“পচাব্দী গাজী, (মানুষখেকো বাঘের যম; ভাগ্য বিড়ম্বিতদের এক অনন্য বন্ধু!
পৃথিবী বিখ্যাত শিকারী, শ্যামনগরের পচাব্দী গাজীর ঐতিহাসিক বন্দুক,, এই বন্দুক দিয়ে তিনি ৫৭ টি বাঘ হত্যা করেছিলেন। ১৯৯৯ সালে আমি, আবৃত্তি শিল্পী ও ছোট গল্পকার মনিরুজ্জামান ছট্টু, টিটু ও প্রিন্স এই শিকারীর বাড়িতে গিয়েছিলাম।
সাতক্ষীরার শ্যামনগর উপজেলার সোরা গ্রামে ছিল তাঁর বাড়ি। স্বল্পশিক্ষিত মানুষটি ছিলেন রোগা-পাতলা। মোট ৫৭টি রয়েল বেঙ্গল টাইগার শিকার করে তিনি সুন্দরবনের ইতিহাস হয়েছেন। শ্রেষ্ঠ শিকারির খেতাব নিয়ে ১৯৯৭ সালে মারা যান পচাব্দী। সুন্দরবনের নিকটবর্তী গাবুরা ইউনিয়নের গ্রাম সোরা। এই গ্রামের শিকারি পরিবারে ১৯২৪ সালে পচাব্দী গাজী জন্মগ্রহণ করেন। বাবা মেহের গাজীও বাঘ শিকারি ছিলেন। বাঘ শিকার করেছেন দাদা ইসমাইল গাজীও। বাবা-দাদা দুজনই বাঘের আক্রমণে মারা যান।
১৭ বছর বয়সে খাতায় নাম তুলেছেন
বাঘের চেয়েও তীক্ষ্ণ ছিল তাঁর চোখ। রক্ষা করেছেন সুন্দরবন এলাকার শত শত মানুষের প্রাণ। সরকারের বৈধ শিকারির সার্টিফিকেট নিয়ে তিনি মানুষখেকো বাঘ হত্যা করে গ্রামের পর গ্রাম আনন্দের জোয়ারে ভাসিয়েছেন। আবিষ্কার করেছেন নতুন নতুন শিকারের কৌশল। সুন্দরবনের গভীর জঙ্গলে হাঁটতে হাঁটতে পচাব্দী গুলি ছুড়ে বাঘ হত্যা করেছেন। আবার টোপ ফেলে গাছের মগডালে বসে বাঘ মেরেছেন। বাঘ মেরেছেন নদী ও খালের পারে। কয়েকবার বাঘের খপ্পরেও পড়েছেন। তাৎক্ষণিক বুদ্ধিমত্তা আর সাহসের কারণে বেঁচে গেছেন। ১৯৪১ সালে মাত্র ১৭ বছর বয়সে ‘গোলখালির সন্ত্রাস’ নামে পরিচিত মানুষখেকো বাঘ হত্যা করে বাঘ শিকারির খাতায় নাম লেখান। এরপর একের পর এক বাঘ হত্যা করে রেকর্ড গড়েছেন। প্রাথমিক পর্যায়ে তিনি বন বিভাগের কর্মকর্তাদের সহযোগী হিসেবে বাঘ শিকার করলেও ১৯৫৫ সালের দিকে তিনি বনরক্ষীর চাকরি পান। এই চাকরি পাওয়ার পর তিনি বন কর্মকর্তা ও সুন্দরবন এলাকার গ্রামগঞ্জের সাধারণ মানুষের প্রাণ রক্ষা করেছেন।
আঠারোবেকির সন্ত্রাস
পচাব্দী গাজী সুপতির মানুষখেকো, গোলখালির মানুষখেকো, দুবলার চরের মানুষখেকো, লক্ষ্মী খালের মানুষখেকো, আঠারোবেকির মানুষখেকো বা তালপট্টির মানুষখেকো বাঘ হত্যা করেছেন। তালপট্টির সন্ত্রাস নামে খ্যাত ৫৭তম বাঘ শিকারের মাধ্যমে তাঁর শিকার জীবনের পরিসমাপ্তি ঘটে। তাঁর উল্লেখযোগ্য শিকার হচ্ছে আঠারোবেকির সন্ত্রাস।
১৯৬৬ সালে আঠারোবেকির বাঘটিকে মানুষখেকো ঘোষণা দেওয়া হয়। পচাব্দী গাজী পান শিকারের দায়িত্ব। কিন্তু বাঘের দেখা মেলে না। এর মধ্যে একদিন ছয়জন বাওয়ালি কাঠ কাটার জন্য সুন্দরবনে প্রবেশ করলে হঠাৎই মানুষখেকো বাঘটি এক বাওয়ালিকে ধরে নিয়ে যায়। বাওয়ালিরা বাঘের পিছু নেয়। সঙ্গীকে উদ্ধারের চেষ্টা চালায়। একপর্যায়ে বাঘটি রক্তাক্ত সঙ্গীকে ফেলে পালিয়ে যায়। কিন্তু কয়েক মিনিটের মধ্যে সব শেষ। সঙ্গীর লাশ নিয়ে বাকি পাঁচজন বাওয়ালিকে ফিরতে হয়। রক্তের স্বাদ পাওয়া মানুষখেকোর মাথা তখন গরম। সে শিকার খুঁজতে থাকে। ফুলখালী এলাকায় একটি গোলের নৌকায় ঘুমিয়ে ছিল কয়েকজন বাওয়ালি। গভীর রাতে ওই মানুষখেকো বাঘ নদী সাঁতরে এসে নৌকার ভেতর থেকে এক বাওয়ালির ঘাড় কামড়ে নিয়ে যায়। সকালে উদ্ধার করা হয় ওই বাওয়ালির লাশ। লাশের কিছু অংশ বাঘটি খেয়ে ফেলেছিল। কিছু অংশ ছিল। এক দিনে দুটি মানুষ খাওয়ার ঘটনায় পচাব্দী গাজীর মধ্যে উত্তেজনার সৃষ্টি হয়। তিনি ঘটনাস্থলে আসেন। পায়ের ছাপ পর্যবেক্ষণ করে আকার-আকৃতি অনুমান করার চেষ্টা করেন। নিশ্চিত হন বাঘটি মানুষের বাকি মাংস খাওয়ার জন্য ফের আসবে। পচাব্দী একটি খালের পাশে বন্দুক উঁচিয়ে বসে থাকেন। সেখানে কোনো বড় গাছ ছিল না। তিনি বাঘিনীর মতো ডাক দিয়ে উন্মত্ত বাঘটিকে মিলনের আহ্বান জানান। বাঘ ফাঁদে পা দেয়। সে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে এদিক-ওদিক তাকিয়ে মানুষের রক্ত-মাংস ভক্ষণ করে ভরা পেটে হেলেদুলে এগিয়ে আসতে থাকে। পচাব্দী বন্দুকের ‘মাছিতে’ চোখ রাখেন। বাঘটি রেঞ্জের মধ্যে আসার সঙ্গে সঙ্গে ট্রিগার টেপেন। হুংকার ছেড়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়ে আঠারোবেকির সন্ত্রাস। মৃত্যু নিশ্চিত করার জন্য আরো একটি গুলি ছোড়েন পচাব্দী। এর পর পরই পূর্ব পাকিস্তান সরকার পচাব্দী গাজীকে ‘সনদ-ই-খেদমত’-এ ভূষিত করে।
ইতিহাস থেকে
বাঘ হত্যার ইতিহাস ঘাঁটাঘাঁটি করে দেখা যায়, ১৬১৭ খ্রিস্টাব্দে সম্রাট জাহাঙ্গীর ৮৭টি বাঘ শিকার করেন। ওই বছর স্বামীর সঙ্গে পাল্লা দিয়ে সম্রাজ্ঞী নূরজাহান এক দিনের ব্যবধানে মধ্য প্রদেশের মান্তু দুর্গের কাছে চারটি বাঘ হত্যা করেন। রেল কর্মকর্তা ব্রিটিশ শ্বেতাঙ্গ শিকারি ডাব্লিউ রাইস ১৮৫০ থেকে ১৮৫৪ খ্রিস্টাব্দে চার বছরে ১৫৮টি বাঘ শিকার করেন। ১৮৬৩ থেকে ১৮৬৪ খ্রিস্টাব্দে মাত্র দুই বছরে নর্মদা নদীর পাশ থেকে ৭৩টি বাঘ শিকার করেন আরেক ব্রিটিশ শিকারি আর গর্ডন কামিং। ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষভাগে মধ্য প্রদেশের বনাঞ্চল থেকে ৬০০টি বাঘ শিকার করেন আরেক ব্রিটিশ শিকারি বি সাইমন। ১৯০৩ সালে ব্রিটিশ শিকারি মন্টেগু জিরার্ড মধ্য ভারত ও হায়দরাবাদ থেকে ২২৭টি বাঘ শিকার করেন। মহারাজা স্যার গুর্জার ১৯৬৫ সাল পর্যন্ত ১১৫০টি বাঘ শিকার করেন। গুর্জারের দেখাদেখি উদয়পুরের মহারাজা ফতে সিং এক হাজারটি বাঘ হত্যা করেন। এ সময় গোয়ালিওর মহারাজা মাধো রাও সিন্ধিয়া ৮০০, রেওয়ার মহারাজা গুলাব সিং ৬১৬, কুচবিহারের মহারাজা নৃপেন্দ্র নারায়ণ ৩৭০টি বাঘ শিকার করেছেন। কিন্তু এগুলো ছিল নির্বিচার হত্যাকাণ্ড, বিনা অপরাধে শুধু রাজরাজড়াদের খেয়াল মেটাতে বেঘোরে প্রাণ দিয়েছে এসব বাঘ। তাঁরা কেউ মানুষখেকো বাঘ হত্যা করেননি। হত্যা করেননি ডোরাকাটা দুর্ধর্ষ রয়েল বেঙ্গল টাইগার। শিকার করেননি পচাব্দীর মতো ১২ ফুট লম্বা রয়েল বেঙ্গল টাইগার। ওই শিকারিরা মেছো বাঘ, চিতা বাঘ কিংবা জঙ্গলের স্বাধীন বাঘের মতো প্রাণী পাইক-পেয়াদা নিয়ে হত্যা করে উল্লাস করেছেন, বাঘ শিকারের ইতিহাসে নিজেদের নাম লিখিয়েছেন। কিন্তু গ্রামের একজন সহজ-সরল মানুষ, যিনি নিজের বুদ্ধিমত্তায় পাকিস্তানের তৈরি একনলা সেকেন্দার বন্দুক দিয়ে ২৩টি মানুষখেকো, সব মিলিয়ে ৫৭টি রয়েল বেঙ্গল টাইগার হত্যা করে নতুন এক ইতিহাস গড়েছেন, তাঁর কথা যেন ভুলে না যাই।
বিঃদ্রঃসকলের জ্ঞাতার্থে বলছি এখন বাঘ শিকার করা অপরাধ হলেও তখনকার সময় ছিলো না।তাছাড়া উনি পরে সরকারের অনুমতি নিয়ে বৈধভাবে শিকার করছেন।পরে বনবিভাগেও কাজ করছেন।
এখন যে সুন্দরবন ৫০বছর আগে এমন ছিলো না।তখন আরো ভয়ংকর ছিলো।মানুষের জীবন বাঁচাতে উনি এ কাজ করছেন।
© সাতক্ষীরার ইতিহাস পেইজ
দৈনিক কলম কথা সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।