারা বাংলাদেশ জুড়ে নির্যাতন , গণহত্যা আর ধ্বংসলীলায় মেতে ওঠে। ‘অপারেশন সার্চ লাইট,
নামে তারা এই গণহত্যা শুরু করে। এই সার্চ লাইট অপারেশনের নামে তারা ১৪ ডিসেম্বর বাংলাদেশের
অসংখ্যা বুদ্ধিজীবিকে হত্যা করে। ১৯৭১ সালের ৭ই মার্চ বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ভাষণ ‘এবারের
সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম,এবারের সংগ্রাম আমাদের স্বাধীনতার সংগ্রাম’। শ্লোগানকে
সামনে রেখে নিরস্ত্র বীর বাঙালীরা পাকিস্তানের অস্ত্রে সজ্জিত হায়েনাদের বিরুদ্ধে নিজেদের জীবন
বাজি রেখে স্বাধীনতা দ্ধুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ে। (২৬ শে মার্চ থেকে ১৬ ডিসেম্বর) দীর্ঘ ৯ মাস রক্তক্ষয়ী
যুদ্ধের পর ১৬ ডিসম্বর পাকি¯’ান দখলদার হানাদার বাহিনী ‘হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে’
আত্মসমর্পন করেন। বিশ্বের মানচিত্রে ¯’ান করে নেয় ‘সবুজের মাঝে লাল বৃত্তের সমারহে ’একটি পতাকা
ও মানচিত্র খচিত একটি স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র বাংলাদেশ। হাজার হাজার মা বোনের ইজ্জ্বত,লাখো লাখো
নিরীহ বাঙালী, বীর শহীদ- শহীদানদের রক্তে ¯œাত রক্তক্ষয়ী সংগ্রাম, পশ্চিমা পাকিস্তানীদের শোষন, শাসন,
নিপীড়ন-নির্যাতন, অত্যাচার-অনাচার-অবিচারকে পিছনে ফেলে আজ আমরা স্বাধীন, স্ব-গর্বে,
গর্বিত স্বাধীন বাংলাদেশের নাগরিক। এই ১৯৭১ সালের ১৬ ই ডিসেম্বর হানাদার মুক্ত হয়ে বাংলাদেশের
স্বাধীনতার পূর্ণতা লাভ করে। এই কারণে ১৬ ডিসেম্বরকে আমরা ভাবগাম্ভীর্য ,ব্যাপক উৎসহ উদ্দীপনা ও
আড়ানম্বরের সহিত পালন করে থাকি। এই ডিসেম্বর মাস বাঙালী জাতির জন্য গৌরব গাঁথা বিজয়ের
মহা উল্লাসের মাস।
মোঃ খালেদুর রহমান
লেখকঃ জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক,দৈনিক কলম কথা
দৈনিক কলম কথা সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।