আব্দুল্লাহ ফছিয়ার | স্টাফ রিপোর্টারঃ মূল্যবোধ হলো রীতিনীতি ও আদর্শের মাপকাঠি; যাকে নাকি অরগানাইজেশান, সমাজ ও রাষ্ট্রের ভিত্তি হিসেবে ধরা হয়। নীতি ভালো-মন্দের মধ্যে একটা সুস্পষ্ট পার্থক্য গড়ে দেয়। সুতরাং ভিত্তি যদি নড়বড়ে হয়ে যায়, তাহলে সে সমাজ বা অরগানাইজেশান অথবা রাষ্ট্রেরও অনেক কিছুতেই ভারসাম্যহীনতা দেখা দেয়।

আজ থেকে ২০-২৫ বছর আগেও দেখা যেত যদি কেউ একজন অনৈতিক কাজে জড়িত থাকলে তাঁকে অনেকেই এড়িয়ে চলতেন। এমনকি যিনি অন্যায় বা অপরাধ করতেন, তিনি নিজেও অধিকাংশ ক্ষেত্রে লজ্জা পেতেন এবং অন্যদের এড়িয়ে চলতেন নিজেকে কিছুটা হলেও আড়াল করার চেষ্টা করতেন। বর্তমানে করপোরেটে বিপদগামী এবং বকে যাওয়াদের ক্ষেত্রে এখন তার উল্টোটা ঘটছে নিজে অপরাধী হয়ে নির্লজ্জের মত নিছক মিথ্যা এবং গলাবাজি করতে কুণ্ঠাবোধ করছে না। অন্যদিকে গণ্যমান্য ব্যক্তি, শিক্ষক কিংবা বয়োজ্যেষ্ঠ মানুষগুলি ভালো হওয়ার জন্য তাদেরকে যেখানে ভাল পরামর্শ দিতেন এখন সেটাও ঝুঁকিপু্র্ণ বোধ করেন। কারন অপরাধী প্রভারা তাদের পরকীয়ার আভা দিয়ে বাংলা সিনেমাটিক কোটি টাকার কাবিন রচনাসহ নিজ স্বার্থ চরিতার্থ করার যতপ্রকার নিম্নবর্গের কাজ আছে যদি সেটি করে ফ্যালে সেই ভয়ে এখন সমাজের সন্মানিত মানুষগুলি সাদামাটাভাবে এড়িয়ে চলতে সাচ্ছন্দ্য বোধ করেন সাথে সাথে নিজেকে ময়লা ফেলার রাস্তার মোড়ের ডাস্টবিন থেকে দুরে রাখেন।

কিন্তু ২০২১ সালে এসে আমাদের খুঁজতে হয় সম্মান ও নীতির ব্যাপারটার আদৌ কোনো অস্তিত্ব আছে কি না। অথবা এর প্রয়োজনীয়তা ও ব্যবহারের ক্ষেত্র কোনটি সঠিক এবং অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ।

অধিকাংশ সচেতন নাগরিক মহল এ অবস্থাকে নৈতিকতার অবক্ষয় হিসেবে আখ্যায়িত করে থাকেন। অবক্ষয় ব্যাপারটা ক্যানসারের মতো। সময়মতো সঠিক চিকিৎসা না হলে পুরো সমাজকে অথবা অরগানাইজেশানকে ধ্বংস করে দিতে পারে। যা নেতিবাচকভাবে করপোরেট কালচারকারকেও অনেকাংশে প্রভাবিত করে। আমাদের সমাজে অনেকে এখন প্রতিনিয়ত এটি উপলব্ধি করছে। সম্মানের সঙ্গে নীতির এবং নীতির সঙ্গে সামাজিক পরিস্থিতির বিদ্যমান একটা শক্তিশালী সম্পর্ক আছে। এই সম্পর্কটি যত দুর্বল হয়, নৈতিক অবক্ষয় নামক সংকট ততই মজবুত হয়।

নৈতিকতার বিচ্যুতি বর্তমানে আমাদের সমাজের সবক্ষেত্রেই দেখা যায়। বিচ্যুতি নেই এমন স্থান খুঁজে পাওয়া দুষ্কর ও কষ্টসাধ্য ব্যাপার। শিক্ষা, শিক্ষক, শিক্ষকতা, ছাত্র ও অভিভাবক সবাই ভবিষ্যৎ প্রজন্ম গড়ার প্রথম ধাপ এবং এটি সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্র, যেখানে প্রত্যেকের একটা সুনির্দিষ্ট ভূমিকা থাকে।

একসময় পাঠ্যবইয়ের পাশাপাশি নৈতিকতা, আদর্শ, আচার-আচরণ শেখানো হতো। এখন প্রায়ই দেখা যায় বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিক্ষক কর্তৃক শিক্ষার্থীর অনৈতিক হয়রানির ঘটনা। শিক্ষক যখন এ রকম কুকর্মে লিপ্ত থাকেন,সেই শিক্ষকের কাছ থেকে নৈতিকতা শেখার কোনো সুযোগ কোথায়?

নানাভাবে শিক্ষাক্ষেত্রে প্রতিনিয়ত দুমড়েমুচড়ে ফেলা হচ্ছে নৈতিকতাকে আর কলুষিত করা হচ্ছে ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে।

সর্বক্ষেত্রেই পদোন্নতি,পদ ও ক্ষমতার অপব্যবহার থেমে নেই। পুরোদমে চলে সরকাররের ও অন্যের অর্থ কীভাবে লোপাট করে নিজের করা যায় সে পায়তারা। মানুষ এতটাই দিশেহারা হয়ে গেছে যে ঠিক-বেঠিকের মধ্যে কোনো তফাত খুঁজে পায় না। প্রাইভেট সেক্টর বা করপোরেট দুনিয়ার কার্যক্রম পরিচালনা ও গতিবিধি ধীরে ধীরে সে দিকে এগিয়ে যাচ্ছে।

আমাদের সামাজিক ও ব্যক্তিজীবনেও অনৈতিকতা ও আদর্শহীনতার ছোঁয়া লেগেছে। অন্যের সফলতা আমাদের সহ্য হয় না। তাই তো সুযোগ পেলেই কাউকে বিপদে ফেলতে এতটুকু দ্বিধা করি না। কারও বিপদে সাহায্য করি না। দাঁড়িয়ে তামাশা দেখি। সেলফি নিই, ভিডিও করি। যাঁরা সাহায্য করতে আসেন, তাঁদের মধ্যে কিছু মানুষ আবার এটাকে ব্যবসা হিসেবে দেখেন। ফেসবুক/ইউটিউবে লাইভ করেন, অনুসারী বাড়ানোর জন্য।

অন্যের নামে কুৎসা রটানো, অপদস্থ করা, রাস্তাঘাট ও গণপরিবহনে নারীদের কটূক্তি করা, তুচ্ছ ব্যাপার নিয়ে মারামারি, খুন—কোনোটিই বাদ পড়ছে না। ব্যাপারটা এমন হয়ে গেছে যে আমিই ভালো, আমিই সফল হব, সবকিছু আমারই হতে হবে, আমার থেকে অন্য কেউ ভালো থাকতে পারবে না, সেটা যেভাবেই হোক।

রাস্তাঘাট, বন্দর, ব্যবসা-বাণিজ্য, অফিস-আদালত, শিক্ষা, চিকিৎসা—এমন একটা খাত খুঁজে পাওয়া যাবে না, যেখানে নৈতিকতা চরমভাবে বিপর্যস্ত নয়। কর্মকর্তা, কর্মচারী, রাজনৈতিক নেতা, আমজনতা কেউ বাদ নেই। পুরো সিস্টেম একটা সিন্ডিকেটে হয়ে গেছে। অনেকেই হয়তো চাইলেও এই সিন্ডিকেট থেকে বের হতে পারছেন না। আবার অনেকে ইচ্ছা করেই বের হতে চাইছেন না। এত সহজে অনেক টাকা উপার্জনের সুযোগ সহজে কেউ হাতছাড়া করতে চাইবেন না, এটাই স্বাভাবিক।

এসব দুর্নীতি ও অপকর্ম রোধ করা যাঁদের দায়িত্ব, সেই আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী নিজেই কতটা নৈতিক অবস্থানে আছে, বর্তমানে তা সহজেই অনুমেয়। সুতরাং নীতিহীন এই কর্মকাণ্ডগুলো প্রতিরোধ বা নির্মূল করা সম্ভব নয়। তাই বলে সমাজে কি ভালো মানুষ নেই? আছে, তবে দিন শেষে ভালো মানুষগুলোও এ ধরনের দুর্নীতির শিকার।

কোন কোন ক্ষেত্রে ভালো কাজ হচ্ছে না তা কিন্তু নয়। তবে বর্তমানে দুর্নীতির যে অবাধ বিচরণ ও অস্থিরতা, মনুষ্যত্বের বিপর্যয়ের যে উচ্চমাত্রা, তা এই অল্পসংখ্যক ভালো কাজ দিয়ে পুনরুদ্ধার করা সম্ভব নয়। শক্ত আইন প্রণয়ন ও কোনো রকম পক্ষপাতদুষ্ট না হয়ে সঠিকভাবে বাস্তবায়নই পারবে উত্তরণের পথ দেখাতে।

ব্যক্তিজীবনেও আমাদের অনেক কিছু করণীয় আছে। আইন করেই সবকিছু বন্ধ করা যাবে না। আমাকে, আপনাকে সচেতন হতে হবে, নীতিবিরুদ্ধ কাজ করা থেকে নিজেকে সংবরণ করতে হবে। নিজের পরিবারের আয়-উপার্জন সঠিক পথে কি না, দুর্নীতি হয়েছে কি না, খেয়াল রাখুন। আপনার স্বামী/স্ত্রীর অবৈধ সম্পর্ক যেমন মেনে নিতে পারেন না, অবৈধ আয়-উপার্জন/অনৈতিক কাজকেও ঠিক সেভাবে ঘৃণা করুন এবং সেটিকে সমর্থন করা বন্ধ করুন। নিজেকে সংশোধন করুন, নিজের পরিবারকে দুর্নীতি ও নৈতিক অবক্ষয় থেকে দূরে রাখুন,তাহলেই সম্ভব।

আপনি নিজের যে কাজের জন্য মাসিক বেতন নেন, সেই কাজটি ঠিকমতো করুন। অন্যকে বিপদে ফেলার মতো, দুর্নাম করার মতো ঘৃণ্য কাজ করা থেকে বিরত থাকুন। ভালোকে ভালো বলতে শিখুন, খারাপকে খারাপ বলার মতো সৎসাহস রাখুন। নিজের অবস্থান থেকে নৈতিকতাকে আগলে রাখুন।

সবাই যদি নিজের কাজটি সঠিকভাবে করি, তাহলেই নৈতিকতার অবক্ষয় রোধ করা সম্ভব। সমাজের এবং করপোরেট দুনিয়ার অন্যায় ও দুর্নীতি প্রতিরোধ করা সম্ভব হবে। নিজে না করে অন্যকে সকাল-বিকেল দোষারোপ করে কোনো সমাধান হবে না। শিক্ষাক্ষেত্রের পবিত্রতা রক্ষা করা, আইনকে নিয়মানুযায়ী প্রয়োগ করা, অর্থাৎ কোনো প্রকার দুর্নীতির আশ্রয় না নিলেই কেবল এই পরিস্থিতির উন্নয়ন সম্ভব। এমন নয় যে আমরা বিবেকহীন, নীতিহীন, আদর্শবিহীন এক লোভী মানুষে পরিণত হয়েছি; যা থেকে আমরা নিজেরাই সরে আসতে চাই না?

মিনা বুলবুল হোসেন
হেড অফ জোন-৪
বীকন ফার্মাসিউটিক্যালস লিমিটেড।
বি এসসি অনার্স, এম এসসি(রসায়ন),এম এস (সাপ্লাই চেইন ম্যানেজমেন্ট)

এমবিএ মার্কেটিং,এমপিএইচ ও HRMC, Faculty of IBA(সান্ধকালিন)
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।

মিনা বুলবুল হোসেন
জোনাল হেড,বীকন ফার্মাসিউটিক্যালস লিমিটেড।