মমতাজ বেগম বাংলাদেশের একমাত্র শিল্পী যিনি রিক্সা গ্যারেজ থেকে সচিবালয় সবখানে পৌঁছাতে পেরেছেন, এই বাংলাদেশে এমন ঘর খুব কম যেখানে টিভিতে মমতাজের গান শুরু হলে চ্যানেল পরিবর্তন হয়। মমতাজকে সাম্প্রতিক সময়ে ভারতের একটি বিশ্ববিদ্যালয় সম্মানসূচক পিএইচডি দিয়েছে, তারপর থেকে ফেসবুকে ট্রল শুরু হয়েছে মমতাজকে নিয়ে।

সন্দেহ নেই ভারতীয় বিশ্ববিদ্যালয়টি আসলে নামহীন গোত্রহীন কিন্তু মমতাজ যে সম্মানসূচক ডক্টরেট ডিজার্ভ করেন সে বিষয়েও সন্দেহ থাকা উচিত না। ফেসবুকে অনেকে মমতাজের শিক্ষাগত যোগ্যতা নিয়ে ট্রল করেছেন, এও সত্য যে মমতাজের প্রথাগত শিক্ষার ডিগ্রি নেই। তবে সেই সাথে মনে রাখতে হবে মমতাজ শৈশবে তার বাবা মধু বয়াতির কাছে গান শিখেছেন, পরবর্তীতে গান শিখেছেন লোকসংগীতের দুই কিংবদন্তি মাতাল রাজ্জাক দেওয়ান ও আব্দুর রশীদ বয়াতির কাছে। বাঙালি ভুলে যায় জ্ঞানের কোনো ডিগ্রি হয় না, জ্ঞান সীমাহীন, ডিগ্রি হয় প্রথাগত বিদ্যাশিক্ষার যেটা চাকরির প্রয়োজনে কাজে লাগে।

এন্ট্রান্স পাশ শরৎচন্দ্রকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ডি.লিট দিয়েছে গত শতকের ছত্রিশ সালে, তখন কেউ তার শিক্ষাগত যোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন তোলেনি। এই দেশের জাতীয় কবি যাকে বানানো হয়েছে সেই নজরুল ইসলাম এন্ট্রান্স পর্যন্তও পৌঁছাতে পারেননি। এই দেশে হাজার হাজার মাস্টার্স পাশ লোক আছে যারা একটি কবিতা বা গান বলতে পারবেন না, জীবনে হয়তো একটি কবিতা তিনি মন দিয়ে পড়েননি বা ভালো করে শোনেননি একটি গান।

রাজনীতিতে মমতাজের সক্রিয় হওয়া নিঃসন্দেহে বাংলা গানের জন্য অপূরণীয় ক্ষতি, রাজনীতির ময়দানে উনি না গেলে হয়তো আমাদের লোকগান আরো অনেক কিছু পেতো তার কাছ থেকে। মমতাজ বেগম সাতশোর বেশি একক এলবাম প্রকাশ করেছেন, যা গিনেজ বুকে রেকর্ড তালিকায় স্থান করে নিয়েছে। প্রকাশিত এলবামগুলোর অন্তত অর্ধেক হয়েছিলো সুপারহিট, গ্রামেগঞ্জে মুড়ি-মুড়কির মতো বিক্রি হয়েছে এসব এলবাম। সিনেমার গান গেয়ে মমতাজ একাধিকবার পেয়েছেন জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার। মমতাজ বেগম এমপি হওয়াতে বাংলা গান তার দরাজ গলা থেকে যেমন বঞ্চিত হয়েছে তেমনি বৃহদার্থে বাংলা গান চর্চার লাভ হয়েছে বিস্তর। শরিয়ত বয়াতিকে যখন গ্রেপ্তার করা হলো তখন সংসদে সবচেয়ে তীব্র প্রতিবাদ জানিয়েছিলেন মমতাজ, বাউলদের উপর দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে হামলার ঘটনায় বরাবর সোচ্চার থেকেছেন মমতাজ বেগম, এইদেশে লোকসংস্কৃতি টিকিয়ে রাখার লড়াইয়ে মমতাজ মোটামুটি এক নিঃসঙ্গ শেরপা। মানিকগঞ্জ অঞ্চলে যারা একসময় ঢোল-তবলা বিক্রি করে গান ছেড়ে অন্য পেশায় চলে গিয়েছিলো তাদের বড় একটা অংশ আবার গানে ফিরে এসেছে মমতাজের আহবানে। গান এই শিল্পীদের ভাত-কাপড়ের নিশ্চয়তা দিচ্ছে, কোনো কোনো শিল্পী এখন একলাখ টাকা বায়না পায় এক রাতের গানের আসরের জন্য, এই অঞ্চলে লোকসংগীতের পুনর্জাগরণে স্পষ্টত মূল পৃষ্ঠপোষকতা মমতাজ বেগমের। সাম্প্রতিক অতীতে আমরা দেখেছি ইংরেজি মাধ্যমে পড়ে আসা উচ্চশিক্ষিত ছেলেমেয়েরা জঙ্গীবাদে সম্পৃক্ত হচ্ছে, এর বাইরে দেশের উচ্চশিক্ষিত যুবকদের একটি অংশ সমর্থন দিচ্ছে মৌলবাদী রাজনীতিকে, এই বিষয়গুলো আমাদের জাতীয় নিরাপত্তার জন্য হুমকি। জঙ্গীবাদ মোকাবেলায় আমাদের আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ভূমিকা প্রশংসনীয়, তবে আমাদের ভূখণ্ডে জঙ্গীবাদ/মৌলবাদ কখনো যে শক্তভাবে মাথা তুলে দাঁড়াতে পারেনি তার মূল কারণ আমাদের সাংস্কৃতিক প্রতিরোধ, জঙ্গীবাদ মাথা তুলে দাঁড়াতে পারেনি কেননা শহুরে নাকউঁচু এলিটদের ভাষায় ‘অশিক্ষিত’ ও ‘গ্রাম্য’ মমতাজের মতো হাজার হাজার শিল্পী গ্রামে গ্রামে ঘুরে গেয়েছেন ‘যদি আল্লার সন্ধান চাও গো প্রেম রাখিও অন্তরের ভিতর’। মৌলবাদীদের ঘৃণার চাষাবাদের সাথে পাল্লা দিয়ে গ্রামেগঞ্জে মমতাজের মতো শিল্পীরা প্রেম ও সহমর্মিতার বীজ বপন করে চলেছে বলেই এদেশটা এখনো মানুষের আছে। আমাদের শহুরে শিক্ষিত ছেলেমেয়েরা আজকাল মৌলবাদে আকৃষ্ট হচ্ছে কারণ আমাদের শেকড়ের সাথে তাদের যোগাযোগ কম, বাংলার বাউলের একতারা তাদের কানে পৌঁছায় না। জারি সারি ভাওয়াইয়া মুর্দিশি মারেফতি ভাটিয়ালি ইত্যাদি লোকসংগীতের নানাবিধ রত্ন আমাদের নতুন প্রজন্মের কাছে পৌঁছে দিতে আমাদের দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে উঠে আসা আরো অন্তত দশজন মমতাজ দরকার। মমতাজের উঠে আসার লড়াই খুব সহজ ছিলো না, দরিদ্র বাবার সন্তান ছিলেন, পাটুয়াটুলির ক্যাসেট সিন্ডিকেট তার গান বিক্রি করে কোটিপতি হয়েছে কিন্তু তার হাতে পৌঁছেছে নামমাত্র পয়সা, এইদেশের কপট এলিটশ্রেণি নানান সময়ে তাকে অপমান অপদস্থ করেছে ‘গ্রাম্য, অশিক্ষিত, অশ্লীল’ ইত্যাদি অপবাদ দিয়ে, কিন্তু মমতাজ কখনো থেমে যাননি। বাংলা গানের সৌভাগ্য যে মমতাজ থামেননি।
রাজনীতির মমতাজ নিয়ে দ্বিমত থাকতেই পারে, রাজনীতি বিষয়টি মূলত বিভিন্ন মতের লড়াই, রাজনীতিতে গণতান্ত্রিক ও গঠনমূলক ভিন্নমত আখেরে দেশের জন্য ভালো। তবে বাংলা লোকসংগীতে মমতাজের যে অবদান তা অনন্য, এ বিষয়ে ভিন্নমত থাকার অবকাশ নেই, গত তিন দশকে বাংলা লোকগানকে তিনি অনন্য উচ্চতায় নিয়ে গিয়েছেন। বাঙালির একটি প্রবণতা আছে গুণী লোকদের যথাযথ সম্মান না করার, সম্ভবত এই কারণেই এদেশে গুণী লোকের সংখ্যা কম। আফসোসের বিষয় এই যে মমতাজ বেগমকে সম্মানসূচক ডক্টরেট ভারত থেকে পেতে হলো। অথচ এইদেশে সাতচল্লিশটি সরকারি বিশ্ববিদ্যালয় আছে, বাঙালির সংস্কৃতি রক্ষায় তারা নানাবিধ হাতিঘোড়া মারেন, বাঙালির সংস্কৃতি গবেষণা ও বাঁচিয়ে রাখার নামে বহু ক্লান্ত গর্দভকে বিশ্ববিদ্যালয়গুলো মূলা খাবার সুযোগ করে দিয়েছে। আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর শুভবুদ্ধির উদয় হোক এই কামনা করি, আমাদের গুণী লোকেরা আমাদের দেশে সম্মান লাভ করুক।

সংগৃহীত পোস্ট;
মুল লেখা : নাজমুল হাসান নাঈম।
সংশোধন ও সংযোজন : জেমস আব্দুর রহিম রানা, গণমাধ্যমকর্মী।