গবেষণায় দেখা গেছে, বিষণ্নতায় ভুগে আত্মহত্যা করা ব্যক্তিদের মস্তিষ্কের ফ্রন্টোপোলার কর্টেক্সে কয়েক হাজার ধরনের গ্যাবা রিসেপ্টরের মধ্যে একটি বিশেষ রিসেপ্টরের সংখ্যা কম। মস্তিষ্কের এই ফ্রন্টপোলার কর্টেক্স সাধারণত সিদ্ধান্ত নেয়ার মতো উচ্চ-পর্যায়ের চিন্তার জন্য ব্যবহৃত হয়।
মানুষ কেন আত্মহত্যাপ্রবণ হয়ে ওঠে- সেই প্রশ্নের জবাব দীর্ঘদিন ধরে খুঁজে চলেছেন মনোচিকিৎসকেরা।
বিজ্ঞানবিষয়ক সাময়িকী সায়েন্টিফিক আমেরিকান তিনটি নতুন গবেষণার ভিত্তিতে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে, যেখানে দেখা গেছে- আত্মহত্যার প্রবণতা থাকা ব্যক্তির মস্তিষ্কের ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া সাধারণ মানুষের মস্তিষ্ক থেকে কিছুটা আলাদা। এই আলাদা বৈশিষ্ট্য জীবনব্যাপী ধীরে ধীরে গড়ে ওঠে।
গবেষণা বলছে, আত্মহত্যার অন্যতম প্রধান কারণ বিষণ্ণতা। বিষণ্নতার কারণেই দুই-তৃতীয়াংশ আত্মহত্যার ঘটনা ঘটে।
কানাডার গবেষকেরা দেখেছেন, আত্মহত্যাপ্রবণ ব্যক্তির মস্তিষ্কে গ্যাবা (GABA বা গামা-অ্যামিনোবিউটাইরিক অ্যাসিড) গ্রহণকারী ব্যবস্থা বা রিসেপটরগুলোর বিন্যাসে অসামঞ্জস্য রয়েছে। গ্যাবা হলো পরিপক্কভাবে বিকশিত স্তন্যপায়ী প্রাণীর কেন্দ্রীয় স্নায়ুতন্ত্রের প্রধান প্রতিরোধক নিউরোট্রান্সমিটার। এর মূল কাজ স্নায়ুতন্ত্রে স্নায়বিক উত্তেজনা প্রশমন করা।
গবেষক দলের অন্যতম সদস্য ও কানাডার ইউনিভার্সিটি অফ ওয়েস্টার্ন অন্টারিওর রবার্টস রিসার্চ ইনস্টিটিউটের নিউরোসায়েন্টিস্ট মাইকেল পোল্টার বলছেন, ‘যদি একটি গাড়ির অ্যাক্সেলারেটার ও ব্রেকের কথা চিন্তা করেন, তাহলে গ্যাবা হচ্ছে সেই ব্রেক।’
পোল্টার ও তার সহকর্মীরা দেখেছেন, বিষণ্নতায় ভুগে আত্মহত্যা করা ব্যক্তিদের মস্তিষ্কের ফ্রন্টোপোলার কর্টেক্সে কয়েক হাজার ধরনের গ্যাবা রিসেপ্টরের মধ্যে একটি বিশেষ রিসেপ্টরের সংখ্যা কম। মস্তিষ্কের এই ফ্রন্টপোলার কর্টেক্স সাধারণত সিদ্ধান্ত নেয়ার মতো উচ্চ-পর্যায়ের চিন্তার জন্য ব্যবহৃত হয়।
গ্যাবার এই অস্বাভাবিকতা কী করে একজনকে বিষণ্ণতাগ্রস্ত করে ফেলে এবং তিনি আত্মঘাতী হন, সে বিষয়ে গবেষকেরা এখনও নিশ্চিত নন।
মজার বিষয় হচ্ছে, গ্যাবা রিসেপ্টরের এ সমস্যা কোনো অস্বাভাবিক বা বিবর্তিত জিনের কারণে হয় না। এর কারণ এপিজেনেটিক। যার অর্থ হচ্ছে, কতবার জিনগুলো প্রোটিনে পরিবর্তিত হয়েছে তা নির্ধারিত হয় পরিবেশগত কিছু কারণে।
গবেষকেরা দেখেছেন, আত্মহত্যা করা ব্যক্তির মস্তিষ্কের ফ্রন্টপোলার করটেক্সে গ্যাবা রিসেপ্টরে অধিকাংশ সময় মিথাইল গ্রুপ অণু সংযুক্ত থাকে। কোনো জিনের সঙ্গে মিথাইল গ্রুপ যুক্ত থাকলে তা ওই জিনকে কোষের প্রোটিন তৈরির প্রক্রিয়া থেকে দূরে সরিয়ে রাখে। আত্মহত্যাকারীদের ক্ষেত্রে মিথাইল গ্রুপ মস্তিষ্কের কোষগুলোকে গ্যাবা রিসেপ্টর তৈরি করতে বাধা দেয়।
এই মিথাইল গ্রুপ সংযুক্ত হওয়ার প্রক্রিয়াকে বলা হয় মিথাইলেশন। মানুষের মস্তিষ্কে মিথাইলেশন কীভাবে ঘটে সে ব্যাপারে খুব বেশি জানা না গেলেও, সাম্প্রতিক আরেকটি গবেষণায় দেখা গেছে, এর সঙ্গে ছেলেবেলায় ঘটে যাওয়া নিপীড়নের সম্পর্ক থাকতে পারে।
কানাডার মন্ট্রিলের ম্যাকগিল ইউনিভার্সিটির এক গবেষণায় দেখা গেছে, শৈশবে নিপীড়নের শিকার হয়ে যারা পরিণত বয়সে আত্মহত্য করেছেন তাদের মস্তিষ্কের হিপোক্যাম্পাস অঞ্চলে কোষের প্রোটিন তৈরির প্রক্রিয়ার জন্য দায়ী জিন অধিকাংশ সময় মিথাইলেটেড হয়। ক্ষণস্থায়ী স্মৃতি ও বিশেষ দিক নির্দেশনার জন্য দায়ী মস্তিষ্কের এই হিপোক্যাম্পাস অঞ্চল।
ম্যাকগিল ইউনিভার্সিটির ফার্মাকোলজিস্ট ও গবেষণা দলের সদস্য মোশে এসজাইফ বলেন, ‘আপনার প্রোটিন সংশ্লেষণে ত্রুটি থাকলে মস্তিষ্কে গুরুত্বপূর্ণ সাইন্যাপস (নিউরনের মধ্যে যোগাযোগ) তৈরি হবে না। জীবনকে আনন্দে রাখতে এই যোগাযোগ খুবই গুরুত্বপূর্ণ। আমাদের হাইপোথিসিস হচ্ছে সামাজিক জীবনের এমন অনেক ঘটনাই এপিজেনেটিক্যালি মস্তিষ্ককে প্রভাবিত করে।’
এসজাইফ ও তার সহকর্মীরা একটি তুলনামূলক গবেষণা করেছেন। এ ক্ষেত্রে যে সব আত্মহত্যাকারী শৈশবে নিপীড়নের শিকার হয়েছেন তাদের সঙ্গে নিপীড়নের শিকার হননি এমন আত্মহত্যাকারীর মস্তিষ্কের বৈশিষ্ট্য পরীক্ষা করা হয়েছে।
মাতৃগর্ভে থাকার সময়েও এপিজেনেটিক প্রভাবের কারণে মস্তিষ্ক বিশেষভাবে পরিবর্তিত হতে পারে, যা আত্মহত্যার ঝুঁকিকে বাড়িয়ে দেয়।
২০০৮ সালের ফেব্রুয়ারিতে করা এক গবেষণায় দেখা গেছে, যে সব ছেলে শিশু খর্বকায় বা কম ওজনসহ জন্ম নেয় তাদের আত্মহত্যার ঝুঁকি অন্যদের চেয়ে বেশি। একইভাবে, নির্ধারিত সময়ের আগে জন্ম নেয়া ছেলে শিশুদের মধ্যে এই ঝুঁকি সঠিক সময়ে জন্ম নেয়াদের চেয়ে চারগুণ বেশি।
জার্নাল অফ এপিডেমিওলজি অ্যান্ড কমিউনিটি হেলথে প্রকাশিত এক গবেষণায় বলা হয়েছে, ভ্রূণ অবস্থায় মস্তিষ্কের বেড়ে উঠতে সহায়তা করে সেরাটোনিন নামের একটি পদার্থ। গর্ভের সময়কার পরিবেশ মানসিক চাপযুক্ত বা সুবিধাবঞ্চিত হলে তা ভ্রূণের বেড়ে ওঠা ও সেরাটোনিন প্রবাহের বাধা হয়ে দাঁড়াতে পারে। অন্য বেশ কয়েকটি গবেষণায় দেখা গেছে যে সব ব্যক্তির আত্মহত্যার প্রবণতা রয়েছে তাদের মস্তিষ্কে সেরাটোনিনের কার্যকারিতা কম।
গবেষণা থেকে পাওয়া তথ্যে পরিষ্কার, সাধারণ মস্তিষ্কের চেয়ে আত্মহত্যাকারীর মস্তিষ্ক অনেক দিক থেকেই আলাদা।
পোল্টার বলেন, ‘এখানে আসলে একধরনের জীববৈজ্ঞানিক অসমতা দেখা যাচ্ছে। এটা আচরণগত কোনো সমস্যা নয়।
এসজাইফ বলেন, ‘এপিজেনেটিক পরিবর্তনগুলো আমাদের জীবনে অনেক আগে ঘটে যায়, হয়তো ভবিষ্যতে কম বয়সীদের মিথাইলেশন প্যাটার্ন দেখে তাদের আত্মহত্যার ঝুঁকি আগেই নির্ণয় করা যাবে এবং সেই প্রক্রিয়াকে নিয়ন্ত্রণে ওষুধও ব্যবহার করা যাবে।’
আত্মহত্যার প্রবণতা নিয়ন্ত্রণে ওষুধ ও মনোচিকিৎসার ওপর জোর দিচ্ছেন বিশেষজ্ঞরা।
অস্ট্রেলিয়াপ্রবাসী চিকিৎসক চৈতালী বিশ্বাস এক ফেসবুক স্ট্যাটাসে লিখেছেন, ডিপ্রেশন বা বিষন্নতা আর দশটা অসুখের মতোই অসুখ এবং এর চিকিৎসাও রয়েছে।
তিনি লিখেছেন, ‘আমাদের মন খারাপ, মন ভালো এর সব আসলে নির্ভর করে আমাদের মস্তিষ্কের কেমিক্যাল রিঅ্যাকশনের উপর। আমাদের মস্তিস্ক হরমোনের মতো আরও অন্যান্য বিভিন্ন কেমিক্যাল তৈরি করে। এসব কেমিক্যালের মিথস্ক্রিয়ায় আমাদের অনুভূতি তৈরি হয়, আনন্দের বা দুঃখের অনুভূতি সব কিছুই এই মিথস্ক্রিয়ার ফল।’
চৈতালী বলছেন, ‘মস্তিষ্কে এ সমস্ত কেমিক্যালের ইমব্যালান্স বা কমবেশি হলে আমাদের মুড বা ফিলিংয়েও সমস্যা তৈরি হয়। বিষন্নতা বা ডিপ্রেশন মূলত শুরু হয় মস্তিষ্কের এই কেমিক্যাল ইমব্যালান্সের কারণে। তাই দেখবেন যার হয়তো মন খারাপ করার মতো কোনো কারণই নেই- সেও ডিপ্রেশনে আক্রান্ত হয়। হয়তো একজনের চাকরি বাকরি, টাকাকড়ি, গাড়িবাড়ি, পরিবার, বন্ধু সবই আছে, জীবনে সে হয়তো সবই পেয়েছে এবং কিছু হারায়ওনি, তবু সে বিষন্নতায় ভোগে।
‘অনেকের বেলায় অবশ্য ডিপ্রেশনের উপসর্গ প্রথম শুরু হয় কোনো মানসিক আঘাত পেলে। কোনো ঘটনায় মন খারাপ হওয়া খুব স্বাভাবিক ঘটনা, তবে সময়ের সঙ্গে সঙ্গে সেটি ধীরে ধীরে ঠিক হয়ে যাওয়াটাই নিয়ম। তবে যদি সেটা ঠিক না হয়ে একই রকম থাকে বা দিনদিন খারাপ হয় তখন বুঝতে হবে, সামথিং ইজ নট রাইট।’
মানসিক সমস্যায় আক্রান্তদের আশার কথা শোনাচ্ছেন চৈতালী। তিনি লিখেছেন, ‘ওষুধ দিয়ে এই কেমিক্যালের গড়বড় ঠিক করা যায়। খুব জটিল ওষুধও না, সাধারন ট্যাবলেট, নিয়মিত খেতে হয়। আমরা যা করি, বিষন্নতার রোগীর সঙ্গে ভালো ব্যবহার করে, বেড়াতে নিয়ে গিয়ে, উপহার কিনে দিয়ে তাদের মন ভালো করার চেষ্টা করি। তবে ওই কেমিক্যালের গড়বড় ঠিক না করলে আসলে অন্য কিছু করে তেমন একটা লাভ নেই।
‘সঙ্গে সাইকোথেরাপি বলে এক রকম থেরাপি আছে, সেখানে বিষন্নতায় আক্রান্ত ব্যক্তিকে ওষুধের পাশাপাশি শেখানো হয় কী করে নেগেটিভ চিন্তাভাবনা কম করা যায়, তবে আত্মহত্যার চিন্তা আসার মতো জটিল ডিপ্রেশনে ওষুধই আসল চিকিৎসা।’
ডিপ্রেশনকে অবহেলা না করার পরামর্শ দিয়ে চৈতালী লিখেছেন, ‘ডিপ্রেশন ক্যান কিল। অথচ আমরা একে কোনো গুরুত্বই দেই না। আপনি নিজে বা আপনার পরিচিত কেউ যারা এর ভিতর দিয়ে যাচ্ছেন তারা দয়া করে ডাক্তার দেখিয়ে ওষুধ নিন, অবহেলা করবেন না।’
দৈনিক কলম কথা সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।