আপনার আশেপাশেই হয়তো দেখবেন এমন কোনো বন্ধু আছে যে হয়তো গুনগুন করে গান গাইতে পারে, পারে গিটারে সুর তুলতে। সেই পারাতে হয়তো ঘাটতি আছে, ভুল হয় সুর, ভুল হয় তালও। কিন্তু সঠিক প্রশিক্ষণ পেলে সেও একদিন গানের সুর-তাল-লয় এর সঠিক ব্যবহার করতে পারবে। এই যে প্রথাগত জীবনের বাইরে আমরা সকলেই কমবেশি বাড়তি কিছু বিষয়ে আগ্রহী হয়ে উঠি, চাই সে বিষয়ে আরও দক্ষ হয়ে উঠতে, এটাই আসলে স্কিল ডেভেলপমেন্ট। সোজা বাংলায় যাকে বলে দক্ষতা উন্নয়ন। বর্তমান দুনিয়ায় এই বিষয়টিকেই দেখা হচ্ছে বেশ গুরুত্বের সাথে।

কেন এত গুরুত্ব?

আমরা সকলেই চাই নিজের একটা পছন্দের ক্যারিয়ার হোক। সেই স্বপ্ন বা লক্ষ্য পূরণে স্কিল ডেভেলপমেন্ট গুরুত্বপূর্ণ একটি ধাপ হিসেবে বিবেচিত হয়। বিশেষত প্রতিযোগিতামূলক বিশ্বে পছন্দের চাকরির জন্য যোগ্য হিসেবে গড়ে তুলতে নিজের দক্ষতার জায়গাটাকে শক্তিশালী করে তোলা উচিত।আবার শুধু একটি ক্ষেত্রে দক্ষ হয়ে উঠলে আপনার জন্য সুযোগও হয়ে উঠতে পারে সীমিত। একটি উদাহরণ দিয়ে বুঝানো যাক। আপনি হয়তো ফিচার লিখতে ভালোবাসেন। কিন্তু অন্য আরেকজন একই গুণের পাশাপাশি লেখাটি এসইও (সার্চ ইন্জিন অপটিমাইজেশন) ফ্রেন্ডলিও করতে পারেন। সে ক্ষেত্রে তার লেখাটি প্রকাশকের কাছে গুরুত্ব পাওয়ার সম্ভাবনা বেড়ে যাবে। এমন করে বিভিন্ন ক্ষেত্রে আপনি দক্ষতা যত বাড়াতে পারবেন, ততই আপনার কাজের পরিধি বাড়ানো সম্ভব হবে। দক্ষতা যে শুধু চাকরির বাজারেই গুরুত্বপূর্ণ এমন নয়, ব্যক্তিগত কিংবা সামাজিক ক্ষেত্রেও দক্ষতা উন্নয়নকে সমান গুরুত্ব দেওয়া হয়।

ধরণভেদে স্কিল

পেশাগত জীবনে সাধারণত দুই ধরনের স্কিল থাকা উচিত বলে মনে করা হয়। প্রথমটি, হার্ডস্কিল। দ্বিতীয়টি, সফট স্কিল। হার্ডস্কিল হচ্ছে আপনার কাজের সাথে সামন্জস্যপূর্ণ দক্ষতা। আপনি যদি পরিবেশ বিজ্ঞানের শিক্ষার্থী হয়ে থাকেন তাহলে পরিবেশ সম্পর্কিত প্রচলিত আইনগুলোর ব্যাপারে আপনার জানাটা আবশ্যক। এমন করেই আমাদের জানার জায়গার সব অলি-গলিতে বিচরণ আমাদের দক্ষ করে তুলতে পারে সংশ্লিষ্ট ক্ষেত্রে। এটাই আপনার হার্ডস্কিল। অন্যদিকে সফট স্কিল হচ্ছে এমন কিছু দক্ষতা যেগুলো আপনার ব্যক্তিত্বকে তুলে ধরতে সক্ষম। আপনাকে কোনো একটি কাজ দেওয়া হলে সেটি আপনি কতটা সহজভাবে, সুন্দরভাবে, চাপ সামলে নির্ধারিত সময়ের মধ্যে করতে পারেন সেটাই হচ্ছে আপনার সফট স্কিল।

আমরা কেন অবহেলা করছি?

মূলত দুইটি কারণে আমরা স্কিল ডেভেলপমেন্টের মতো গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টিকে অবহেলা করি। প্রথম কারণ, আমরা প্রায়ই অন্যরা যা অর্জন করে তা দেখে অনুপ্রাণিত হয়ে পড়ি। কিন্তু এটা অনুধাবন করি না যে সেই অর্জনের পথটা কতটা কঠিন ছিল তাদের জন্য। আমরা তাদের প্রশংসা এবং বিজয় দেখি এবং সফল হওয়ার জন্য কী লাগে তা সম্পর্কে মোটামুটি অনুমান করি। যখন আমরা একই লক্ষ্য নিজেরা অর্জনের চেষ্টা করি তখন ছোটখাটো ব্যর্থতায় আমরা হতাশ হয়ে পড়ি। তখন আমাদের মনে হয়, পথটা এত সহজ নয়। দ্বিতীয় কারণ, আমরা নিজেদের সামর্থ্যের প্রতি অবিচার করি। সাকিব আল হাসান বিশ্বের সেরা অলরাউন্ডার এটা আমরা সকলেই জানি। এর সাথে এটাও আমাদের মনে হয় যে, আমরা কখনো সাকিবের মতো হতে পারবো না। আমাদের মনে এমন ধারণা জন্মে যায় যে, সাকিবের হয়তো বিশেষ কোনো ক্ষমতা আছে যার ফলে সে সাফল্যের উচ্চ শিখরে পৌঁছাতে পেরেছে। আমাদের এমন ক্ষমতা নেই, তাই আমরাও পারবো না তার সমতায় যেতে।

এমন করেই আমরা স্কিল ডেভেলপমেন্ট বলে যে একটা বিষয় আছে তা বেমালুম ভুলে যাই। আমরা মানুষের সাফল্য দেখি। কিন্তু সেই সাফল্যের পেছনে দিনের পর দিন কঠোর পরিশ্রমটা আমরা দেখি না। দক্ষতা তো আর একদিনে অর্জন সম্ভব নয়। লেগে থাকতে হয়। হোঁচট খেয়ে আবার উঠে দাঁড়াতে হয়। দ্বিগুণ তেজ নিয়ে ফের লড়াইয়ে নামতে হয়। স্কিল ডেভেলপমেন্ট তবেই অর্জন সম্ভব।

কোনটি আগে শুরু করবেন?

আপনি যখন চাকরির জন্য আবেদন করতে বসেন তখন আপনার শিক্ষাগত যোগ্যতার সাথে মিলে যায়, এমন চাকরিতেই নিশ্চয়ই আবেদনে আগ্রহী হন, তাই না? আপনার শিক্ষাগত যোগ্যতার সাথে সাথে সংশ্লিষ্ট বিষয়টিতে আপনার দক্ষতাও বিবেচনায় আসে আপনাকে নিয়োগ দেওয়ার প্রক্রিয়ায়। একইসাথে সেই বিষয়ে আপনার পূর্ববর্তী কাজের অভিজ্ঞতাও প্রাধান্য পায় নিয়োগ প্রক্রিয়ায়। এভাবে হার্ডস্কিল আপনাকে এগিয়ে রাখবে অন্য প্রার্থীদের কাছ থেকে। তাই সফট স্কিলের আগে হার্ডস্কিলেই মনোযোগ দেওয়া জরুরি।

হার্ডস্কিল অর্জনের ধরণ বিষয়ভেদে ভিন্ন। এটি যেহেতু আপনার শিক্ষাগত যোগ্যতার সাথে সংশ্লিষ্ট, তাই একেকজনের ক্ষেত্রে এই স্কিল অর্জনের ধাপ বা চেষ্টা ভিন্নরকম হওয়াটাই স্বাভাবিক। এই ধাপগুলো হতে পারে বই পড়ে পড়ে এগোনো কিংবা সংশ্লিষ্ট বিষয়ের কারিকুলাম অনুসরণ করে শেখা। হার্ডস্কিল অর্জনের ক্ষেত্রে বিষয়ভেদে সময় এবং শ্রমেও আছে ভিন্নতা। তাই ধৈর্য হারানো চলবে না। বিষয়ভিত্তিক অভিজ্ঞতাই আপনাকে ভালো অবস্থানে নিজেকে দেখার সুযোগ করে দেবে। তবে কেউ যে শুধু পাঠ্যবই কিংবা কারিকুলামের গন্ডিতেই শেখাটা আবদ্ধ রাখে এমন ভাবতে যাবেন না কিন্তু। শেখার যেমন কোনো শেষ নেই তেমনি হার্ডস্কিলেও উন্নতির সুযোগ থাকে সবসময়ই। কর্মক্ষেত্রে গিয়েও শেখা যায় নতুন অনেককিছু। এতে করে যেমন অভিজ্ঞতা বাড়ে, তেমনি চাকরির বাজারে নিজের চাহিদাও বাড়ানোর সুযোগ থাকে।

সফট স্কিল নিয়ে ভাবনা?

সফট স্কিল অর্জনে ধরা বাঁধা কোনো নিয়ম নেই। সফট স্কিলের বিশাল তালিকা দেখে ঘাবড়ে যাবেন না। আপনাকে সব শিখতে হবে এমন কোনো কথা নেই। এই জায়গায় হতে হবে কৌশলী। জানা থাকতে হবে কর্মক্ষেত্রের চাহিদা সম্পর্কেও। মাইক্রেসফটের পেশাগত সামাজিক মাধ্যম লিংকড ইনের গেল বছরের এক তথ্য বলছে, ২০১৯ এবং ২০২০ সালে চাকরির বাজারে সবচেয়ে বেশি যে তিনটি সফট স্কিলের চাহিদা ছিল সেগুলো হলো সৃজনশীলতা (Creativity), প্ররোচনা (Persuasion) এবং সহযোগিতা (Collaboration)। তালিকা দেখেই বুঝতে পারছেন, ঠিক কোন সফট স্কিলগুলো আপনাকে এগিয়ে রাখবে অন্য সকলের চেয়ে। তবে নিজের সক্ষমতা ও ব্যক্তিত্বের জায়গাও প্রভাব ফেলে সফট স্কিল অর্জনে। অনেকেরই এমন হয়, দীর্ঘ সময় ধরে বিভিন্ন পরিস্থিতির মুখোমুখি হয়ে একটা গুণ আয়ত্ত হয়ে যায়। ধীরে ধীরে সেই বিষয়ে অভিজ্ঞ হয়ে ওঠা যায়। যেমন, আপনি হয়তো স্কুল কিংবা কলেজের ক্লাসে ক্যাপ্টেন ছিলেন, পুরো ক্লাসের নিয়ন্ত্রণ থাকতো আপনার হাতে। এই কাজটি করতে গিয়ে আপনাকে নানান পরিস্থিতির মধ্যে দিয়ে যেতে হয়েছে। এমন করে আপনার মধ্যে নেতৃত্ব গুণ তৈরি হয়ে গেছে। এটাই কিন্তু আপনার সফট স্কিল। কে বলতে পারে, দারুণ এই স্কিল হয়তো আপনার কর্মক্ষেত্রেও আপনাকে সাহায্য করবে চমৎকারভাবে!

সফট স্কিলের ক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশি প্রাধান্য দেওয়া হয় এমন কিছু স্কিল নিয়ে আলোচনা করতে গেলে প্রথমদিকেই আসে কমিউনিকেশন স্কিল, লিডারশীপ, দলগত কাজের দক্ষতা, চাপের মধ্যেও সময় ঠিক রেখে কাজ শেষ করার দক্ষতা এবং সৃজনশীলতার মতো বিষয়গুলো। এই বিষয়গুলো কিন্তু বই পড়ে কিংবা টিউটোরিয়াল দেখে শেখার মতো নয়। আপনি যদি শিক্ষা জীবনে ক্যাপ্টেন্সি করে থাকেন, ভলান্টিয়ারিং কাজে নেতৃত্ব দিয়ে থাকেন তাহলে আপনার মধ্যে লিডারশীপ বা নেতৃত্ব গুণ তৈরি হয়ে যাবে সময়ের সাথে সাথে। শিক্ষাজীবন তাই শুধু পাঠ্যবইয়ের সীমানায় আটকে না রেখে সহ-শিক্ষা কার্যক্রমগুলোতেও মনোযোগী হওয়া একান্ত প্রয়োজন।

মাথায় রাখুন কিছু বিষয়

সফট স্কিল হোক কিংবা হার্ডস্কিল – অর্জনের পথটা কখনোই সহজ হবে না, যদি আপনি কিছু বিষয় মাথায় না রাখেন।

◽প্রথমত, আপনাকে ঠিক করতে হবে আপনি কোন কর্মক্ষেত্রটি বেছে নিতে চান। দুই নৌকায় পা দিয়ে চলার মানসিকতা পরিহার করাই ভালো। এতে করে দুই কূলই হারানোর শঙ্কা থাকে। তাই লক্ষ্য ঠিক করতে হবে সবার আগে। তারপর সেই কর্মক্ষেত্রের চাহিদা মোতাবেক স্কিল অর্জনের চেষ্টা শুরু করুন।

◽দ্বিতীয়ত, আপনি যে স্কিল অর্জনের চেষ্টা করেন না কেন, আপনার অবশ্যই শেখার আগ্রহ থাকতে হবে। ধৈর্য হারিয়ে মাঝপথে থেমে গেলেন তো হেরে গেলেন। শেখার আগ্রহ না থাকলে মুখস্থ বিদ্যা দিয়ে সমস্যা সমাধানের পথে বেশি দূর এগোতে পারবেন না, নিশ্চিত থাকুন।

◽তৃতীয়ত, সাফল্যের কোনো শর্টকার্ট নেই- এই প্রচলিত কথাটি আমরাই সকলেই জানি। শেখার ক্ষেত্রেও তাই তাড়াহুড়ো করা উচিত নয়। এজন্য পর্যাপ্ত সময় নিয়ে স্কিল অর্জনের চেষ্টায় মনোযোগী হন।

শেষ কিন্তু শেষ নয়…
আপনি যদি নতুন কোনো লক্ষ্য ঠিক করেন তাহলে শুরুতেই সে সম্পর্কিত স্কিল ডেভেলপমেন্টে নজর দিন। সময় নিন, লেগে থাকুন। কেউই অভিজ্ঞ হয়ে জন্মায় না। সেরা কোচও দিনের পর দিন কোচিং শিখে সেরাদের কাতারে গিয়েছে। তাই অল্পতেই হাল ছেড়ে দেওয়া যাবে না। একবার এগোতে গিয়ে বারবার পেছনে ফেরার সুযোগ রাখা যাবে না। হোঁচট খেয়ে দিন-রাত খেটেই এগোতে হবে। তবেই সাফল্য আসবে।