পবিত্র কোরআনে যেসব জাতিগোষ্ঠীর ধ্বংসের বিবরণ এসেছে সালিহ (আ.)-এর সম্প্রদায় তাদের অন্যতম। আল্লাহর দ্বিন প্রত্যাখ্যান, তাঁর নবীর সঙ্গে দুর্ব্যবহার এবং আল্লাহর নিদর্শন হিসেবে প্রেরিত উটনীকে হত্যা করার অপরাধে আল্লাহ তাদের ধ্বংস করে দিয়েছেন।

তবে আল্লাহ তাআলা তাদের ধ্বংসাবশেষকে মানবজাতির জন্য নিদর্শন রেখে দিয়েছেন। পবিত্র কোরআনে ইরশাদ হয়েছে, ‘বলুন, পৃথিবীতে পরিভ্রমণ কোরো এবং দেখো অপরাধীদের পরিণাম কিরূপ হয়েছে।’ (সুরা নামল, আয়াত : ৬৯) কোন শহরে এসেছিলেন সালিহ (আ.) : ধারণা করা হয়, সৌদি আরবের প্রত্নতাত্ত্বিক নগরী হিজরে আগমন করেছিলেন নবী সালিহ (আ.)।

তাঁর দিকে সম্পৃক্ত করে এই শহরকে ‘মাদায়িন সালিহ’ও বলা হয়। ইসলাম-পূর্ব আরব সভ্যতায় নাবতিয়ানদের প্রতিষ্ঠিত এই শহর বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ, যা মদিনা থেকে ২৫০ কিলোমিটার উত্তর-পশ্চিমে অবস্থিত। পবিত্র কোরআনে শহরটিকে ‘আসহাবুল হিজর’ বলে চিহ্নিত করা হয়েছে। শহরের গোড়াপত্তন ও ক্রমবিকাশ : অ্যাসিরিয়ান উৎসগুলো জানায়, খ্রিস্টপূর্ব আট শ বছর পূর্বে সামুদ গোত্র ‘মাদায়িন সালিহ’ শহর প্রতিষ্ঠা করে।

খ্রিস্টপূর্ব তৃতীয় ও দ্বিতীয় শতকে ‘লিহয়ান’ গোত্রের মানুষরা এই স্থানে বসবাস শুরু করে এবং এখানে তারা পাথরে তৈরি বিভিন্ন শিল্পকার্য সম্পাদন করে। তারাই ‘মাদায়িন সালিহ’ শহরকে মরুযাত্রী পর্যটকদের শহরে রূপান্তরিত করেছিল, যেখানে ব্যবসায়ীরা বিশ্রাম নিতেন এবং তাঁদের পণ্যসামগ্রী বিক্রি করতেন।

 

শহরের উন্নতি : নাবতিয়ানরা খ্রিস্টপূর্ব প্রথম শতাব্দীতে এই শহর দখল করেছিল। তারা যাযাবর জাতি ছিল এবং সিনাই ও আরবের উত্তর-পশ্চিমে বর্তমান জর্দানে এক শক্তিশালী সাম্রাজ্য স্থাপন করেছিল। তাদের শাসনকালেই ‘মাদায়িন সালিহ’ আদর্শ শহরের রূপান্তরিত হয়। তারা বৃষ্টির পানি জলাধারে সঞ্চিত রেখে চাষবাদের নতুন কৌশলের উদ্ভাবন করেছিল। সাম্রাজ্যের রাজধানী জর্দানের পেত্রা নগরীর পর হিজরা ছিল দ্বিতীয় প্রধান শহর।

 

পতনের সূচনা : ১০৬ খ্রিস্টাব্দে রোমান সম্রাট ট্রাজান মাদায়িন সালিহ দখল করে। তখন ব্যাবসায়িক পথ পরিবর্তনের ফলে শহরের গুরুত্ব কমে যায়। ইসলামী শাসনের শুরুর দিকে এই শহর পরিত্যক্ত হয়ে যায়। শুধু হজযাত্রীদের রাস্তায় অস্থায়ী বিশ্রামের স্থান হিসেবে এই শহর ব্যবহৃত হতো।

মধ্যযুগে মাদায়িন সালিহ পুরোপুরি পরিত্যক্ত হয়। শহরের যা কিছু টিকে আছে :

প্রাচীন এই শহরে ধ্বংসাবশেষ হিসেবে যা কিছু পাওয়া যায় তা হলো—চারটি সমাধিক্ষেত্র, যা প্রায় ১২ কিমি বিস্তৃত। যাতে ১৩০টিরও বেশি নকশা করা পাথর দিয়ে সজ্জিত সমাধি আছে। এ ছাড়া সরু গলিপথ, পুরনো সভাকক্ষ, নাবতিয়ান দেবী দুশারার প্রার্থনাস্থল, ৬০টি কূপ আছে,যার কয়েকটি পাথর খুঁদে তৈরি করা হয়েছিল এবং পোড়া মাটির তৈরি ইটের বহু ভাঙা বাড়ি।

কোরআনের বর্ণনায় পরিণতি : কোরআনের বর্ণনা মতে, হিজর নগরীর অধিবাসীদের একসঙ্গে ধ্বংস করে দেওয়া হয়। ইরশাদ হয়েছে, ‘অতঃপর যারা সীমালঙ্ঘন করেছিল মহানাদ তাদের আঘাত করল; ফলে তারা নিজ নিজ ঘরে নতজানু অবস্থায় শেষ হয়ে গেল। যেন তারা সেখানে কখনো বসবাস করেনি। জেনে রেখো! সামুদ সম্প্রদায় তো তাদের প্রতিপালককে অস্বীকার করেছিল। জেনে রেখো! ধ্বংসই হলো সামুদ সম্প্রদায়ের পরিণাম।’ (সুরা হুদ, আয়াত : ৬৭-৬৮)

মুসলিম ঐতিহাসিকদের মতামত : মুসলিম ঐতিহাসিকদের বর্ণনা থেকে বোঝা যায়, হিজর বা মাদায়িন সালিহ শহর ধীরে ধীরে পরিত্যক্ত হয়নি, বরং আল্লাহর শাস্তিতে ধ্বংস হওয়ার পর সেখানে আর বসতি গড়ে ওঠেনি। কোরআনের আয়াত থেকেও এমনটি অনুমিত হয়। আল্লামা ইবনে কাসির (রহ.) ‘আল-বিদায়া ওয়ান-নিহায়া’ গ্রন্থে সালিহ (আ.), সামুদ গোত্র ও হিজর শহর নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করেছেন। তাঁর বর্ণনা থেকে প্রমাণিত হয়,

ইসলামী যুগের আগেই শহরটি ধ্বংসপ্রাপ্ত ও পরিত্যক্ত হয়। তিনি সেখানে লেখেন, ‘তাবুক অভিযানের সময় রাসুলুল্লাহ (সা.) মুসলিম বাহিনী নিয়ে হিজর উপত্যকায় অবতরণ করেন, যেখানে সামুদ জাতি বসবাস করত। সামুদ জাতি যেসব কূপের পানি পান করত, লোকজন সেসব কূপের পানি ব্যবহার করে। কিন্তু নবীজি (সা.) লোকদের সেই ধ্বংসপ্রাপ্ত জাতির বাসস্থানে যেতে নিষেধ করেন এবং তিনি বলেন, আমার আশঙ্কা হয় তোমাদের ওপর না তাদের মতো আজাব আপতিত হয়।

সুতরাং তোমরা তাদের ওই স্থানে প্রবেশ কোরো না। (আল-বিদায়া ওয়ান-নিহায়া : ১/৩১৯) তবে কেউ কেউ উভয় অভিমতের মধ্যে এভাবে সমন্বয় করেন—মাদায়িন সালিহ বা হিজর একটি বিস্তৃত অঞ্চলের নাম। আল্লাহর শাস্তিতে তার প্রাচীনতম অংশ ধ্বংস হয়ে যাওয়ার পর নিকটবর্তী কোনো এলাকায় হয়তো নতুন শহর গড়ে উঠেছিল।

 

তথ্যঋণ : সালাম ওয়েব, উইকিপিডিয়া ও আল-বিদায়া ওয়ান-নিহায়া