দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি, হাপিয়ে উঠছে মধ্যবিত্তরা। হতাশায় মাথায় হাত গরিবের। নুন আনতে পান্তা ফুরায় কৃষকের। মাঝেমধ্যে অনাহারে দিন কাটছে বেকার তরুণের, ম্যাচে থাকা শিক্ষার্থীদের চুলার আগুন জ্বলছে অনিয়মিত। হোটেল গুলোতে নিম্নমানের খাবারে চড়াদাম, অভিযোগ স্বল্প আয়ে বেসরকারি চাকরিজীবীদের।
রোববারের সূর্য ঢলে পড়েছে পশ্চিম আকাশে। সারাদিনের ঘামঝড়া পরিশ্রমের ক্লান্তি কাটাতে নিজ রিকশায় বসে মুখে বাদশা বিড়ি নিয়ে আকাশরে দিকে তাকিয়ে কি যেন ভাবছেন জলিল, জিজ্ঞসা করতেই মুখে খই ফোটে অশ্রুসিক্ত চোখে জানালেন দ্রব্যমূল্য ঊর্ধ্বগতি হওয়ায় ক্রয় অক্ষমতার কথা। দুই ছেলে এক মেয়ে নিয়ে ভাসমান বস্তিতে চলছে বেঁচে থাকার আয়োজন। বড় ছেলে দশম শ্রেণির ছাত্র, ছোট ছেলে হিফয মাদ্রাসায় পড়ে।
সারাদিনে ৩শ টাকা আয় করলেও ১শ টাকা জমা দিতে হবে মালিককে। ২শ টাকা কেজি সয়াবিন কিনলে অস্তিত্ব হারাবে ছেঁড়া পকেটের। অন্যান্য নিত্য প্রয়োজনীয় পণ্যের চাহিদা মেটাতে দরকার ভারি পকেট কিন্তু পা যে আর কুলায় না।
উপায়হীন হয়ে আবারও মাজা বেকিয়ে রিকশার প্যাডেলে চাপ দিয়ে চলে গেলেন অজানা কিছু পাওয়ার খুঁজে।
মতিঝিল রোডে কালো পর্দার আড়াল থেকে ভেসে আসছে কি খাবার! এতো টাকা কেন?
পর্দাভেদ করে ঢুকেই দেখি হাতাহাতি, মানহীন খাবারের চরাদাম নেওয়ায় উত্তেজিত স্বল্পবেতনে চাকরিজীবী রাকিব। এদিকে হোটেল মালিক বুঝানোর চেষ্টা করছেন দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি হওয়ায় চরাদাম নিতে বাধ্য তাঁরা।
নীলক্ষেত মোড়ে মুঠোফোন কানে ঢাকা কলেজের এক শিক্ষার্থী বলেন, খালা আজকে বাসায় এসো না বাজার নেই।
বাজার নেই কেন? এমন প্রশ্ন করতেই দেখি চোখ জলে টয়টম্বুর। গতমাসে করোনা প্রাদুর্ভাব বৃদ্ধি হওয়ায় হারিয়েছে একমাত্র টিউশনি। বাবার আর্থিক অবস্থা অসচ্ছল থাকায় বাড়ি থেকে তেমন কিছুই দিতে পারে না পরিবার। বন্ধুদের থেকে ধার নিয়ে বেশ কিছুদিন ম্যাচের খাবার সমন্বয় করেছে। কিন্তু লাগামহীন দ্রব্যমূল্য ঊর্ধ্বগতি হওয়ায় এখন সবারই সংকটাপন্ন অবস্থা তায় ধার চাইতেও লজ্জা অনুভব করছে মাহমুদ।
খাবে কি এমন প্রশ্নের উত্তরে বলেন, ঢাকা কলেজের ক্যান্টিনে মানহীন খাবার আপাতত বেশি টাকা দিয়ে বাকি খাওয়া ছাড়া বিকল্প কিছু নেই।
ভালো কাজের হোটেলে চলছে বিনামূল্যে খাবার বিতরণ। কমলাপুরে রাস্তার পাশেই এমন আয়োজনে ভীড় করেছে কয়েকশত বাস্তুহীন ক্ষুধার্ত মানুষ। হঠাৎ করেই দেখামিলে সুদর্শন এক যুবকের। গল্পের ছলে জানতে চাইলাম এখানে কি করেন? আবেগ আর উৎকণ্ঠা প্রকাশ পেয়েছে তার মুখে। মাথাটা নীচু করে বলতে শুরু করলেন চাকরির খোঁজে ঢাকায় এসে অনহারে কাটানো রাত দিনের গল্প। ভালো কাজের হোটেলই যেন একমাত্র ভরসা। শুরুর দিকে বাড়ি থেকে নেওয়া টাকা দিয়ে খাবারের আয়োজন করতে পারলেও দ্রব্যমূল্যের বৃদ্ধি হওয়ায় শুনাতে হলো অনাহারে থাকার গল্প।
এদিকে দু’মাস কাটিয়ে গেলেও মিলছে না আশানুরূপ চাকরি। এমন হাহাকার, হতাশা ও উৎকণ্ঠার শেষ নেই শহরের অলিতে গলিতে।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) সর্বশেষ খানা আয়-ব্যয় জরিপে উঠে এসেছে, দেশে খানাপিছু গড় মাসিক আয় ১৫ হাজার ৯৪৫ টাকা। তার মধ্যে প্রায় ৪৮ শতাংশই যায় খাদ্য ক্রয়ে। দরিদ্র ও প্রান্তিক পরিবারগুলোর ক্ষেত্রে মাসিক মোট আয়ের প্রায় ৭০ শতাংশ পর্যন্ত ব্যয় হয় খাদ্যের পেছনে। এই খাদ্যের বেশির ভাগই চাল। দেশে দরিদ্র জনগোষ্ঠীর চালের মাথাপিছু দৈনিক ভোগ ৪৭০ গ্রাম, যা অন্যদের ক্ষেত্রে তা ৩৬৬ গ্রাম।
বর্তমান বাজারে লাগামহীন দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি নাভিশ্বাস করে তুলেছে মধ্যম আয়ের জনগোষ্ঠীকে। রাজধানীর বাজারদর অনুযায়ী, বর্তমানে সবজির দাম ৫০-১২০ টাকা, পেঁয়াজ ৫০-৬০ টাকা, রসুন ১২০ টাকা, ভোজ্যতেল ১৭০ টাকাসহ প্রায় প্রতি সপ্তাহেই দাম বৃদ্ধির খবর পাওয়া যাচ্ছে ডিম, মাছ ও মাংসের।
এদিকে চিনি আমদানিতে শুল্ক কমানোর সরকারি সময়সীমা হয়েছে গত ২৮ ফেব্রুয়ারি। এখন থেকে আবারও ৩০ শতাংশ শুল্ক দিয়ে পণ্যটি আমদানি করতে হবে। চিনির ওপর আরোপিত শুল্ক সুবিধা না বাড়ালে আগামী রোজায় চিনির দাম সেঞ্চুরি (১০০ টাকা) পার হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।
দৈনিক কলম কথা সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।