পছন্দের যে পোশাকটি আপনার উৎসবকে করছে আনন্দময়, তার পেছনে জড়িয়ে আছে বহু মানুষের আন্তরিক প্রচেষ্টা। পেছনের সেই গল্প জানার জন্যই আয়েশা আবেদ ফাউন্ডেশনের প্রধান কারখানায়। যেখানে হাজার হাজার নারী কাজ করছে আপনার উৎসবের আনন্দ বাড়াতে, দৈনন্দিন জীবন রাঙাতে।

সেটা ১৯৭২ সালের কথা। সে সময়কার গ্রামীণ নারীরা একমাত্র গৃহস্থালি কাজেই থাকতেন ব্যস্ত। ফলে তাদের ছিল না অর্থ উপার্জনের সুযোগ কিংবা মতামত প্রকাশের স্বাধীনতা। কার্যক্রম শুরুর পর ব্র্যাকের প্রতিষ্ঠাতা ও চেয়ারম্যান ফজলে হাসান আবেদের সহধর্মিণী আয়েশা আবেদ ভাবতে শুরু করেন কীভাবে গ্রামের নারীদের কর্মঠ করে তাদের স্বচ্ছলতা ফিরিয়ে দেওয়া যায় এবং সমাজে নারী অধিকার প্রতিষ্ঠা করা যায়।

এই ভাবনা থেকেই ১৯৭৬ সালে মানিকগঞ্জের একটি ভাড়া বাসায় ৫ জন দুস্থ নারী নিয়ে কাজ শুরু করেন আয়েশা আবেদ। তিনি কাঁথা সেলাইয়ের কাজ দেন তাদের। কাঁথা বিক্রি থেকে উপার্জিত অর্থই ছিল তাদের পারিশ্রমিক। কাঁথা তো তৈরি হলো, কিন্তু বিক্রি করবেন কোথায়? সেই সময়ই হাতের কাছে পেয়ে যান এমসিসি নামক একটি প্রতিষ্ঠানকে।

পরে প্রতিষ্ঠানটির সঙ্গে বিক্রয় চুক্তি করেন আয়েশা আবেদ। কিন্তু চুক্তির ফলে বিক্রির অর্ধেক অংশই চলে যাচ্ছিল প্রতিষ্ঠানটির হাতে। এতে খুব একটা লাভবান হচ্ছিলেন না নারীকর্মীরা। তাই চুক্তি বাতিল করেন তিনি। ভাবলেন নিজেই একটি বিক্রয় প্রতিষ্ঠান করবেন যেন কর্মীরা লাভবান হন।

সেই ভাবনা থেকে ১৯৭৮ সালে ঢাকার শ্যামলীতে একটি বিক্রয় প্রতিষ্ঠান তৈরি করেন তিনি। নাম দেন ‘আড়ং।’ আড়ং শব্দের অর্থ হচ্ছে গ্রাম্যমেলা। ধীরে ধীরে কার্যক্রম বাড়তে থাকে আড়ংয়ের। আরও নারী যোগ দেন সেই কাঁথা সেলাইয়ে। কিন্তু এক দুর্ঘটনায় ১৯৮১ সালে মারা যান আয়েশা আবেদ।

তার স্বপ্ন পূরণ করতে ১৯৮৩ সালে মানিকগঞ্জে প্রথম ‘আয়েশা আবেদ ফাউন্ডেশন’ গড়ে তোলেন ফজলে হাসান আবেদ। এরপর ধীরে ধীরে আয়েশা আবেদ ফাউন্ডেশন গড়ে ওঠে জামালপুর, যশোর, কুষ্টিয়া, শেরপুর, ঝিনাইদহ, রাজবাড়ী, নীলফামারী ও কুড়িগ্রামে। বর্তমানে সারাদেশে ১৪টি ফাউন্ডেশন রয়েছে ও নির্মাণাধীন রয়েছে মাগুরাতে।

মূলত আয়েশা আবেদ ফাউন্ডেশন হচ্ছে আড়ংয়ের পণ্য তৈরির কারখানা। আর আড়ং হচ্ছে আয়েশা আবেদ ফাউন্ডেশন তথা ব্র্যাকের মার্কেটিং আউটলেট। দেশের ১৪টি ফাউন্ডেশনে কাজ করছে ৩০ হাজার কর্মী। এছাড়াও রয়েছে ৩৫ হাজার প্রডিউসার। সব মিলিয়ে ৬৫ হাজার কর্মীর প্রচেষ্টায় দেশের মানুষের কাছে বিভিন্ন পণ্য পৌঁছে দিচ্ছে আড়ং।

মানিকগঞ্জে রয়েছে আয়েশা আবেদ ফাউন্ডেশনের প্রধান কারখানা। এই কারখানার ৫টি শাখার তত্ত্বাবধানে রয়েছে ৮০টি সাব-সেন্টার। টেইলারিং, ব্লক প্রিন্ট, ক্রিন প্রিন্ট, টাই-ডাই, ক্যামিকেল ডাই, ন্যাচারল ডাই, বাটিক, হ্যান্ড প্রিন্ট, তাঁতসহ সকল গার্মেন্টস আইটেমের কাজ করা হয় এখানে। শাড়ি, সালোয়ার কামিজ, পাঞ্জাবি ও শার্টের কাজ হয় মানিকগঞ্জে। নকশীকাঁথার কাজ হয় জামালপুর, শেরপুর, কুষ্টিয়া ও যশোরে। দেশে এমন সাব-সেন্টার রয়েছে ৬৬০টি।

সারাদেশে মোট ৬৫ হাজার কর্মীর ৯০ শতাংশ কর্মীই হচ্ছে নারী। এখানে কাজের জন্য কোনও কর্মীকে বাধ্য করা হয় না। যে যতটুকু কাজ করবে, সে ততটুকুই মুজুরি পাবে- এই ভিত্তিতেই কাজ করছে তারা। সে হিসেবেও কাজ ভেদে কর্মীরা ৫ থেকে ২০ হাজার টাকা পর্যন্ত আয় করতে পারে। উৎসবগুলোকে কেন্দ্র করে আয় আরও বেড়ে যায়। এখানে যারা কাজ করে, তারা সবাই ব্র্যাক সমিতির সদস্য। ফলে তারা ভবিষ্যৎ সঞ্চয়ে উদ্বুদ্ধ হচ্ছে। এছাড়াও কর্মীদের বিনামূল্যে চিকিৎসা সেবা দিচ্ছে আয়েশা আবেদ ফাউন্ডেশন।

আয়েশা আবেদ ফাউন্ডশনের ম্যানেজার-অ্যাডমিন, কমপ্লায়েন্স ও লজিস্টিকস মোহাম্মদ গিয়াস উদ্দিন বলেন, ‘আমরা কর্মীদের চাকরি চলাকালীন সময়েই প্রশিক্ষণ দিয়ে থাকি। নতুন কর্মীকে একজন দক্ষ কর্মীর তত্ত্বাবধানে রেখে একমাস প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। একটি ডিজাইন থেকে সর্বোচ্চ ৩০-৫০টি পণ্য তৈরি করা হয়।

দীর্ঘ ২২ বছর ধরে আড়ং এর সঙ্গে কাজ করছেন মোহাম্মদ গিয়াস উদ্দিন। ‘আমরা তো শুধুমাত্র আড়ং থেকে পণ্যটা কিনি। কিন্তু এর পেছনে ব্র্যাক ও আয়েশা আবেদ ফাউন্ডেশনের যে বিশাল একটা কর্মীদল দিনরাত পরিশ্রম করছে, তাদের কথা কয়জন জানি?’ – বলেন তিনি। কারুশিল্পকে এগিয়ে নেওয়ার জন্য ব্র্যাক ও আড়ং এর এই পথচলার সঙ্গেই তিনি থাকতে চান আমৃত্যু।

তথ্যসূত্র: বাংলা ট্রিবিউন