গাজী কালু ও চম্পাবতী
গাজী আর কালু দুই ভাই, অচিনপুর রাজ্যে ছিল তাদের বাস। বহু সাধ্য সাধনা করে গাজী পীর অতিমানবীয় গুণ অর্জন করিল। গাজী পীরের ক্ষিপ্রতার সাথে কেহই পারিয়া উঠিত না। হঠাৎ একদিন গোপালপুরের রাজকন্যা চম্পাবতীকে দেখিয়া গাজী প্রেমে পড়িয়া গেলেন, রাজকুমারীরও চটপটে গাজী বাবাকে দেখিয়া খুব পছন্দ করিলেন; কিন্তু শর্ত দিলেন, গাজী পীরকে কঠিন সব অভিযান সম্পন্ন করিতে হবে। এ রকম সাধারণ প্রেমের গল্প হলেও তাদেরকে নিয়ে রহস্যের শেষ নেই। আসুন তাদের ব্যাপারে কিছু বলি।
গাজী কালু ও চম্পাবতী মধ্যযুগের পাঁচালি**
কাব্যের আদর্শে রচিত পীরসাহিত্য। ব্যাঘ্রশঙ্কুল দক্ষিণ বঙ্গে গাজী পীরের প্রভাব বিস্তার ও মাহাত্ম্য প্রচার এ কাব্যের উপজীব্য। ব্যাঘ্রদেবতা দক্ষিণ রায়ের প্রতিপক্ষরূপে গাজী পীরের প্রথম বিবরণ পাওয়া যায় কৃষ্ণরাম দাসের রায়মঙ্গল (১৬৮৪) কাব্যে। এতে প্রথমে তাদের মধ্যে বিরোধ ও পরে বন্ধুত্ব দেখানো হয়েছে। এক সময় দক্ষিণ বঙ্গীয় সমাজে উভয়ের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠিত ও পূজা প্রচারিত হয়। রায়মঙ্গলের কাহিনী নিয়ে গাজী কালু ও চম্পাবতী কাব্য রচনা করেন শেখ খোদা বখশ ১৭৯৮-৯৯ সালে। এতে গাজী-কালুর ফকিরবেশে দেশভ্রমণ, জনৈক হিন্দু রাজার সঙ্গে গাজীর যুদ্ধ, যুদ্ধে রাজার পরাজয় ও ইসলাম ধর্ম গ্রহণ, গাজী কর্তৃক প্রজাদের দুঃখ-দারিদ্র্য মোচন, ব্রাহ্মণনগরের মটুক রাজার সঙ্গে গাজীর যুদ্ধ, যুদ্ধে রাজার পরাজয় ও ইসলাম ধর্ম গ্রহণ, রাজকন্যা চম্পাবতীর সঙ্গে গাজীর বিবাহ, পরিশেষে সকলকে নিয়ে গাজীর গৃহে প্রত্যাবর্তন ও সুখে জীবন যাপনের ঘটনা বর্ণিত হয়েছে। এসবের পাশাপাশি কাব্যে আরও কিছু উপকাহিনী রয়েছে। গাজী আল্লাহ্, খোয়াজ-খিজির ও গঙ্গাদেবীর সহায়তায় সর্বত্রই বিজয়ী বীর হিসেবে এ কাব্যে চিত্রিত হয়েছেন।
গাজীর পরিচয় ও জীবন কাহিনী :
“গাজী” প্রকৃত নাম নয়, ইহা ধর্মীয় উপাধি । ইহার অর্থ মুজাহেদ বা ধর্মযুদ্ধে বিজয়ী বীর, অর্থৎ বিধর্মীদের সাথে যুদ্ধ করে যিনি জয়লাভ করেন, তিনিই ‘গাজী’ নামে সম্মানীত হন। পাঠান আমলে এ ধরনের বহু ‘গাজী’ তাঁদের দুর্জয় শক্তি দ্বারা এদেশে প্রভাব ও প্রতিপত্তি বিস্তার করতে সক্ষম হন। এখানে আলোচ্য গাজীও এমন একজন দুর্জয় শক্তি ও আধ্যাত্নিক ক্ষমতাসম্পন্ন ব্যাক্তি ছিলেন। তাঁর প্রভাব ও প্রতিপত্তিতে দক্ষিণ অঞ্চল অর্থাৎ ভাটি অঞ্চলে ইসলাম বিস্তার লাভ করে। ইতিহাস ও পৌরাণিক কাহিনীখ্যাত গাজী ও কালুর নাম এতদাঞ্চলে সর্বজন বিদিত। ধর্মমত নির্বিশেষে সকলেই গাজীর নামে শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করে থাকেন। এককালে গাজী তাঁর দুর্জয় শক্তিদ্বারা এমন অভাবনীয় পরিবেশ সৃষ্টি করেছিলেন যে, সমগ্র দেশ গাজীময় হয়ে উঠেছিল। এদেশের বিভিন্ন স্থানে গাজীর দরগা, হাজীর আস্থানা ও গাজীর মাজার দেখা যায়। বহু স্থানের নামকরণও গাজীর নামানুসারে হয়েছে : যেমন – গাজীরহাট, গাজীপুর,
গাজীরজঙ্গল(রাস্তা),গাজীরবাজার, গাজীরখাল, হাজীরভিটা, গাজীরপাড়া, গাজীডাঙ্গা প্রভৃতি। এক সময় এতদাঞ্চলে গাজীর গীতের খুব প্রচলন ছিল। যে হাজীর নাম স্মরণ করলে বনের হিংস্র বাঘ মাথা নত করে, পানির কুমীর মুখ ফিরিয়ে চলে যায়, সে গাজীর জীবন বৃত্তান্ত আজও রহস্যময় হয়ে আছে।
গাজী কালু ও চম্পাবতী কাব্য দ্বারা পরবর্তীকালের কবিরা বিশেষভাবে প্রভাবিত হয়েছেন। তাই কিছু পাত্র-পাত্রী, স্থান ও ঘটনার নাম পরিবর্তন করে মূল কাহিনী অবলম্বনে পরবর্তীকালে সৈয়দ হালু মীর, আবদুর রহিম, আবদুল গফুর প্রমুখ অনুরূপ কাব্য রচনা করেন। শেখ খোদা বখশ ছিলেন রংপুরের বোগদহের অধিবাসী, কিন্তু তাঁর কাব্যের লৌকিক সংস্করণ ‘চম্পাবতী কইন্যার পালাগান’ বা ‘গাজী সাহেবের গীত’ বাংলার নানা অঞ্চলে প্রচলিত আছে। এতে এ কাব্যের জনপ্রিয়তা প্রমাণিত হয়।
দেব, নর, দৈত্য, জীন, পরী, ভূত-প্রেত, জীব-জন্তু সম্বলিত ও মর্ত্য-পাতাল-অন্তরীক্ষের পটভূমিতে রচিত এ কাব্য-কাহিনী সম্পূর্ণই কাল্পনিক। গাজীর মানত-শিরনি করলে বাঘের উপদ্রব থেকে রক্ষা পাওয়া যায় এ বিশ্বাস কাব্যমধ্যে প্রতিফলিত। এই শ্রেণির কাব্য রচনার পেছনে তখনকার ভারতবর্ষের রাজনৈতিক চিন্তা-ভাবনা ক্রিয়াশীল ছিল বলে মনে করা হয়। উনিশ-বিশ শতকের উপনিবেশিক যুগে পরাজিত শক্তি হিসেবে বাংলার মুসলমানগণ এরূপ কাব্য রচনা ও পাঠ করে ইসলামের অতীত গৌরবে পুলক ও আত্মশ্লাঘা অনুভব করতেন।
“সুন্দরবনের ইতিহাস” লেখক- আব্দুল জলিল সাহেবের মতে বারোবাজারের নিকটবর্তী বেলাট ছিল বৈরাট নগরের একাংশ। গাজীর স্মৃতিচারণ এই অঞ্চলের অধিকাংশ লোকে করে থাকেন। গাজী তাই ঐতিহাসিক ব্যক্তি। গাজীর কবর আছে হবিগঞ্জ জেলার (সাবেক সিলেট জেলার অন্তর্গত) বিশাগাঁও গ্রামে। চম্পাবতীর কবর আছে সাতক্ষীরা জেলার লাবসা গ্রামে। আবার ঝিনাইদহ জেলার বারোবাজারেও গাজী-কালু ও চম্পাবতীর মাজার আছে। বিভিন্ন জায়গায় একই ব্যক্তির মাজার থাকায় ঐতিহাসিকদের মধ্যে বিভ্রান্তি হওয়া স্বাভাবিক। কিন্ত বারোবাজারের নিকটবর্তী বাদুরগাছা মৌজায় গাজী-কালু ও চম্পাবতীর মাজার(কবর) বিস্মৃত হবার নয়।
গাজীর আসল পরিচয় সম্পর্কে ঐতিহাসিকদের মধ্যে মতদ্বৈততা আছে। প্রমাণ্য তথ্যের অভাবে গাজীর জন্ম-বৃত্তান্ত সস্বন্ধে এখনো সঠিক সিদ্ধান্তে উপণীত হতে পারেননি গবেষক ও ঐতিহাসিকরা। তাঁর জীবনের নানা ঘটনা অবতারণা করে কেহ কেহ বলেন, গাজীর অভ্যুদয় ঘটে পঞ্চদশ শতাব্দীর শেষভাগে। যশোর জেলার ঝিকরগাছা সংলগ্ন ব্রাক্ষণনগরের রাজা মুকুটরায়ের রাজত্বকালে গাজী ইসলাম প্রচারে আবির্ভূত হন দক্ষিনবঙ্গে। আবার অনেকে মনে করেন মধ্যযুগে সুলতান রুকুনউদ্দীন বরবক শাহ্ (১৪৫৯-১৪৭৪ খৃ:) প্রধান সেনাপতি ছিলেন এ গাজী।
তিনি সেনাপতি হিসাবে আসাম ও বাংলার বিভিন্ন অভিযানে অংশ নেন। তিনি ছিলেন একজন ধার্মিক বুজুর্গ ব্যক্তি। যোদ্ধা ও দরবেশ হিসাবে তাঁর খ্যাতি ছিল। তিনি জনগণের নিকট অলৌকিক ক্ষমতাসম্পন্ন ‘পীর’ বলে পরিচিত ছিলেন। ঝিনাইদহ অঞ্চলে গাজী-কালু ও চম্পাবতী সম্পর্কে নানা ধরনের জনশ্রুতি প্রচলিত আছে। দক্ষিণবঙ্গে খানজাহান আলীর আবির্ভাবের পূর্বে গাজীর আবির্ভাব হয় এ কথা অধিকাংশ গবেষকের ধারনা। গাজীর স্মৃতিচারণ এ অঞ্চলের অধিকাংশ লোকে করে থাকে।
বারোবাজারের বাদুরগাছা মৌজায় অবস্থিত গাজী-কালু ও চম্পাবতীর মাজার সব সম্প্রদায়ের লোকের নিকট একটি পবিত্র পীঠস্থান স্বরুপ। হিন্দু ও মুসলিম সম্প্রদায়ের মানুষ মনোবাসনা পূরন ও রোগ-ব্যাধি হতে নিরাময় লাভের মানসে এ মাজারে মান্নত করে ও শিন্নী দেয়। শ্রীরাম রাজার বেড় দীঘির দক্ষিণ পাশে গাজী-কালু ও, চম্পবতীর মাজার বিদ্যমান । মাজার সন্নিহিত দক্ষিণ-পশ্চিমে একটি প্রাচীন বটগাছ আছে।
এই বটগাছের তলদেশে একটি শূণ্যস্থান দেখা যায়। এটিকে অনেকে কূপ কিংবা অন্য কোন কবর বলে মনে করেন। ১৯৯২ সালে ঝিনাইদহ জেলা প্রশাসন কবর তিনটি বাঁধাই করে বেষ্টনি প্রাচীর নির্মাণ ও খাদেমদের থাকার জন্য সেমিপাকা টিন শেড তৈরী করে দিয়েছেন। গাজী কালু চম্পাবতীর সাথে দক্ষিণ রায়ের কবরও এখানে রয়েছে বলে শোনা যায় ।
পুথিতে উল্লেখ্য গল্পের সার-সংক্ষেপ
বৈরাট নগরের শাহ্ সেকেন্দারের পুত্র এই “গাজী”। মাতার নাম অজুপা সুন্দরী।তিনি ছিলেন বলি রাজার কন্যা। অজুপা সুন্দরীর এক পালিত পুত্রের নাম “কালু”। গাজী-কালু উভয়েই সিদ্ধপুরুষ। শৈশবকাল হতেই গাজী ছিলেন সংসারের প্রতি বৈরাগ্য ও উদাসীন। ফকিরী জীবনের প্রতি ছিল তাঁর প্রগাঢ় অনুরাগ। সংসারের মোহ ত্যাগ করে গাজী একদিন ফকিরীর বেশে কালুকে সঙ্গে নিয়ে নিরুদ্দেশের পথে বের হন। অনেক পথ-প্রান্তর পাড়ি দিয়ে তাঁরা ভাটি অঞ্চলে সুন্দরবনে (বাদাবনে) এসে উপস্থিত হন।
তাঁদের অসাধারন আধ্যাত্নিক শক্তির প্রভাবে বনের হিংস্র বাঘ ও পানির কুমীর পর্যন্ত বশীভূত হয়ে যায়। ছাপাইনগরে শ্রীরাম রাজার দেশে কোনো মুসলমান বাসিন্দা না থাকায় গাজী তথায় ইসলাম প্রচার শুরু করেন। বারোবাজারের সন্নিকটে হাসিলবাগে শ্রীরাম তাঁতী, গাজীর অনুগ্রহে ধনী হয়ে যান। এখানে তিনি জামালগোদা নামক এক ব্যক্তির গোদরোগ আরোগ্য করে বিশেষ খ্যাতি অর্জন করেন। গাজীর প্রচেষ্টায় বারোবাজারের বহু হিন্দুৃ ও বৌদ্ধ মুসলমান ধর্ম গ্রহন করেন।
তিনি ছাপাইনগরে একটি মসজিদ প্রতিষ্ঠা করেন। এই ছাপাইনগর বারোবাজারের একাংশ। গাজী-কালু ইলামের বিজয় পতাকা উড্ডায়ন করেছেন তদানিন্তন দক্ষিণ বাংলায়। তাদের স্মৃতি বুকে ধারন করে আজও নিথর হয়ে আছে বারোবাজার। অত:পর গাজী-কালু দুই ভাই সোনারপুর ও ব্রাক্ষণনগরে রাজা মুকুট রায়ের দেশে যান এবং সেখানে ইসলাম প্রচার শুরু করেন।রাজা মুকুট রায় ছিলেন একজন সামন্ত ভূস্বামী বা জমিদার। রাজা মুকুট রায়ের সাতপুত্র ও এক কন্যা ছিলেন। কন্যার নাম চম্পাবতী।
চম্পাবতী ছিলেন পরমা সুন্দরী। ফকীর গাজী চম্পাবতীর রুপে মুগ্ধ হয়ে তাকে বিবাহ করার প্রস্তাব দিয়ে কালুকে রাজা মুকুটরায়ের দরবারে প্রেরণ করেন। গাজীর সাথে চম্পাবতীর বিবাহের প্রস্তাব করায় রাজা মুকুটরায় ক্রোধান্বিত হয়ে কালুকে বন্দী করেন। ফলে গাজীর সাথে মুকুটরায়ের যুদ্ধ অবশ্যম্ভাবী হয়ে ওঠে। গাজীর ছিল অসংখ্য বাঘ্য সৈন্য।
বাঘ্র সৈন্যসহ গাজী মুকুটরায়ের রাজধানী আক্রমণ করেন। প্রবাদ আছে যে, গৌড়ের সুলতান হোসেন শাহ্ও (১৪৯৩-১৫১৯ খৃ:) গাজীকে সৈন্য দিয়ে এ সময় সাহায্য করেছিলেন। মুকুটরায়ের রাজধানী ব্রাক্ষণনগর সংলগ্ন “খনিয়া” রণক্ষেত্রে গাজীর সাথে মুকুটরায়ের যুদ্ধ হয়। এই যুদ্ধে মুকুটরায়ের সেনাধ্যক্ষ ছিলেন দক্ষণরায়। তিনি প্রধান সেনাপতি হিসাবে মুকুটরায়ের পক্ষে যুদ্ধ করেন। কুমীর নিয়ে দক্ষিণরায় গাজীর বিরুদ্ধে যুদ্ধে অবতীর্ন হন। কিন্ত ডাঙ্গায় কুমির কি বাঘ্রের সঙ্গে পারে ?
শেষ পর্যন্ত সেনাধ্যক্ষ দক্ষণরায় গাজীর অদ্ভুত রণ-কৌশলে যুদ্ধে পরাস্ত হন,এবং দক্ষণরায়কে তিনি বেঁধে রাখেন। এ সংবাদ শুনে রাজা মুকুটরায় স্বয়ং অসংখ্য সৈন্য নিয়ে যুদ্ধক্ষেত্রে উপস্থিত হন। সাতদিন তুমুল লড়াইয়ের পর রাজা মুকুটরায় গাজীর নিকট পরাজয় বরণ করতে বাধ্য হলেন। উপায়ান্তর না দেখে রাজমহিষী ও অন্যান্য মহিলারা নিরুপায় হয়ে মৃত্যুঞ্জীব কুপে জীবন বিসর্জন দিলেন।
রাজধানীর অভ্যন্তরে শীতল মন্দিরে রাজা মুকুটরায় আত্মহত্যা করেন। রাজ সভাসদ ও দৈবজ্ঞ্যগণ পৈতা ছিড়ে কালিমা পড়েন এবং ঝুটি কেটে মুসলমান হন। গাজী অধিকার করেন রাজপ্রাসাদ। চম্পাবতীও ইসলাম ধর্ম গ্রহন করে গাজীর সাথে পরিণয়সূত্রে আবদ্ধ হন। চম্পাবতীকে নিয়ে গাজী-কালু ব্রাক্ষণনগর ত্যাগ করেন এবং বৈরাটনগরে পৌঁছান।ইহায় ছিল পুঁথির উপজীব্য বিষয়।
দৈনিক কলম কথা সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।