১৯৩৪ সালে সিলেটের এক সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন আবুল মাল আবদুল মুহিত। তৎকালীন সিলেট জেলা মুসলিম লীগের নেতা আবু আহমদ আবদুল হাফিজের দ্বিতীয় ছেলে মুহিত। তার মা সৈয়দ শাহার বানু চৌধুরীও রাজনীতিতে সক্রিয় ছিলেন।
আবুল মাল আবদুল মুহিত একজন বীর মুক্তিযোদ্ধা। একজন অর্থনীতিবিদ, কূটনীতিক, ভাষা-সৈনিক।
ছাত্রজীবনে অত্যন্ত মেধাবী মুহিত ১৯৫১ সালে সিলেট এমসি কলেজ থেকে আইএ পরীক্ষায় প্রথম স্থান, ১৯৫৪ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইংরেজি সাহিত্যে বিএ (অনার্স) পরীক্ষায় প্রথম শ্রেণীতে প্রথম এবং ১৯৫৫ সালে একই বিশ্ববিদ্যালয় থেকে কৃতিত্বের সাথে এমএ পাশ করেন। চাকুরিরত অবস্থায় তিনি অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নসহ হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এমপিএ ডিগ্রি লাভ করেন।
১৯৫৬ সালে পাকিস্তান সিভিল সার্ভিস-এ (সিএসপি) যোগদানের পর মুহিত তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান, কেন্দ্রীয় পাকিস্তান এবং পরবর্তীতে বাংলাদেশে সরকারের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পদে দায়িত্ব পালন করেন।
বাংলাদেশে ১৯৭২ সালে তিনি পরিকল্পনা সচিব এবং ১৯৭৭ সালে অর্থ ও পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের বহিঃসম্পদ বিভাগে সচিব পদে নিযুক্ত হন।
মুহিত পাকিস্তান পরিকল্পনা কমিশনের চিফ ও উপ-সচিব থাকাকালে পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের মধ্যে বৈষম্যের ওপর ১৯৬৬ সালে একটি প্রতিবেদন প্রণয়ন করেন। পাকিস্তান জাতীয় পরিষদে এটিই ছিল এই বিষয়ে প্রথম প্রতিবেদন।
ওয়াশিংটন দূতাবাসের তিনি প্রথম কূটনীতিবিদ, যিনি স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় ১৯৭১-এর জুন মাসে পাকিস্তানের পক্ষ পরিত্যাগ করে বাংলাদেশের পক্ষে আনুগত্য প্রদর্শন করেন।
১৯৮১ সালে চাকরি থেকে স্বেচ্ছায় অবসর নিয়ে তিনি অর্থনীতি ও উন্নয়ন বিশেষজ্ঞ হিসেবে ফোর্ড ফাউণ্ডেশন ও ইফাদে কাজ শুরু করেন। ১৯৮২-৮৩ সালে অর্থ ও পরিকল্পনা মন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। পরে তিনি বিশ্বব্যাংক ও জাতিসংঘের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে বিশেষজ্ঞ হিসেবে কাজ করেন। ১৯৮৪ ও ১৯৮৫ সালে তিনি প্রিন্সটন বিশ্ববিদ্যালয়ে ভিজিটিং ফেলো ছিলেন।
লেখক হিসেবে মুহিত সমান পারদর্শী। প্রশাসনিক ও মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক গ্রন্থ ছাড়াও বিভিন্ন বিষয়ে তার ২১টি গ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে। বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলনে তিনি একজন পথিকৃত এবং বাপার প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি ছিলেন।
২০০৯ সালের ৬ জানুয়ারি মুহিত আওয়ামী লীগ সরকারের অর্থমন্ত্রী নিযুক্ত হন। অর্থমন্ত্রী হিসেবে তিনি ১২টি বাজেট উপস্থাপন করেছেন, যার ১০টি আওয়ামী লীগ সরকার আমলের।
আওয়ামী লীগ সরকারের গত দুইবারের অর্থমন্ত্রী আবদুল মুহিত সিলেট-১ আসনের সংসদ সদস্য ছিলেন।
তার হাত ধরেই সিলেট নগরীর উন্নয়নের আমুল পরিবর্তন আসে। বিশেষ করে শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও যোগাযোগ খাতকে প্রাধান্য দিয়ে নিরলসভাবে নিজ এলাকার উন্নয়নে কাজ করেছেন। বার্ধক্যের কারণে সবশেষ ২০১৮ সালের জাতীয় নির্বাচনে তিনি প্রার্থী হননি। রাজনীতি থেকে চলে যান অবসরে। যদিও দেশে এমন ঘটনা বিরল।
এরপর থেকে অনেকটা লোকচক্ষুর অন্তরালে যাওয়া সাবেক ডাকসাইটে এই কূটনীতিক নীরবে নিভৃতে বনানীর বাসায় সময় কাটাতেন। পরিবারের সঙ্গে সময় কাটানোর পাশাপাশি বইও লিখেছেন শুরুর দিকে। মাঝেমধ্যে কিছু অনুষ্ঠানে দেখা যেত।
কিন্তু ২০২০ সালে দেশে করোনা মহামারী শুরু হওয়ার পর নিজেও আক্রান্ত হন। সেই থেকে শুরু। এখনো করোনা পরবর্তী ধকল কাটেনি। সঙ্গে নানা অসুস্থতা যুক্ত হওয়ায় অনেকদিন হাসপাতালের বিছানায় কেটেছে। বাসায় ফিরলেও সেইভাবে সুস্থ হয়ে উঠতে পারেননি।
গত বছরে করোনায় আক্রান্ত হওয়ার পর থেকে অনেকটা শয্যাশায়ী হয়ে পড়েন বয়সের কোটা ৯০ ছুঁইছুঁই মুহিত। ওই বছরের ২৯ জুলাই তাকে ঢাকা সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে তাকে ভর্তি করা হয়। পরে তিনি করোনামুক্ত হয়ে সেখান থেকে বাসায় ফিরেন। তখন থেকে শারীরিকভাবে অনেকটা দুর্বল হয়ে পড়েন তিনি। সবশেষ সবাইকে কাঁদিয়ে অনন্তলোকে পাড়ি জমালেন প্রবীণ এই অর্থনীতিবিদ।
আবুল মাল আবদুল মুহিতের স্ত্রী সৈয়দা সাবিয়া মুহিত একজন ডিজাইনার। কন্যা সামিয়া মুহিত একজন ব্যাংকার এবং মুদ্রা নীতি খাতের একজন বিশেষজ্ঞ। তাদের জ্যেষ্ঠ পুত্র শাহেদ মুহিত একজন বাস্তুকলাবিদ এবং কনিষ্ঠ পুত্র সামির মুহিত একজন শিক্ষক। পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আব্দুল মোমেন তার ছোট ভাই।
দৈনিক কলম কথা সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।